কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর এক পশ্চিমা সাহেব যে তাঁকে বলেছিলেন, ‘টেগোর, তোমার গীতাঞ্জলি বইটা দারুণ হয়েছে, কিন্তু আমি ভাবছি, ওটা তোমাকে কে লিখে দিল’ এবং জবারে কবিগুরু যে বলেছিলেন, ‘তার আগে তুমি বলো, গীতাঞ্জলির মতো কাব্য কে তোমাকে পড়তে দিয়েছে।’
বাংলাসাহিত্যের এই সূর্যসন্তানকে কত ভাবেই না পেয়েছে বাঙালি। সাহিত্যের বিস্ময় রবীন্দ্রনাথ। এত এত সৃষ্টি! অনেকের হয়তো ভাবছেন এত কিছু নিয়ে যে লোকটি ছিলেন, তিনি নিশ্চয় ভাবগম্ভীর মানুষ ছিলেন। বাস্তবতা ছিল উল্টো। বাঙালির সব অনুভূতি ধরতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ধরতে পেরেছিলেন রসিকতাকেও। রসিক মানুষ ছিলেন বটে রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছড়া করে বলতেন –
‘কোনো দিন এত বুড়ো হবো নাকো আমি।
হাসি তামাশারে যবে কবো ছ্যাবলামি।’
চিররসিক রবীন্দ্রনাথ রঙ্গ রসিকতা করতে খুব ভালোবাসতেন।
রবীন্দ্রনাথ তখন বয়সে তরুণ। সবেমাত্র কবি হিসেবে তাঁর নাম একটু একটু করে ছড়াচ্ছে। সেই সময় তিনি নতুন কবিতা লিখেই প্রথম শোনাতেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ কাদম্বরী দেবীকে। কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী। তিনি ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। ‘ভোরের পাখি’ কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা তিনি খুব পছন্দ করতেন। নতুন বৌঠানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল মধুর সম্পর্ক। ঠাকুরপো রবির লেখা কবিতা শুনে তিনি বলতেন, ‘রবি তুমি বিহারীলালের মতো লেখো না কেন?’ বিহারীলালকে রবি নিজের গুরু মনে করতেন। নতুন বৌঠানের মুখে এই কথা শুনে রবি আরো ভালো কবিতা লেখার চেষ্টা করতেন, যাতে নতুন বৌঠান সন্তুষ্ট হন। নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী এইভাবে রবির লেখার মান উত্তরণের চেষ্টা করতেন। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী নিয়মিত আসতেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। কাদম্বরী দেবী তাঁকে নিমন্ত্রণ করে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতেন। বিহারীলালকে কাদম্বরী দেবী একবার নিজের হাতে একটি সুন্দর আসন বুনে দিয়েছিলেন। সেই আসন উপহার পেয়ে খুশি হয়ে বিহারীলাল কিছুদিন পরে ‘সাধের আসন’ নামে একটি কাব্য রচনা করেন। বিহারীলালের সঙ্গে ভোজসভায় নিয়মিত ডাক পড়ত রবীন্দ্রনাথের। কাদম্বরী দেবী দুজনকেই যত্ন করে রেঁধে খাওয়াতেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের সঙ্গে খেতে বসেছেন। বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু পদ তৃপ্তি করে খাচ্ছেন দুই কবি। কাদম্বরী দেবী পরিবেশন করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রবি রান্না কেমন হয়েছে?’ রবীন্দ্রনাথ খেতে খেতেই উত্তর দিলেন, ‘বৌঠান, পাক তো ভালোই হয়েছে। এখন পরিপাক হলেই বাঁচি!’
নিজের সৃষ্টির ব্যাপারে বরাবরই সচেতন ছিলেন। এক সভা শেষে ফিরবার পথে কবিগুরু চারু চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, ‘দেখলে চারু আমার প্রায়শ্চিত্ত। আমি না হয় গোটা কয়েক গান কবিতা লিখে অপরাধ করেছি। তাই বলে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে এ রকম যন্ত্রণা দেওয়া কি ভদ্রতা সম্মত? গান হলো কিন্তু দুজনে প্রাণপণ শক্তিতে পাল্লা দিতে লাগলেন যে, কে কত বেতালা বাজাতে পারেন আর বেসুরো গাইতে পারেন! গান যায় যদি এ পথে তো বাজনা চলে তার উল্টো পথে। গায়ক-বাদকের এমন স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টা আমি আর কস্মিনকালেও দেখিনি। তারপর ওই একরত্তি মেয়ে, তাঁকে দিয়ে নাকি সুরে আমাকে শুনিয়ে না দিলেও আমার জানা ছিল যে, তঁবু মঁরিতে হঁবে।’ উল্লেখ্য, গানের প্রথম লাইন ছিল ‘তবু মরিতে হবে’।
একবার বোলপুরে বসন্তের প্রকোপ দেখা দিল। কবিকে বসন্তের টিকা দেওয়া হবে। কিন্তু কবি সুঁই ফোটাতে বরাবরই ভিতু ছিলেন। রাজি হন না কিছুতেই, ডাক্তার ভয়ে ভয়ে এলেন কবির কাছে। কবি ডাক্তারকে দেখেই বললেন, ‘আমার কাছে এসেছ কেন ডাক্তার, যাদের ফিরে ফিরে বসন্ত আসে তাদের টিকা দাও গে যাও, আমার অত বছরে বছরে বসন্ত আসে না।’
সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল একবার ভাগলপুর থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ তখন আছেন উত্তরায়ণে। বনফুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১১টার সময় দেখা করতে এলেন। বনফুল ঘরে ঢুকে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথ একটা বিরাট ঘরে বিরাট টেবিলে ঝুঁকে মন দিয়ে লিখে চলেছেন। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বনফুল অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। ডেকে কবিকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। লিখতে লিখতে একসময় রবীন্দ্রনাথই মুখ তুলে দেখলেন, সামনে বনফুল দাঁড়িয়ে। বনফুলকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কখন এলে? বসো, আমার লেখাটা এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে।’ বনফুল বসলেন। রবীন্দ্রনাথ লেখা শেষ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো কী খবর?’ বনফুল করজোড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গুরুদেব, অত ঝুঁকে লিখতে আপনার কষ্ট হয় না? আজকাল তো দেখি কত রকম চেয়ার বেরিয়েছে, তাতে ঠেস দিয়ে বসে আরাম করে লেখা যায়।’ বনফুলের কথা শুনে পরিহাসপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন, ‘জানি সব রকমের চেয়ারই আমার আছে। কিন্তু ঝুঁকে লিখলে লেখা বেরোয় না যে! আসলে কুঁজোর জল কমে গেছে তো তাই উপুড় করতে হয়।’
একবার রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করে সুর বাঁধছিলেন, কথা বসাচ্ছিলেন এবং এমনিভাবে পায়চারি করতে করতে গান রচনা করছিলেন। গান শেষ হতেই ডাক পড়েছিল অমলা দাশের – ‘অমলা ও অমলা, শিগগির এসে শিখে নাও, এক্ষুণি ভুলে যাব কিন্তু।’ মৃণালিনী দেবী হেসে বললেন, ‘এমন মানুষ আর কখনো দেখেছ অমলা, নিজের দেওয়া সুর নিজেই ভুলে যায়।’ রবীন্দ্রনাথের সপ্রতিভ জবাব, ‘অসাধারণ মানুষদের সবই অসাধারণ হয়। ছোট বউ চিনলে না তো।’
কবিগুরুর প্রিয় চাকর বনমালী একদিন গল্প করে বলল, তাদের দেশে মনিবাবা নামে এক সাধু আছেন। তার নাম তিনবার নিলে সাপে কাটা মানুষও ভালো হয়ে যায়। কবি অনিল চন্দ্রকে ডেকে বললেন, ‘অনিল, একটা কেউটে সাপ এনে বনমালীকে কাটা, দেখা যাক মনিবাবুর মাহাত্ম্য।’ বনমালী বুঝল এটা রসিকতা। সেও হাসল।
আরেকদিন সন্ধেবেলা রবীন্দ্রনাথ ‘হে মাধবী দ্বিধা কেন’ গানটি শেখাচ্ছিলেন। এমন সময় ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে ইতস্তত করছিল, আসবে কি আসবে না? রবীন্দ্রনাথ বনমালীকে দেখেই আবার গেয়ে উঠলেন – ‘হে মাধবী দ্বিধা কেন?’
শান্তিনিকেতনে খুব মশা ছিল। তাই কবি হাতে পায়ে একবার তেল ব্যবহার করতেন। কখনো কোন আগন্তুক উপস্থিত হলে মজা করে বলতেন, ‘ভেব না যে আমি বুড়ো মানুষ, বাত হয়েছে বলে পায়ে তেল মালিশ করছি। এ মশার ভয়ে। শান্তিনিকেতনের মশারা ভারী নম্র। তারা সারাক্ষণই পদসেবা করে।’
কবিগুরু কথা প্রসঙ্গে দিনুবাবুকে (তাঁর নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ) একবার বলেছিলেন, ‘বুঝলি দিনু, সেদিন অমুক লোকটা আমার কাছ থেকে দশ টাকা ধার নিয়ে গদ গদ কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলুম’। দিনুবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ‘তুমি দিলে ওকে টাকাটা? ও তো একটা জোচ্চোর!’
‘তা মানি, কিন্তু লোকটার শত দোষ থাকলেও একটা গুণ ওর ছিল’ – কবিগুরু শান্ত স্বরে বললেন। ‘লোকটা সত্যভাষী। কথা রেখেছিল, চিরঋণী হয়েই রইল!’
সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) ছোট ভাই প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে বিশ্বভারতীতে পড়ার জন্য একদিন শান্তিনিকেতনে এলেন। শান্তিনিকেতনে এসে তিনি জানলেন, কবিগুরু নাকি কানে কম শোনেন। কথা বলার সময় যেন একটু জোরে বলেন। কবিগুরুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি তাঁর বড় ভাই (বনফুল)-এর দেওয়া পরিচয়পত্র দেখালেন। কবিগুরু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হে তুমি কি বলাই-এর ভাই কানাই নাকি?
উত্তরে বলাই-এর ভাই চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘না, আমি অরবিন্দ।’ কবি হেসে হেসে বললেন, ‘না, কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই।’
শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রীকে রবীন্দ্রনাথ একবার লিখে পাঠালেন, ‘আজকাল আপনি কাজে অত্যন্ত ভুল করছেন। এটা খুবই গর্হিত অপরাধ। এজন্য আগামীকাল বিকেলে আমি আপনাকে আমি দণ্ড দিব।’ গুরুদেবের এমন কথায় শাস্ত্রী মশাই তো একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এমন কী অন্যায় তিনি করেছেন যার জন্য তাঁর দণ্ডপ্রাপ্য? চিন্তিত ও শঙ্কিত শাস্ত্রী মশাই নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পরদিন উপস্থিত হলেন কবির কাছে। তখনো তাঁকে বেশ কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যেই বসিয়ে রাখেন কবিগুরু। অবশেষে পাশের ঘর থেকে একটি মোটা লাঠি হাতে আবির্ভূত হন রবীন্দ্রনাথ। শাস্ত্রী মশাই তখন ভয়ে কাণ্ডজ্ঞান লুপ্তপ্রায়। তিনি ভাবলেন, সত্যি বুঝি লাঠি তাঁর মাথায় পড়বে। কবি সেটি বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এই নিন আপনার দণ্ড! সেদিন যে এখানে ফেলে গেছেন, তা একদম ভুলে গেছেন আপনি!’
মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবী কবিগুরুকে বেশ কয়েক দিন ধরে নিরামিষ খাওয়াচ্ছিলেন। তো একদিন মৈত্রেয়ী দেবী কিছু খাবার নিয়ে এসে বললেন, ‘এটা একটু খাবেন?রোজ রোজ আপনাকে কি নিরামিষ খাওয়াব ভেবে পাই না।’ কবিগুরু বললেন, ‘ও পদার্থটা কি?’ মৈত্রেয়ী দেবীর উত্তর – ব্রেইন।’ কবিগুরু বললেন, ‘এই দেখ কাণ্ড, এ তো প্রায় অপমানের শামিল। কি করে ধরে নিলে যে, ওই পদার্থটার আমার প্রয়োজন আছে? আজকাল কি আর আমি ভালো লিখতে পারছিনে?’
