এই বিশ্বের সবকিছুরই উত্থানের পেছনে থাকে এক বা একাধিক গল্প। কোন কোন গল্প নাটকীয়, কোনটি বেদনাদায়ক, কোনটি উত্তাল, আবার কোনটি চিরাচরিত, সাধারণ। যেমন, বীজ থেকে বের হওয়া চারাটি ফুঁড়ে উঠার সময় মাটিতে সৃষ্টি করে এক উত্তাল। প্রতিদিন সূর্যের উত্থান এনে দেয় সৌন্দর্য্য। তেমনি কোন কোন সাম্রাজ্যের উত্থান হয় বিন্দুর মতো ক্ষুদ্র স্বত্বা নিয়ে, আবার কোনটির সূচনা হয় চোখ ধাঁধানো বিস্ময় দিয়ে। অটোমান সাম্রাজ্যেরও উত্থান হয় এক টুকরো জমির উপর। আজ দেখবো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া এই সাম্রাজ্যের সূচনা এবং বিস্তৃতি! আমন্ত্রণ রইলো পাশে থাকার। অটোমান সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল ছয় শো বছরেরও বেশি সময়। একসময় এর বিস্তৃতি ছিল তিনটি মহাদেশে। একদিকে ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত, অন্য দিকে মিশর হয়ে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েই ক্ষ্যান্ত ছিল না এ সাম্রাজ্য; জেরুজালেম, মক্কা এবং মদিনাও নিয়ন্ত্রণ করেছিল অটোমানরা এক সময়। অটোমানদের ক্ষিপ্রতা, শক্তি এবং সাহস ছিল সর্বজনবিদিত। অটোমানদের সময় স্থাপত্য, শিল্পকলা, নগর উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছিল অভূতপূর্ব। অটোমানদের সাম্রাজ্য আজ আর নেই, কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া ছয় শো বছরেরও উপর শাসন আজও প্রভাব রেখে চলেছে আধুনিক বিশ্বে।
বিশ্বের বিস্ময় এই সাম্রাজ্যের উত্থান হয় চৌদ্দশো শতকের একেবারে গোড়ার দিকে, এখনকার তুরস্কের আনাতোলিয়া (Anatolia) প্রদেশের এক ছোট্র এলাকায়। তুর্কী মুসলিম যাযাবর জনগোষ্ঠী (nomadic) তখন জীবিকা নির্বাহ করতো চাষাবাদ এবং গবাদি পশু লালন-পালন করে। তাদের নিজস্ব কোন রাষ্ট্র ছিল না।
এই জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলো, তাদের জন্মভূমি চলে যাচ্ছে অন্যের দখলে। পূর্ব দিক থেকে কুখ্যাত মঙ্গোলরা অগ্রসর হচ্ছিল তাদের দিকে। মঙ্গোলরা তাদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ এবং নির্মমতার জন্য পরিচিত ছিল বিশ্বব্যাপী। অন্য দিকে, পশ্চিম দিক থেকে খ্রিস্টান বাইজেন্টাইনদের আক্রমণের আশংকা তো রয়েই গিয়েছে। এই যাযাবর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভূমি এবং তাদের জীবনযাত্রা দু’টোই হুমকির মধ্যে এসে দাঁড়ালো। এমনি ক্রান্তিকালে আনাতোলিয়ানের মালভূমিতে তুর্কী মুসলিম উপজাতির ওসমান গাজী নামে এক ব্যক্তি নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিঁনিই ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
তিঁনি একজন দূর্দান্ত ঘোড়সওয়ার এবং সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তিঁনি hit & run এর মতো প্রাচীন আনাতোলিয়ান সামরিক কৌশল জানতেন খুব ভালো করে। মঙ্গোলীয় রন-কৌশলও ছিল তাঁর আয়ত্বে। তাঁকে ঘিরে ছিল একদল অকুতোভয় শক্তিশালী যোদ্ধা। ওসমান ঘোড়ার পিঠে দ্রুত চলন্ত অবস্থায় শত্রুর উপর তীর মেরে লক্ষ্য ভেদ করতে পারতেন অনায়াসে। তিঁনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় তাঁর জনগোষ্ঠীর কাছে। ওসমান ছিলেন অত্যন্ত ডাউন-টু-আর্থ বাস্তববাদী যোদ্ধা। দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে হু হু করে। ওসমান শুধু তাঁর জনগোষ্ঠীর কাছেই জনপ্রিয় ছিলেন না, অন্য জনপদের কাছেও ক্রমাগত জনপ্রিয় হতে থাকেন তাঁর সততা, ন্যায়-নীতি এবং সাহসিকতার জন্য। শুধুমাত্র মুসলমানরাই নয়, অনেক খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরও অনেক সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওসমানের দলে যোগ দিয়ে অভিযানে যেত তাঁর নেতৃত্বে। তিঁনি বাইজেন্টাইনদের ছোট ছোট সমৃদ্ধশালী জনপদগুলোতে অভিযান চালাতে থাকেন এবং দখলকৃত সম্পদ উদার এবং সমানভাবে ভাগ করে দিতেন তাঁর সৈন্য এবং জনগণের মধ্যে, রাখতেন না কিছুই নিজের জন্য।
ওসমান ছিলেন সুফী মুসলমান। তিঁনি ভাবতেন যে, ইসলামের প্রসার এবং বিস্তৃতি করা তাঁর একটি স্বর্গীয় অধিকার (divine right)। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর নাভি থেকে একটি বড় বৃক্ষ বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি এক বিজ্ঞ আলেমকে এ স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আলেম ব্যাখ্যা করলেন, সম্ভবত ওসমান এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হবেন, যা’র বিস্তৃতি হবে বিশ্বের এক বিস্ময়। ওসমানের ঐ সাম্রাজ্যের প্রভাব বিশ্বে থাকবে শত শত বছর ধরে। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকের অঞ্চলকে (Eastern Roman Empire) বলা হতো বাইজেন্টাইন (Byzantine) সাম্রাজ্য, যা’র রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনপল (Constantinople), বর্তমান তুর্কীর ইস্তাম্বুল। ঐ সময় কনস্টান্টিন একাদশ (Constantine XI) ছিলেন বাইজেন্টাইনদের সম্রাট। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে সে সময় ছিল অশান্তি, যদিও এক সময় তারা ছিল অত্যন্ত পরাক্রমশালী। যখন সুযোগ এসে গেলো, ওসমান বাইজেন্টাইনের এই দুর্বলতাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছিল পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করে। কি সে সুযোগটি?
১৩০২ সালের বসন্ত কালে, উত্তর-পূর্ব তুরস্কের সাক্কারা (Saqqara) উপত্যকায় অত্যাধিক বৃষ্টিপাত এলাকাটিকে প্লাবিত করে নিকটস্থ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে পুরোপুরি। যে উপত্যকা এবং নদীকে বাইজেন্টাইনরা এতদিন মনে করেছিল তাদের সাম্রাজ্যের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নদীর গতিপথের এই আকস্মিক পরিবর্তন সে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিমেষে করে ফেলে নিয়ন্ত্রণহীন এবং অকেজো। প্রকৃতির এই ছোট্ট একটি পরিবর্তন ইতিহাসের গতিপথকেও করে ফেলে এলোমেলো, সৃষ্টি হয় এক নতুন ইতিহাস। সাক্কারা উপত্যকার প্রকৃতির এই পরিবর্তন ওসমান ও তাঁর যোদ্ধাদের এনে দেয় ইতিহাস সৃষ্টির এক সুবর্ণ সুযোগ, এবং সুযোগটিকে তাঁরা কাজে লাগায় পুরোপুরিভাবে।
১৩০২ সালের জুলাই মাসে ওসমান আক্রমণ করে বসে বাইজান্টাইনদের এলাকা, ছিনিয়ে নেয় আনাতোলিয়ার (Anatolia) মতো ছোট এক শহর। বাইজান্টাইনরাও করে পাল্টা আক্রমণ, কিন্তু ওসমানের মঙ্গোলদের কাছ থেকে শেখা রণ-কৌশলের কাছে হেরে যায় তারা শোচনীয়ভাবে। দখলকৃত আনাতোলিয়া আকারে ছিল নিউয়র্কের ম্যানহাটেনের সমান। এই ছোট্ট জমিটিই সূচনা করলো এক নতুন রাজবংশের (dynasty), বিশ্বে যা’র পরিচিতি পেলো অটোমান (Ottoman) সাম্রাজ্যে নামে। প্রসূত হলো এক অপ্রতিরোধ্য প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীর। বপন করা হলো সমৃদ্ধ ও উন্নয়নের বীজ।
সময় গড়ায়, বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। ওসমানের সৈন্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে সময়ের সাথে সাথে। ১৩০৭ সালে, ওসমানের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো ৪০০০, কিন্তু তিঁনি যখন প্রথম তাঁর যোদ্ধা বাহিনী তৈরি করেছিলেন, তখন এর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০। পরবর্তী ২০ বছর, ওসমান গাজী আনাতোলিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অভিযান চালিয়ে জয় করে নেয় ছোট ছোট জনপদ। তাঁর বাহিনীর আক্রমণগুলো ছিল ক্ষিপ্র, সুস্পষ্ট লক্ষ্যযুক্ত এবং চূড়ান্তভাবে বিজয় নিশ্চিত করা। ওসমান তাঁর বিজিত অটোমান অঞ্চলে খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাম্বলী জনগোষ্ঠীকে দিয়েছিলেন পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা। এখানে মনে রাখা উচিত যে, তাঁর সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাম্বলী। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে, ওসমানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের বিস্তার করা। কিন্তু পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা নিশ্চিত হন যে, ওসমানের প্রধান অন্য আরেকটি অনুপ্রেরণা ছিল সমৃদ্ধ বাইজেন্টাইন শহরগুলোতে আক্রমণ করে সম্পদ আরোহন করে তাঁর জনপদ উন্নয়ন করা। তিঁনি সে সম্পদ উদারভাবে বিতরণ করে দিতেন তাঁর সৈন্যদের মধ্যে।
১৩১৭-১৩২০ সালের কোন এক সময় ওসমান বাইজেন্টাইনদের শহর, বর্তমান তুর্কীর বুর্সা (Bursa) দখল করার জন্য শহরটিকে ঘেরাও করেন তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে। এই ঘেরাও ছিল প্রায় নয় বছর। কিন্তু শহরটি জয় করার আগেই ওসমান মৃত্যু বরন করেন বুর্সার নিকটেই। অনেক ঐতিহাসিকের দাবী, ১৩২৬ সালে ওসমান তাঁর মৃত্যু শয্যায় জানতে পারেন যে, তাঁর ছেলে ওরহান গাজী বুর্সা জয় করে ফেলেছে। ১৩২৬ সালে ওসমান মারা যান বুর্সা শহরের পাশেই। তিঁনি মারা যাওয়ার সময় রেখে যান একটি ঘোড়ায় চড়ার পোশাক (armour), এক জোড়া বুট, কয়েকটি সূর্যের জ্যাকস, একটি তরোয়াল, একটি তির্কেস, একটি লেন্স, কয়েকটি ঘোড়া, ভেড়ার তিনটি পাল, লবণ এবং চামচের পাত্র। রেখে যাননি তাঁর ব্যক্তিগত কোন অর্থ বা সম্পদ।
ওসমানের মৃত্যুর পর অটোমানদের অধিপতি হন তাঁর পুত্র ওরহান গাজী, এবং গড়ে তোলেন আরও শক্তিশালী সেনাবাহিনী। তিঁনি ছোট ছোট অঞ্চল দখল করে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাঁর স্বপ্ন ছিল অনেক বিশাল, তিঁনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ওরহান বিয়ে করেন বাইজেন্টাইন রাজকুমারী নিলুফার হাতুনকে। ১৩২৬ সালে ওরহান বুর্সা দখল করে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন সেখানে। বুর্সার বিজয় ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের এক মাইল ফলক। অটোমানদের এই জয় বিশ্বের, বিশেষ করে ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ পাল্টিয়ে দেয় পুরোপুরি। ওরহানের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ছিল কীভাবে এই নতুন শহরকে পরিচালনা করা যায়। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যে নিজস্ব মুদ্রা চালু করেন, আর্থিক ব্যবস্থার প্রচলন করেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন অনেক। অটোমানরা নগর উন্নয়নে অনেক অগ্রগতি সাধিত করে। যেমন, তাঁবুর পরিবর্তে পাথর এবং কাঠের বাড়ী-ঘর নির্মাণ করা শুরু করে, কাঠের ছাদের প্রচলন করে, এবং কৃষির উন্নয়ন করে প্রচুর।
অটোমানরা ওরহানের নেতৃত্বে অনেক বাইজেন্টাইন শহর দখল করে ফেলে। ওরহান ১৩৩০ সালে ইজনিক (Nicea), ১৩৩১ সালে মুদুরনু (Mudurnu), ১৩৩৩ সালে গেমলিক (Gemlik), ১৩৩৭ সালে ইজমিট (Izmit), আঙ্কারা এবং গ্যালিপোলি-দারাদেনেলিসকে (Gallipoli-Dardanelles) ১৩৫৪ সালে জয় করে অটোমান সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করে নিয়ে যান বসফোরাস নদীর এশিয়ার অংশে। শুধু কি তাই? ১৩৫০ দশকের গোড়ার দিকে, ওরহান ৬০০০ সৈন্য নিয়ে বলকান এবং ইউরোপের কিছু এলাকা জয় করে ফেলেন। অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ষাট বছরের মধ্যেই ওরহান হয়ে উঠেন পাঁচ লক্ষ অধিবাসীর শাসক। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক বাইজেন্টাইন শহর দখল করা সত্ত্বেও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী অটোমানদেরকে দখলদার না ভেবে মুক্তকারী হিসাবে স্বাগত জানায়। ১৩৬২ সালে, ৩৮ বছর রাজত্ব করার পর ওরহান মৃত্যু বরন করলে, তাঁর ছেলে মুরাদ প্রথম (Murad I) দায়িত্ব গ্রহণ করেন অটোমানদের।
মুরাদ প্রথমের শাসনামলে তিঁনি জ্যানিসারি কর্পস (Janissary Corps) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি ছিল অটোমান সুলতানের একটি বিশেষ সেনাবাহিনী। অটোমান সাম্রাজ্যের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ে জ্যানিসারির অবদান ছিল অপরিসীম। এই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছিল অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং রন-কৌশলে পারদর্শী। মুরাদ অল্প বয়সের যোগ্য খ্রিস্টান ছেলেদের বাছাই করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতেন। বাছাই করা ছেলেদেরকে তাদের পরিবার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হতো। জ্যানিসারি আদতে ছিল একটি খ্রিস্টান সেনাবাহিনী। এই বিশেষ সেনা সদস্যদের শেখানো হতো বিশ্ব-মানের লড়াই। জ্যানিসারির অনেকেই পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হয়ে ওঠে। জ্যানিসারির সদস্যরা সমাজে ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে উত্তরণের জন্য ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব ছিল একেবারেই নগন্য। তাই, অনেক খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সদস্য সুলতানের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। অবশ্য, অনেক জ্যানিসারি ইসলামেও ধর্মান্তরিত হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষ হলে, তাদেরকে বেশ কিছু দিন কাটাতে হতো তুর্কি পরিবারের সাথে। অতি বুদ্ধিমানদের পাঠানো হতো স্কুলে আরো উন্নত শিক্ষার জন্য। জ্যানিসারিরা ছিল সুলতানের প্রতি অত্যন্ত অনুগত এবং বিশ্বস্ত।
১৩৮৯ সালে, সুলতান মুরাদ ৭০ বছর বয়সে কসোভোর এক যুদ্ধে আহত হন। তিনি যখন আহত হয়ে মৃত্যু পথযাত্রী, সে সময় তার পুত্র বাইজিদ প্রথম (Bayezid I) তাঁর ভাই ইয়াকুবকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। অটোমান রাজবংশে রাজপুত্র তাদের সব প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদেরকে হত্যা করে, নতুবা তাকে হত্যা করবে অন্যরা। এটাই তখন ছিল স্বাভাবিক, যদিও এখন তা’ অকল্পনীয়। সুলতান মুরাদের মৃত্যুর পর, ১৩৮৯ সালে বাইজিদ প্রথম হন নতুন সুলতান। পরবর্তী কয়েক দশকে, অটোমান সাম্রাজ্য পড়ে যায় বিশৃঙ্খলায়। বাইজিদ ইউরোপ ও এশিয়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটালেও, তাঁর অবসান ঘটে পরাজয়ের মধ্য দিয়েই। বাইজিদ সে সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং কনস্টান্টিনোপল জয় করার জন্য ঘেরাও করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। তিঁনি ১৩৯৬ সালে নিকোপলিসে (আধুনিক বুলগেরিয়ায়) ক্রুসেডারদের পরাজিত করেন নিদারুণভাবে। ১৪০২ সালে আঙ্কারার যুদ্ধে তিনি তৈমুর লঙ্গের হাতে পরাজিত হয়ে বন্দী হন এবং ১৪০৩ সালের মার্চ মাসে বন্দী অবস্থায় মারা যান।
নতুন একজন যোগ্য সুলতান না আসা পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যে সূত্রপাত হয় গৃহযুদ্ধের। পনেরো শো শতকের গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের হয় নাটকীয় পতন। ১৪১৩ সালে বাইজিদের ছেলে মেহমেদ প্রথম (Mehmed I) হন অটোমান সুলতান। তিঁনি সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনেন স্বাভাবিক অবস্থায়। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যে তাঁর কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপন করেন। তিঁনি ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রসার করেন আরও। তিঁনি ১৪২১ সালে মারা যান মাত্র আট বছর রাজত্ব করে, কিন্তু অটোমানদের দিয়ে যান একটি গৃহযুদ্ধহীন সাম্রাজ্য।
তাঁর মৃত্যুর পর, ১৪২১ সালে পুত্র মুরাদ দ্বিতীয় (Murad II) হন সুলতান। ইউরোপে ২০ বছরের সফল সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন মুরাদ দ্বিতীয়। মুরাদ বলকান এবং তুর্কী বেইলিকদের (Turkish beyliks) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন দীর্ঘ বিশ বছরের উপর। তেইশ বছর সফলতার সাথে শাসন করে মুরাদ দ্বিতীয় হয়ে পড়েন ক্লান্ত।
১৪৪৪ সালে তিঁনি চলে যান অবসরে, ক্ষমতা দিয়ে যান ১২ বছরের মেহমেদ দ্বিতীয়কে (Mehmed II)। মুরাদের অবসরের দুই বছরের মাথায় সাম্রাজ্যে দেখা দেয় সমস্যা। হাঙ্গেরী এবং ভেনিস একজোট হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে অটোমানদের বিরুদ্ধে। ১৪৪৬ সালে মুরাদ দ্বিতীয় ফিরে আসেন অবসর থেকে, সুলতান মেহমেদকে সরিয়ে নিজে আবার সুলতান হয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েন ইউরোপিয়ান জোটের বিরুদ্ধে। হটিয়ে দেন তাদেরকে। ১৪৫১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর্যন্ত তিঁনি ছিলেন সুলতান। মেহমেদ দ্বিতীয় আবারো সুলতান হন ১৯ বছর বয়সে দ্বিতীয় বারের জন্য।
এ ছিল অটোমানদের প্রথম ১৫০ বছরের প্রাথমিক উত্থানের গল্প। এটা মাত্র শুরু! অটোমানদের বিশ্বকে অবাক করে দেয়ার চমকপ্রদ ইতিহাসের আরেক বিশাল অধ্যায় তো পরেই রয়েছে। সে উপাখ্যান দেখবো পরবর্তী কোন এক বিবরণীতে। অপেক্ষায়!