ফুটফুটে এক মেয়ের জন্ম হলো হিন্দাল মির্জার ঘরে, নাম তার রুকাইয়া সুলতানা বেগম। চাগতাই পরিবারের সন্তান, হিন্দাল মির্জার একমাত্র মেয়ে এবং প্রথম মোঘল সম্রাট বাবরের নাতনি তিনি। তাঁকে প্রকৃত তুর্কি রাজকন্যা হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অপরদিকে হিন্দাল মির্জার সৎভাই হুমায়ুনের ঘরেও আশীর্বাদ হয়ে জন্ম হয় আকবরের । এই দুই পরিবারের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক তৈরি হবে তা হয়তো বিধাতা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন।
২০ শে নভেম্বর ১৫৫১ সাল, সৎ ভাই হুমায়ূনের পক্ষে, কামরান মির্জার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করেন এক বীর সৈনিক… তিনি আর কেউ নয়, প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের ছোট ছেলে হিন্দাল মির্জা । ভাইয়ের মৃত্যু হুমায়ূনকে প্রচন্ড ভাবে আবেগতাড়িত করে ফেলে। নরম মনের হুমায়ূন বাদশা অনুশোচনায় বার বার বলতে থাকে, ” মৃত্যু পথযাত্রী বাবার কথা তিনি রাখতে পারেন নি, বাবা তাঁকে মৃত্যুশয্যায় বলে গিয়েছিলেন ভাইদের সাথে সদ্ভাব রাখতে ” । ভাবাবেগে যখন ভেঙ্গে পড়েছিলেন তখন তার সৈন্য বাহিনী তাঁকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলেন, ‘ সম্রাটের জন্য জীবন দিতে পারা তো ভাগ্যের ব্যাপার… তিনি তো শহীদ হবেন ‘ । ভাইয়ের প্রতি দায়িত্ববোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ , ভালোবাসা থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন হিন্দালের মেয়ের দায়িত্ব আজ থেকে তাঁর। নিজের ছেলে আকবরের সাথে হিন্দালের মেয়ের বাগদান সম্পন্ন করেন আফগানিস্তানের কাবুলে। কতো আর তার বয়স তখন, মাত্র ৯ বছর। ওদিকে আকবর সবে গাজনীর ভাইসরয় হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। হিন্দালের জায়গির ছিলো এই গাজনী । বাগদানের মাধ্যমে তার হবু স্বামীর কাছেই আসলো তার বাবার সমস্ত সম্পদ। তাই তার বাবার সকল সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্বও দেয়া হলো তাঁকে। মোঘল রাজকন্যা , হিন্দালের অত্যন্ত আদরের একমাত্র মেয়ে ,হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মেয়ের নামের সাথে মিল রেখে তাঁর নাম রাখা হয় রুকাইয়া সুলতানা। অত্যন্ত শক্তিশালী রাজবংশের রক্ত তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত। খুব চৌকস ও শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তা আর লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। আর হবেইবা না কেনো , গুলবদন বানু তাঁর একমাত্র ফুপু। ‘গুলবদন’ প্রথম মোঘল সম্রাট বাবরের মেয়ে, আর তিনিই একমাত্র নারী যিনি হুমায়ুনের আত্মজীবনী নিজ হাতে রচনা করেছেন l অত্যন্ত সাহসী, যোগ্য একজন মহিলা l আর এরাই ছিলেন তাঁর আদর্শ ও পথ প্রদর্শক।
হুমায়ুন হঠাৎ করেই তাঁর লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে মৃত্যু বরণ করেন। ১৫৫৬ সালে শুরু হয় আরেক রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তা, রুকাইয়া সুলতানা তখন রাজপরিবারের অন্যান্যদের সাথে কাবুলে। সবাই চিন্তা করলো এখন সবার একসাথে থাকার সময়, বিপদে পাশে থাকার সময়….তাঁর হবু শাশুড়ী হামিদা বানু বেগম, ফুপু গুলবদন বানুসহ আরও অনেক মহিলা মিলে শুরু করেন তাদের আরেক যাত্রা। গন্তব্য তাদের লাহোর…..সেখানে আছে তার হবু স্বামী আকবর। এখন তার বয়স ১৫ বছর এবং রুকাইয়া সুলতানার ১৪ বছর। তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাদের কাজ শুরু হলো। প্রায় ৪ মাস এখানে থাকলেন তাঁরা….রাজকীয় তাঁবু, ঘোড়া, উট সব তৈরি। স্বামীর অল্প বয়স, শ্বশুড়ের অকাল মৃত্যু সব মিলিয়ে এ যেনো এক অজানা আশঙ্কা….. কিন্তু এ বার তো তাদের যেতেই হবে দিল্লিতে, নিজেদের স্থায়ী ঠিকানায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন আর ১৪ বছর বয়সেই রুকাইয়া সুলতানা হলেন মোঘল সম্রাজ্ঞী। আকবরের প্রথম স্ত্রী হাওয়ায় তিনি ছিলেন সবার দ্বারা অত্যন্ত সম্মানিত।
মোঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাট ও পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা “আকবর দি গ্রেট”। আকবর পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট, তার জন্য তো তেমনই একজন জীবনসঙ্গীনী লাগবে… আর রুকাইয়া সুলতানা বেগম ছিলেন ঠিক তেমনি একজন উপযুক্ত স্ত্রী। যার শিক্ষা, জ্ঞান, যোগ্যতা তার সমসাময়িক মহিলাদের থেকেও অনেক বেশি ছিলো । আর কেনইবা হবে না, তার বাবা হিন্দাল মির্জা ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষিত, এমনকি তিনি কবিও ছিলেন । এ সকল গুণই তার মেয়ে রুকাইয়া সুলতানার মধ্যে চলে এসেছিলো। ঐ সময় চাগতাই পরিবারের মেয়েদের শিক্ষার ওপর ভীষণ গুরুত্ব দেয়া হতো, যার ফলেও রুকাইয়া সুলতানা অত্যন্ত শিক্ষিত ও জ্ঞানী ছিলেন। এছাড়াও মোঘল হারেমের অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মহিলা ছিলেন তিনি, তিনি যতোদিন বেঁচে ছিলেন আকবরের এক নাম্বার ও প্রধান স্ত্রী হয়েই বেঁচে ছিলেন। এবং দেখা গেছে তাঁকে মোঘল রাজকন্যা হিসেবেই বিবেচিত করা হতো । সে সময় মোঘল মহিলাদেরকে হারেমের মধ্যেই থাকতে হতো কিন্তু রুকাইয়া সুলতানার ক্ষেত্রে ছিলো এর ব্যতিক্রম। তাঁকে হারেমের বাইরে প্রাসাদে থাকার জন্যেও সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল । এমনকি মোঘল হেরেমের কর্ত্রী ছিলেন তিনি, আর হারেমের পরিচালনা করা কোনো মুখের কথা নয়। অবশ্যই তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা ছিলো, যার ফলে এই ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন । সাম্রাজ্যের মধ্যে এক সাম্রাজ্য পরিচালনা, যা একজন যোগ্য সাম্রাজ্ঞীই দক্ষতার সাথে পালন করতে পারে…..আর তিনি তাই ছিলেন ! হ্যা,তিনিই ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্য এর সবচেয়ে বেশি সময় কাল জুড়ে থাকা প্রধান রানী। তিনি ৪৯ বছর ধরে সম্রাট আকবরের প্রধান রানী ও সর্বোচ্চ সম্মানিত স্ত্রী ছিলেন ।
এতোকিছু যার ছিলো তারপরও তাঁর চেহারা কেনো হতাশায় কালো? কিসের এতো দুঃখ তাঁর ? আকবর তো তাঁকে বন্ধুর মতো ভালোবাসতো, তাঁর সকল চাওয়া পূরণ করতো। তবে কেন এই দুঃখ? এর কারণ তিনি আকবরকে কোনো সন্তান উপহার দিতে পারেননি। মোঘল সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তৈরিতে সবচেয়ে বড় যে শক্তি সেটাই তিনি দিতে পারেননি। আকবর সেটা উপলব্ধি করতে পারতেন….তিনি ভেবেছিলেন কোনো না কোনো সময় এর সমাধান তিনি অবশ্যই বের করবেন। সময় এসেও গেল l খুররামের জন্মের ঠিক আগে, একজন গণক রুকাইয়া সুলতানা বেগমকে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, রুকাইয়া সুলতানার হাতেই মোঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট বড় হবে। ঠিক তখনই খবর পেলেন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা। তখন আকবর ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলেন, এই সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব হবে রুকাইয়া সুলতানার। আর এ সিদ্ধান্তের থেকে হারেমে রুকাইয়ার পদমর্যাদা এবং ক্ষমতা কতোটা ছিলো তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
একদিন আকবর এসে রুকাইয়া সুলতানাকে বললো, ” তোমার চিন্তা দূর করেছি, দেখো তোমার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছি….জাহাঙ্গীরের সন্তান হবে তোমার, তুমি লালন পালন করবে তার ” । বিমর্ষ রুকাইয়ার মুখে আনন্দের ছটা বয়ে যায়, রুকাইয়া যেনো তার জীবনের অর্থ খুঁজে পায়। তিনি নতুন করে মা হলেন এবং আর দশটা সাধারন মায়ের থেকে তাঁর মমত্ববোধ যেনো অনেক বেশি। কারণ একজন নিঃসন্তান মা যখন একটা সন্তান বুকে পায়, তখন তার সমস্ত ভালোবাসা ও মনোযোগ থাকে ওই সন্তানের উপর…. তিনিও তাই করতেন। তিনি খুররামের শিক্ষার তদারকি থেকে শুরু করে সকল কিছুই নিজে করেছেন । খুররাম (সম্রাট শাহজাহান) প্রায় ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর সাথেই ছিলেন এবং একান্ত নিষ্ঠার মাধ্যমে শাহজাদা খুররামকে একজন যোগ্য রাজপুত্র হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। জাহাঙ্গীর তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, ” আমি নিজেও আমার সন্তানকে এভাবে লালন-পালন করতে পারতাম না যেভাবে রুকাইয়া সুলতানা বেগম করেছেন ” ।
