১১শ থেকে ১৫শ শতাব্দীর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%AFও দূরপ্রাচ্যের বাণিজ্যে যে নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তা হলো কারিমি বণিক। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন—আপনি রয়েছেন এক ব্যস্ত বাণিজ্যপথের কেন্দ্রে। পশ্চিমে কায়রো, পূর্বে চীনের তিয়েনশিন, দক্ষিণে ভারতের মালাবার উপকূল। পথে উটের কাফেলা এগিয়ে চলছে, লোহিত সাগরে জাহাজ ভাসছে, আর ব্যবসায়ীরা মসলার বোঝা গুনছেন। এঁরা আর কেউ নন, বরং সেই বিখ্যাত কারিমি বণিকরা, যারা শুধু পণ্য কেনাবেচাই করতেন না, বরং রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। মামলুক সুলতানদের সঙ্গে তাঁদের এমন আস্থা গড়ে ওঠে যে তাঁরা নিয়মিত কর দিতেন, এমনকি প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে ঋণও প্রদান করতেন।
কারিমিদের ইতিহাস শুরু হয় ফাতিমি আমলে, তবে তাঁদের স্বর্ণযুগ আসে মামলুক শাসনামলে। মামলুকরা বাণিজ্যকে অত্যন্ত উৎসাহ দিতেন, আর এই সুযোগে কারিমি নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয় গোটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত, চীন এবং ইউরোপ পর্যন্ত। তাঁদের ব্যবসা ছিল বৈচিত্র্যময়—ভারতের সুগন্ধি মসলা, চীনের রেশম ও চীনামাটি, মূল্যবান গহনা, সুতি কাপড়, কাঠ, খাদ্যদ্রব্য, এমনকি অস্ত্রও তাঁদের পণ্যের তালিকায় ছিল।

মধ্যযুগীয় কোন ইসলামি বাজার বা দরজা—যা ঐ সময়ের আরব আর্কিটেকচার এবং বাণিজ্যকেন্দ্রের স্মারক।
এই পণ্যগুলো প্রথমে ভারতের বন্দর বা চীনের শহর থেকে আসত ইয়েমেনের আদেন বন্দরে। সেখান থেকে লোহিত সাগর হয়ে আইযাব বন্দরে পৌঁছাত, তারপর উটের কাফেলায় মিশরে যেত। মিশরের গুদামেই অপেক্ষা করত ইউরোপের জেনোয়া, ভেনিস, মার্সেই, পিসা ও কাতালোনিয়ার বণিকেরা, যারা এসব পণ্য কিনে নিয়ে যেতেন তাঁদের দেশে। এই বিশাল বাণিজ্য নেটওয়ার্কই কারিমিদের মধ্যযুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান শক্তি বানিয়েছিল।
কারিমিরা শুধু ধনীই ছিলেন না, তাঁরা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী ছিলেন। অনেক কারিমি বণিক প্রশাসনের উচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন, যা তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে সহায়ক হতো। তবে ১৫শ শতকের শেষদিকে তাঁদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। মামলুক শাসকদের কঠোর অর্থনৈতিক নীতি এবং ইউরোপীয় পোপের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তাঁদের ওপর বড় আঘাত হানে। একসময় বিশ্ববাণিজ্যের শীর্ষে থাকা এই গোষ্ঠী ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যায়।
‘কারিমি’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেন এটি এসেছে পার্সিয়ান ‘করিমা’ শহর থেকে, আবার কেউ বলেন এটি আরবি ‘কারিম’ শব্দ থেকে, যার অর্থ উদার বা সম্মানিত। শুরুর দিকে কারিমি নেটওয়ার্কে মিশরের খ্রিস্টান কপটিক বণিকেরাও যুক্ত ছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে তাঁদের প্রভাব পরে কমে যায়।
যদিও তাঁদের ক্ষমতার অবসান হয়েছিল, তবুও ইতিহাস কারিমি বণিকদের নাম ভুলে যায়নি। তাঁরা শুধু মুসলিম বিশ্বের বাণিজ্যের প্রতীকই নন, বরং মধ্যযুগের বৈশ্বিক অর্থনীতি, কূটনীতি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক অনন্য উদাহরণ। তাঁদের ব্যবসায়িক দক্ষতা, পারস্পরিক আস্থা এবং দূরদর্শিতা আজও বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে এক অনুকরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে।