সম্রাট আকবরের জীবন ছিল গল্প ও বইয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসায় ভরা। লেখিকা ইরা মুখোটি ‘আকবরের প্রিয় বিষয়বস্তু’ শিরোনামে এক সিরিজে সম্রাটের এই আকর্ষণীয় দিকগুলো তুলে ধরেছেন। আকবরের চরিত্রের রহস্যময় বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁকে তাঁর জীবনীকারদের কাছে বিশেষ করে তোলে।
সম্রাট আকবর ছিলেন এমন এক অজানা ব্যক্তিত্ব যাকে সহজে কোনো এক নির্দিষ্ট ধারায় ফেলা সম্ভব নয়। তিনি এক বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া না শিখলেও তাঁর অগাধ জ্ঞান, যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়তা, আর শিশুদের মতো গল্প শোনার আগ্রহ তাঁকে এক ব্যতিক্রমী মানুষে পরিণত করে। প্রতিদিনই তাঁকে বই পড়ে শোনানো হতো, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও এই অভ্যাস তিনি ছাড়তেন না।
বই পড়া নয়, বই শোনা — এক অভিনব পাঠভ্যাস
আকবরের এই বইপ্রেম ছিল একটু ভিন্নধরনের। তাঁর মনে ছিল গভীর কৌতূহল আর জ্ঞানপিপাসা। যেহেতু নিজে বই পড়তে পারতেন না, তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষভাবে নির্বাচিত পণ্ডিত তাঁকে বই পড়ে শোনাতেন। আর এই দায়িত্বে প্রায়শই থাকতেন তাঁর ভাই মীরজা আজিজ কোকা। গল্প, ইতিহাস, কাব্য, ধর্মীয় গ্রন্থ—সবই আকবর মন দিয়ে শুনতেন।
বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা থেকেই তাঁর রাজ্যে জন্ম নেয় মুঘল ভারতের অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগার ও চিত্রশৈলীর কেন্দ্র।
তাঁর প্রিয় বইগুলোর কিছু বর্ণনা
হামজনামা : শৈশবের প্রিয় সঙ্গী
যুবক বয়সে আকবরের সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল হামজনামা। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর চাচা আমির হামজার দুঃসাহসিক জীবনের কাহিনি ছিল এটি। আকবর এতই মগ্ন হতেন এই গল্পে যে প্রাসাদের করিডরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেই জোরে জোরে অংশবিশেষ আবৃত্তি করতেন। তাঁর প্রিয় গল্পকথক দরবার খান হাতের ভঙ্গি আর কণ্ঠের ওঠানামায় কাহিনিকে জীবন্ত করে তুলতেন। শুধু তাই নয়, আকবর এই গল্পগুলোর উপর “মিনিয়েচার পেইন্টিং” তৈরির আদেশ দেন। পনেরো বছর ধরে ১৪০০টি চিত্র আঁকা হয়, যা মুঘল চিত্রকলার ধারাই বদলে দেয়।

হামজনামার একটি পৃষ্ঠা © MAK Museum
আনওয়ার-ই-সুহেইলি : প্রাণীদের গল্পে শিক্ষা
পঞ্চতন্ত্র থেকে লেখা আনওয়ার-ই-সুহেইলিও ছিল আকবরের বিশেষ পছন্দের। এতে প্রাণীদের মাধ্যমে মানবজীবন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হতো। রাজপুত্র সেলিম ও অন্য শিশুদের শেখানোর জন্য আকবর এর একটি সহজ সংস্করণ তৈরি করান, যার নাম ইয়ার-এ-দানেশ বা ‘প্রজ্ঞার মুক্তো’। এই বইয়ে আঁকা সিংহ, চিতা, ভালুক আর পাখিদের মনোমুগ্ধকর ছবিগুলো রাজপুত্রদের কাছে যেন জীবন্ত হয়ে উঠত।

[হুসাইন আলি ওয়াইজ রচিত দ্য লায়নের কোর্ট, আনোয়ার-ই-সুহাইলি হলো পঞ্চতন্ত্র-এর একটি পারসিক সংস্করণ। ভারত কলা ভবনের সংগ্রহ থেকে; শিল্পী ফাররুখ চেলা। আনুমানিক ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দ।
বাইবেল : শিল্পের বিস্ময়
১৫৮০ সালে জেসুইট মিশনারিরা ফতেপুর সিক্রিতে এসে আকবরকে উপহার দেন এক বিরল রয়্যাল পলিগ্লট বাইবেল। সাত খণ্ডের সেই বই হাতে নিয়ে আকবর পাগড়ি খুলে মাথায় ছুঁয়ে চুমু খান। ধর্মীয় প্রভাবের চেয়ে শিল্পীসুলভ বিস্ময়ই তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে।
এই বইটিতে যীশুখ্রিস্টের জীবনের কাহিনি ও তাঁর অলৌকিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ লেখা ও আঁকা ছিল। আকবর গভীর আগ্রহ নিয়ে এই গল্প শুনতেন। খ্রিস্টান পাদ্রিরা আকবরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর আগ্রহ ছিল পাশ্চাত্যের জ্ঞানের প্রতি। এ ছিল শিক্ষাগত ও শৈল্পিক—ধর্মান্তর নয়।