কবিগুরু এক সভায় হঠাৎ গম্ভীরভাবে বলে উঠলেন, ‘এই ঘরে একটা বাঁদর আছে।’ সভাস্থ সকলে দারুণ অস্বস্তিভরে যখন একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছেন, তখন গুরুদেব মৃদু হেসে বললেন, ‘ডানদিকে যেমন একটি দোর আছে, বাঁ দিকেরও সেরকম আরেকটি দোর আছে।’ সকলে নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন।
একবার শান্তিনিকেতনে ওজনের একটি মেশিন ক্রয় করা হয় এবং এতে ছেলেমেয়েদের একে একে ওজন নেওয়া হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা লক্ষ করছিলেন। এক একজনের ওজন শেষ হলেই কবি তাঁকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘কিরে তুই কত হলি! এর মধ্যে একটি স্থুলকায় মেয়ে বলল, ‘দু’মন’। এই মেয়েটির সে সময় বিয়ের আলাপ চলছিল এবং কবি তা জানতেন । তাই তিনি পরিহাস করে বললেন, ‘তুই এখনো দু’মন, এখনো এক মন হলি নে?’
একদিন শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য এক প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের ফুটবল খেলা ছিল। শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোলে জিতে। সবাই দারুণ খুশি। তবে এ জয় দেখে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন ‘জিতেছে ভালো, তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে!’
একবার এক দোলপূর্ণিমার দিনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি, নাট্যকার ও গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাক্ষাৎ ঘটে। তো, পরস্পর নমস্কার বিনিময়ের পর হঠাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর জামার পকেট থেকে আবির বের করে রবীন্দ্রনাথকে বেশ রঞ্জিত করে দিলেন। আবির রঞ্জিত রবীন্দ্রনাথ রাগ না করে বরং সহাস্যে বলে উঠেন, ‘এত দিন জানতাম দ্বিজেন বাবু হাসির গান ও নাটক লিখে সকলের মনোরঞ্জন করে থাকেন। আজ দেখছি শুধু মনোরঞ্জন নয়, দেহরঞ্জনেও দ্বিজেন্দ্রলাল একজন ওস্তাদ।’
একবার রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী একসঙ্গে বসে সকালের প্রাতঃরাশ করছিলেন। তো গান্ধীজী লুচি পছন্দ করতেন না, তাই তাঁকে ওটসের পরিজ (Porridge of Oats) খেতে দেওয়া হয়েছিল। আর রবীন্দ্রনাথ খাচ্ছিলেন গরম গরম লুচি। গান্ধীজী তাই দেখে বলে উঠেন, ‘গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ।’ উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিষই হবে; তবে এর অ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবৎ এই বিষ খেয়েই বেঁচে আছি!’
একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটকের মহড়া চলছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় ছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো), আর জয়সিংহ সেজেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একটা দৃশ্য ছিল এমন, জয়সিংহের মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়বেন শোকার্ত রঘুপতি। দৃশ্যটার মহড়া চলছিল বারবার। দীনেন্দ্রনাথ বাবু ছিলেন স্থূল স্বাস্থ্যের অধিকারী। মহড়ায় বারবার তাঁর ভার বহন করা রবীন্দ্রনাথের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। একবার দীনেন্দ্রনাথ একটু বেকায়দায় রবিঠাকুরের ওপর আছড়ে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ কেঁকিয়ে উঠে বললেন, ‘ওহে দিনু, মনে করিসনে আমি সত্যি সত্যিই মারা গেছি!’
রবীন্দ্রনাথ একদিন এক সংগীতের আসরে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। তখন আসরে সংগীত পরিবেশন করছেন বিখ্যাত ধ্রুপদী গানের শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি তাঁর গান শুনে মুগ্ধ। গোপেশ্বরের গাওয়া শেষ হলে উদ্যোক্তারা রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে অনুরোধ করলেন, ‘গুরুদেব, এবার আপনাকে গান গাইতে হবে।’ সেদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ শ্রোতা হিসেবেই উপস্থিত ছিলেন। উদ্যোক্তাদের অনুরোধে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, গোপেশ্বরের পর এবার দাড়িশ্বরের পালা।’
একবার বেয়াইবাড়িতে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে কবিকে যথারীতি আপ্যায়ন করে একটি গদিমোড়া কেদারায় বসতে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রনাথ কেদারার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘ওহে, এটা সজীব নয় তো?’ চেয়ার আবার সজীব! সবাই ভাবলেন, রবীন্দ্রনাথ এ আবার কী বলছেন! চেয়ার বা কেদারা কাঠের তৈরি, জড় পদার্থ! তা আবার সজীব হয় নাকি? সবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এবার হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘অত ভাববার কী আছে? আমি বলছি – চেয়ারটা সজীব মানে ছারপোকা-টারপোকা ভর্তি নয় তো?’
সাহিত্যিক বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়, যাঁর ছদ্মনাম বনফুল, এক সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শেষ হলে সবাই তাঁর বলার প্রশংসা করলেন। সভায় উপস্থিত রবীন্দ্রনাথও তাঁর বক্তৃতার প্রশংসা করে বললেন, ‘একটা কথা আপনারা সবাই ভুলে যাচ্ছেন কেন – বলাই তো ভালোই বক্তৃতা দেবে, ওর নামই যে বলাই। বলাই তো ওর কাজ।’
সুনয়নী তাঁর রবিকাকাকে নাতনী (শিবানী- কবির কাকা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে গুণেন্দ্রনাথের কন্যা সুনয়নীর নাতনী) ও নাতজামাই দেখাতে নিয়ে এসেছেন। কবি তখন বাঁকুড়ায়। সন্ধ্যায় গানের আসর বসল। শিবানী গান গাইলেন। গান শুনে কবি খুশী হলেন। এরপর প্রতিদিনই শিবানী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ের কাছে গিয়ে বসতেন। প্রদৌহিত্রী হিসেবে শিবানীর সাহস এবং কৌতূহল একটু বেশিই ছিল। একদিন বলেই ফেললেন, ‘আচ্ছা দাদাভাই, আপনি কখনও প্রেমে পড়েছেন?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ গো নাতনি, তবে তা শুধু পড়াই হয়েছিল, ওঠা আর হয়ে ওঠেনি।’
একবার মৈত্রেয়ী দেবী গুরুদেবের কাছে বিয়ের গল্প শুনতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই। আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল। বৌঠানেরা বিয়ের জন্য জোরাজোরি শুরু করলে আমি বললাম, তোমাদের যা ইচ্ছা কর। আমার কোন মতামত নেই। … আমি কোথাও যেতে পারব না।’ শুনে মৈত্রেয়ী দেবী অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন আপনি বিয়ে করতেও যান নি?’ কবিগুরু ততধিক অবাক কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘কেন যাব? আমার একটা মান সম্মান আছে না?’
উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে কনের পিত্রালয়ে নয় জোড়াসাঁকোতেই হয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কবির পায়ে তেল মালিশ করা হতো। একদিন কবির দুই নাতনি গীতা ও দীপ্তি (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সরোজাসুন্দরী দেবীর ছোট মেয়ে) সেই দাবি নিয়ে কবির কাছে হাজির হলেন। কিন্তু কবির এতে বেজায় আপত্তি। রসিকতা করে বললেন, ‘তোরা সব আধুনিকার দল, আধুনিকারা যে কারুর পা টিপতে চায় তা জানতুম না। তাছাড়া তোদের সব শৌখিন পোশাক, যদি তেল লেগে যায়? তখন কাপড় হয়তো এদেশে কাচাতেই পারবি না, হয়তো আবার কাপড় কাচতে প্যারিস পাঠাতে হবে।’ নিষেধ সত্ত্বেও দীপ্তি কবির হাত ধরতেই কবি বললেন, ‘পাণি-পীড়ন তাহলে করবেই? তা কর। তারপর দীপ্তি যখন পা টিপতে শুরু করলেন তখন কবি বললেন, ওঃ এইবার পা নিপীড়ন করবে।’
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সক্রিয় ছিলেন। ফলে তিনি মোটেই সময় করে উঠতে পারতেন না। তারপরও নাটোরের মহারাজার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ এড়াতে পারলেন না। মহারাজা স্বয়ং বিয়ের দিন সন্ধ্যায় দ্বারে দাঁড়িয়ে নিমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনা করছিলেন। একটু তাড়াহুড়ো করেই কবি সেখানে উপস্থিত হলেন। কারণ আসতে দেরি হয়ে গেছে। মহারাজা কবিগুরুকে দেখেই অনুযোগ করে বললেন, ‘আমার কন্যাদায়, কোথায় আপনি সকাল-সকাল আসবেন, তা না এসে এলেন দেরিতে।’ কবি বললেন, ‘রাজন, আমারও যে মাতৃদায়, দু’জায়গায় সভা করে আসতে হলো।’
শান্তিনিকেতনের জন্য টাকা প্রয়োজন। উপস্থিত অনেকেই গুরুদেবকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। সবার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। হঠাৎ গুরুদেব বলে উঠলেন, ‘আহা তোমরা এত ভাবছ কেন? টাকা পাবার একটা অতি সহজ উপায় আছে।’ সবাই কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী সে উপায়?’ গুরুদেব এবার রানী চন্দকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে সবার দিকে ফিরে বললেন, ‘মাত্র সোয়া পাঁচ আনা খরচ।’ আসল ঘটনা হলো, রানী চন্দ একবার খুব আগ্রহ নিয়ে গুরুদেবকে মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতের কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, এই ব্রত করলে নির্ধনেরও ধন হয়। এবং খরচও বেশি নয়, মাত্র সোয়া পাঁচ আনা। সেই থেকে গুরুদেব যখনই আশ্রমের জন্য অর্থ কষ্টে পড়তেন তখনই ঠাট্টা করে বলতেন, ‘তা নন্দলাল, ভাবছ কেন এত? মাত্র তো সোয়া পাঁচ আনার মামলা।’
গুরুদেবের চোখের সমস্যা দেখা দিয়েছে। রানী চন্দ চোখের ড্রপটা আনতেই তিনি চেয়ারে মাথা উপরের দিকে হেলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘এসেছ তুমি আমার অশ্রুপাত করাতে। আমার চোখের জল ফেলিয়ে তুমি কী সুখ পাও, বলো দেখি।’ চোখে ওষুধের ফোঁটা পড়তেই তিনি শিউরে উঠলেন। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘চমক লাগিয়ে দেয় গো, চমক লাগিয়ে দেয়।’ বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে রানী চন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রূপে নয়, ওষুধের জ্বালায়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ফটোগ্রাফ, সেখানে কবির মুখে আলো-ছায়ার খেলা। ফটোগ্রাফটি হাতে নিয়ে কবি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার এই ফটোটায় ওরা কেউ কেউ বলে রোদ্দুর পড়ে এমনি হয়েছে। তাই কি! আমি বলি ও আমার জ্যোতি ফুটে বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। এ কি আর সবার ছবিতে হয়।’ কবির কথা শুনে সেক্রেটারি শ্রী অনিলকুমার চন্দ গর্বের সঙ্গে জানালেন, ‘জানেন আমার ফটো তুলে শম্ভুবাবু বিদেশে কম্পিটিশনে প্রাইজ পেয়েছেন।’ গুরুদেব এবার চোখ কপালে তুলে আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘বটে! এটা প্রাইজ না হোক, আমার কাছে সারপ্রাইজ তো বটেই!’
লেখকঃ রানা চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র –
১- বঙ্গ মনীষীদের রঙ্গ রসিকতা, অংশুমান চক্রবর্তী।
২- মনীষীদের রঙ্গ-রসিকতা, সফিয়ার রহমান, কাকলী প্রকাশনী।
৩- মনিষীদের রসিকতা, শৈলেশ্বর মুখ্যোপাধ্যায়, রায় প্রকাশন।