আমরা প্রতিদিন যে
মুরগির মাংস খাই, তার পেছনে লুকিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস, মানুষের যাত্রা, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক আদান–প্রদানের গল্প। খাবার কেবল ক্ষুধা মেটানোর বিষয় নয়; অনেক সময় তা সভ্যতার গতিপথও জানান দেয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক বাটিতে পাওয়া স্বস্তিকার চিহ্ন যেমন সেই সময়ের সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের প্রতীক, তেমনই সেই যুগের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার কথাও ইঙ্গিত করে।
গবেষকদের একাংশের মতে, গৃহপালিত মুরগির বিকাশে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে পূর্ব ভারত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই বনজ পাখি শিকার ও ধীরে ধীরে গৃহপালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এই পাখিগুলিই পরবর্তীকালে গৃহপালিত মুরগির রূপ নেয়। পার্বত্য অঞ্চল ও পূর্ব বাংলায় এক ধরনের মুরগির অস্তিত্ব ছিল, আবার ভারতের অন্যান্য অংশে দেখা যেত ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জাত। আধুনিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, আজকের বহু গৃহপালিত মুরগির জিনগত শিকড় এই বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যেই নিহিত।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুরগির ঝোল
ভাষার ইতিহাসেও মুরগির উপস্থিতি লক্ষণীয়। সংস্কৃতে “কুটকুট” এবং আফ্রিকার কিছু ভাষায় “কুক্কু” ধরনের শব্দ ব্যবহারের কথা ভাষাবিদেরা উল্লেখ করেন। যদিও এদের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র প্রমাণিত নয়, তবু ধ্বনিগত সাদৃশ্য থেকে বোঝা যায়—বাণিজ্য ও মানুষের যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ ও সংস্কৃতিও এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
খাদ্য-ইতিহাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জলপথনির্ভর বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রাম বহু শতাব্দী ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে এসেছে। ডাচসহ ইউরোপীয় বণিকদের আগমন এবং দীর্ঘ নৌযাত্রার বাস্তবতা এখানকার রান্নার ধরনে প্রভাব ফেলেছিল বলে গবেষকেরা মনে করেন। নৌকায় থাকা উপকরণ দিয়ে সহজ, টেকসই ও পুষ্টিকর খাবার তৈরির প্রয়োজন থেকেই অনেক বিশেষ রান্নার ধারা গড়ে ওঠে।
এই প্রেক্ষাপটে মগ জনগোষ্ঠীর রান্নাশৈলী ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, তারা রান্নায় দক্ষ ছিল এবং স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারে পারদর্শী ছিল। মুরগির মাংসের সঙ্গে আলু, শুকনো মরিচ, বড় পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও হলুদ ব্যবহার করে ঘন ঝোলের রান্না করা হতো। কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, এই রান্নায় ছোট চিংড়ি মাছ বেটে মেশানো হতো, যা স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়াতে সাহায্য করত। এই চিংড়ি-বাটা মুরগির সঙ্গে মেশানোর রীতি উপকূলীয় খাদ্যসংস্কৃতির একটি সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্য হিসেবেই ধরা হয়।

বাংলাদেশের নদীপথ ও বাজারের প্রভাব
এই ধরনের রান্না কেবল স্বাদের বিষয় নয়; এটি নদী, নৌকা ও যাত্রার ইতিহাসের সঙ্গেও যুক্ত। দীর্ঘ জলপথে ভ্রমণের সময় এমন খাবার সহজে রান্না করা যেত এবং অল্প উপকরণে অনেকের খাদ্য জোগান দেওয়া সম্ভব হতো। তাই এই রান্নাগুলোকে বিলাসী পদ নয়, বরং প্রয়োজন ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ফল হিসেবেই দেখা যায়।
আজকের দিনে রেস্তোরাঁ বা ফাস্টফুড চেইনে বসে আমরা যে মুরগির নানা পদ উপভোগ করি, তার পেছনে এই দীর্ঘ অভিযোজন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ইতিহাস রয়ে গেছে। নিশ্চিত দাবি নয়, বরং প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও লোকজ স্মৃতির ভিত্তিতে বলা যায়—মুরগির স্বাদে লুকিয়ে আছে মানুষের যাত্রা, নদীপথের গল্প এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ভেসে যাওয়া সংস্কৃতির ছাপ।
খাবার তাই শুধু খাদ্য নয়; এটি ইতিহাসের এক নীরব দলিল। প্রতিটি থালায়, প্রতিটি স্বাদে, হয়তো এখনও বেঁচে আছে সেই পুরোনো যাত্রা ও মানুষের সৃজনশীলতার স্মৃতি।

মগ জনগোষ্ঠীর রান্নাশৈলী