বাইবেল! 📖
তিনি গল্পের বাইরেও ভালোবাসতেন সেই বইয়ের চিত্রকলাগুলো—যেখানে যীশুর জীবনকে তুলে ধরা হতো দৃষ্টিনন্দন শিল্পে। বইয়ের রঙিন ছবিগুলো দেখে মুঘল শিল্পীরা ইউরোপীয় রীতির গভীরতা আর ছায়া-প্রতিচ্ছবি আঁকতে শেখে। মুঘল চিত্রশিল্পী মিসকিনের হাতে আঁকা এক চিত্রে দেখা যায়, ইউরোপীয় শিল্প ধারার প্রভাব মুঘল দরবারে প্রবেশ করেছিল। চিত্রে মাতা মেরির পোশাক, তাঁর ঢেউ খেলানো বাদামী চুল ইত্যাদি সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে। আকবরের শৈল্পিক দৃষ্টি এত গভীর ছিল যে তিনি তাঁর প্রধান চিত্রশিল্পীদের ইউরোপীয় চিত্রকর্মের ধারা অধ্যয়ন করতে বাধ্য করতেন—যাতে তারা পর্যবেক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি (perspective) সম্পর্কে শিখতে পারে।
খ্রিস্টের জীবনকাহিনি : মিরাত-উল-কুদস
খ্রিস্টের জীবনের গল্পও সম্রাট আকবর ফারসিতে অনুবাদ করান। নাম রাখা হয় মিরাত-উল-কুদস বা ‘পবিত্রতার আয়না’। এতে যীশুর জীবন ও অলৌকিক কাহিনী বর্ণিত ছিল। আকবর খুব পছন্দ করতেন এই কাহিনী শুনতে।
রুমির কবিতা : হৃদয়ের সঙ্গীত
আকবরের মনে এক বিশাল জায়গা করে নিয়েছিল রুমি। মাসনভির বহু লাইন তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। তাঁর প্রিয় কয়েকটি পঙ্ক্তির মধ্যে ছিল—
“তুমি এসেছো মিলনের জন্য, বিচ্ছেদের জন্য নয়।
হিন্দের মানুষদের জন্য হিন্দি ভাষা শ্রেষ্ঠ,
সিন্ধের জন্য সিন্ধি ভাষাই শ্রদ্ধার যোগ্য।”

জালাল উদ্দিন রুমী (মৃত্যু ৬৭২ হি./১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মসনভি-ই মানভি | ওয়াল্টার্স আর্ট মিউজিয়াম
মহাভারত : সাহসী অনুবাদ
১৫৮২ সালে আকবর এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ নিলেন। তিনি মহাভারতকে সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করতে আদেশ দিলেন। বইটির নাম রাখা হলো রাজনামা বা ‘যুদ্ধের গ্রন্থ’। তিনি নিজেই অনুবাদের তদারকি করতেন। একবার তো রেগে গিয়ে তিনি অনুবাদক বদাউনীকে ভর্ৎসনাও করেছিলেন, কারণ তিনি ইচ্ছে করে হিন্দু মহাকাব্যের অর্থ বিকৃত করছিলেন।

প্রায় ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাম দাস কর্তৃক রচিত | ভীষ্মের মৃত্যু।
দিওয়ান-ই-আনভারি
আকবরের ভালো লাগার তালিকায় ছিল কবি আনভারির দিওয়ান। ছোট্ট বইটি ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা আর আড়াই ইঞ্চি চওড়া। এতে মাত্র ১৫টি ছবি থাকলেও বইটি ছিল অত্যন্ত মার্জিতভাবে তৈরি। সোনার পানিতে ধোয়া প্রতিটি কাগজ, দামী রঙ, চমৎকার ক্যালিগ্রাফি, সুদৃশ্য আলোকচিত্র ও সূক্ষ্ম বাঁধাই—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক অনন্য সৃষ্টি।
এভাবেই গল্প, কবিতা আর ধর্মগ্রন্থে ভরা ছিল সম্রাট আকবরের জগৎ। একটি বড় রহস্য হলো, আকবর আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হলেও তিনি বিশ্বের নানা বিষয়ে খুবই পরিচিত ছিলেন। সেই সময় আকবরের শিল্পচর্চা ও সাহিত্যপ্রেম একসঙ্গে মিলিত হয়ে সম্রাটের জীবনকে করে তুলেছিল অতুলনীয়। তাঁর বই ও গল্পের প্রতি ভালোবাসা শুধু জ্ঞান আহরণই নয়, শিল্প ও সৌন্দর্যের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের মাধ্যমও ছিল।

“কবির যাত্রা” — আনভারীর দেওয়ান পাণ্ডুলিপি থেকে, সম্রাট আকবরের জন্য অনুলিখিত / ১৫৮৮, লাহোর / হার্ভার্ড আর্ট মিউজিয়াম / CC BY-NC