রুকাইয়া সুলতানা মুঘল দরবারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন এবং আকবরের উপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। সেই যে ১৫৫৭ সালে, রুকাইয়া সুলতানা ভারতে এসে পাঞ্জাবে আকবরের সাথে যোগ দেন, আকবরের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার বন্ধু হিসাবে পাশে থাকেন l তার ক্ষমতা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে কি কমেছিল? না l রুকাইয়া সুলতানা এবং সালিমা সুলতানা বেগম ক্ষমতার অধিকারী খান-ই-আজমকে সমর্থন করার ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন । এর পর বর্ধমানের যুদ্ধে মেহের-উন-নিসার স্বামীকে হত্যা করা হলে, মেহের-উন-নিসা ও তার মেয়ে লাদলি বেগমের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য রুকাইয়া সুলতানার কাছেই রাখা হয়। মেহের-উন-নিসা ও তার মেয়ে লাদলি বেগম রুকাইয়ার কাছে প্রায় ৪ বছর ছিলেন। রুকাইয়া সুলতানা এবং মেহের-উন-নিসার মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, এ সময় রুকাইয়ার সংস্পর্শে মেহের-উন-নিসার ব্যক্তিগত গুনাবলি আরও বিকশিত হয়েছিল। মেহের-উন-নিসার (নূর জাহান) প্রতি ছিলো তাঁর অত্যন্ত স্নেহ ; তিনি তাকে অন্যের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।
তাঁর সৎ ছেলে জাহাঙ্গীর তথা খুররামের বাবা’র দ্বারাও তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন । আকবর ও জাহাঙ্গীরের সাথে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিলো রুকাইয়ার চেষ্টার বলেই তা অনেকাংশে কমে গিয়েছিলো। জাহাঙ্গীর একবার তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয় উঠেছিল, তখন তিনিই সেটা মিল করিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও জাহাঙ্গীর তার বাবার বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু’ল ফজলকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পরিস্থিতি খুবই সমালোচনামূলক হয়ে ওঠে এবং আকবর এতোটাই ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে কেউই জাহাঙ্গীরের পক্ষে কিছু বলার সাহস করে নি। শেষ পর্যন্ত, রুকাইয়া সুলতানা বেগম এবং সালিমা সুলতানা বেগম এ ব্যাপারে তার ক্ষমা প্রার্থনা করিয়েছিলেন। আকবর তাদের ইচ্ছা মেনে নেয় এবং জাহাঙ্গীরকে সম্রাটের সামনে হাজির করার আদেশ দেন। অবশেষে জাহাঙ্গীরকে আকবরের কাছে এনে তার সৎ মা রুকাইয়া সুলতানা বেগম ও তাঁর দাদী হামিদা বানু বেগমের প্রচেষ্টায় ১৬০৩ সালে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে মিল করিয়ে দেয়া হয়।
১৬০৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আফগানিস্তানের দক্ষিণপশ্চিমে বাবুর (বাগ-ই-বাবুর) উদ্যানে তাঁর দাদার কবরের পাশেই তাঁর কবর দেয়া হয়। সেখানে তাঁর দাদা প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের পাশাপাশি তাঁর বাবা হিন্দাল মির্জারও চূড়ান্ত বিশ্রামস্থল। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহ জাহানের ( খুররাম) আদেশে তাঁর সমাধিটি নির্মিত হয়েছিলো। যেহেতু খুররাম ও জাহাঙ্গীরের সাথে ছিলো তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসার সম্পর্ক….খুররাম ও জাহাঙ্গীর দু’জনই তাঁর কবরটাকে অত্যন্ত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি খুররাম নিজে রুকাইয়া সুলতানার কবরটাকে বিশেষ যত্নের সাথে দেখভাল করতেন । তিনি ১৬৪৫-৪৬ সালে কবরের পাশে একটি ছোট মসজিদ এবং বাগানের কেন্দ্রীয় অক্ষের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির চ্যানেল র্নির্মাণ করেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, তিনি কতোগুলো দক্ষ শাসনকর্তা তৈরি করেছেন…. তিনি জাহাঙ্গীরকে তৈরি করেছেন, তার মধ্যে কোমলতা দিয়েছেন… তিনি খুররামকে তৈরি করেছেন, যাকে সমস্ত পৃথিবী সম্রাট শাহজাহান হিসেবে চিনে। এছাড়াও তিনি মেহেরুন্নেসাকে আশ্রয় দিয়ে কঠিন পৃথিবীতে নির্বিঘ্নে চারটা বছর বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যিনি জাহাঙ্গীরের স্ত্রী হিসেবে, মোঘল সম্রাজ্ঞী হিসেবে, নূর-জাহান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, হয়তো সেক্ষেত্রেও রুকাইয়া সুলতানার শিক্ষা কাজ করেছিল। এসমস্ত শক্তিশালী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী গুলোকে সবার সামনে তুলে ধরতে আমাদের চেষ্টা চলছে এবং আরও চলবে।