প্রাকৃতিক সম্পদ সবসময় একটি দেশের জন্য শান্তি নিয়ে আসে না। অনেক ক্ষেত্রে অশান্তির দুয়ার উন্মোচন করে। এমনই এক দুর্ভাগা দেশ নাইজেরিয়া। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে এ দেশে প্রথম প্রাকৃতিক তেল আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে এ দেশে তেলকে ঘিরে চলছে গৃহদাহ! ভাবুন একবার, পৃথিবীর অন্যতম বড় তেল উৎপাদক রাষ্ট্রে বাস করে আজ পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র মানুষ!
তেলের জন্যই দেশটা হয়ে উঠেছে তেল চোর আর বিদ্রোহীদের অভয়ারণ্য। তেল মাফিয়ারা হয়ে উঠেছে এ দেশের ভাগ্যবিধাতা। এদের হাতেই রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে দুর্নীতি। অবৈধ তেলের জন্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নাইজেরিয়ার ব-দ্বীপে অবস্থিত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ যেন কালো সোনার কালো যাদুতে আক্রান্ত একটা দেশ!
প্রাচীনকাল থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনের জন্য সুখ্যাতি ছিল নাইজার নদীর উপকূলের অধিবাসীদের। তেল আর কৃতদাসের লোভে এ অঞ্চলে ইউরোপিয়রা আসে। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের সুযোগে ব্রিটিশরা নাইজেরিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে। পাম তেল ও তুল উৎপাদনের জন্য নাইজেরিয়াকে তারা ব্যবহার করে। কৃষি সম্পদের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার নাইজেরিয়ায় ব্রিটিশরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগের দারুণ অবকাঠামো গড়ে তুলেছিল। শিক্ষিত একটা চটপটে প্রজন্মও তৈরি হয়েছিল। ১৯৬০ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় নাইজেরিয়া। কিন্তু এর আগেই আবিষ্কৃত হয় নাইজার নদীর অববাহিকায় বিপুল তেল সম্পদ। এই তেলই হয়ে ওঠে নাইজেরিয়ার জন্য কাল।
ব্রিটিশ আমল থেকে তেল অনুসন্ধানের কাজ করে আসছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এখনো নাইজেরিয়ার তেল সম্পদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব মোবিল, টেনেকো, গালফ ওয়েল, শেল, এলিপ, এগিপ, শেভরনের মতো কোম্পানিগুলোর। তেল থেকে প্রাপ্ত লাভের বেশির ভাগই চলে যায় বিদেশে। নাইজারিয়া সরকার যা পায় তার একটা বড় অংশ আমলা আর রাজনীতিকরা লুট করে নেয়। ফলে পৃথিবীর ৭ম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার পরও নাইজেরিয়ার ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। ২০০০ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায় দেশটির রপ্তানি আয়ের ৯৮ শতাংশ আসে তেল থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয়েরও প্রধান উৎস ৮৩ শতাংশ প্রাকৃতিক তেল। নাইজেরিয়ার জিডিপির ১৪ শতাংশ আসে তেল থেকে। তেলের প্রতি অতিনির্ভরতার কারণে এখানে অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ঘটেনি।
আফ্রিকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে ২০ কোটি মানুষ বাস করে। এর ৬৬ ভাগই ৩৫ বছরের নিচে। চীন ও ভারতের পর সবচেয়ে বেশি তরুণ এ দেশে। ফলে সবচেয়ে বেশি ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পাওয়ার কথা দেশটির। কিন্তু সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের সুযোগ নেই। নাইজেরিয়ায় বেকারত্বের হার ১৬.৫ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশে ৪.৪ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি রপ্তানি আয় দেশটির। বাংলাদেশের চেয়ে ১০ গুণ বেশি বিদেশি বিনিয়োগ সেখানে। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় সামান্য বেশি। এ অর্থ যায় কই?
যুবকরা দেখছে তাদের দেশ থেকে বিদেশি কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ডলারের তেল নিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও আমলারা তেলের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠছে। অথচ তাদের কর্মসংস্থান নেই। তাদের গ্রাম-গঞ্জে ন্যূনতম নাগরিক সেবা নেই। তাদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বাঁধে। নাইজেরিয়ার রয়েছে ২৫০ উপজাতি। তারা ৫০০-র অধিক ভাষায় কথা বলে। এসব উপজাতি যুবকদের মধ্যে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বিদ্রোহী দল। এদের আয়ের প্রধান উৎস পাইপ লাইন লিক করে তেল চুরি, পরিশোধন এবং তেল কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশি শ্রমিক ও কর্মচারীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি আদায় করা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ তো আছেই। ফলে যে যুবগোষ্ঠী নাইজেরিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনের কথা তারাই হয়ে উঠেছে ঝুঁকির কারণ।
নাইজেরিয়া প্রতিদিন ২.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। ধারণা করা হয় এর ২০ শতাংশ পাইপ লাইন ফুটো করে স্থানীয় লোকজন নিয়ে যায়। বছরে এই তেলের দাম প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ টাকা যায় কোথায়? এ টাকা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর হাতে এলে তো এতো বিপুল পরিমাণ দরিদ্র মানুষ এদেশে থাকত না। এই তেল চুরির সঙ্গে সরকারের সব স্তরের লোক জড়িত। এমনকি রাজনীতিকরাও। এরা বিপুল পরিমাণ অর্থ এখান থেকে পায়। এদের আয়কৃত টাকা বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়।
পাইপ লাইন থেকে তেল চুরি করার কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে মাটিতে ও পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ে। যা নাইজেরিয়া ব-দ্বীপের প্রাণ-প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় অবৈধভাবে এ তেল পরিশোধন করতে গিয়ে। বড় বড় তেলের ট্যাংকারে তেল নিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে পেট্রল পৃথক করা হয়। পেট্রল সংগ্রহের পর খনিজ তেলের বাকি অংশ মাটি ও পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফসল হচ্ছে না। নদীর উপর তেল ভেসে বেড়ায়। মাছ মারা যায়। কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি ও মৎস শিকারের উপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠী তাই বেকার হয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে দারিদ্র্য।
এদিকে সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্য তেল কোম্পানিগুলোও নাইজেরিয়ার প্রতি এখন আর আকৃষ্ট হচ্ছে না। সৌদি আরবের চেয়ে দশ ভাগের এক ভাগ দামে তেল দিয়েও তেল কোম্পানিগুলোকে আটকে রাখতে পারছে না দেশটি। কারণ তেল উৎপাদন ও নিরাপত্তা খরচ এখানে অনেক বেশি। কোম্পানিগুলো গুইনিয়া উপসাগরের অন্যান্য দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। ফলে নাইজেরিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যায়। ২০১৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। ১৭ সালে ছিল ১ শতাংশেরও কম।
২০০৯ সালে মৎস্য পোতাশ্রয়ভিত্তিক শহর বোবোতে তেল লাইন থেকে দুটো মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। শেল কোম্পানির পাইপ লাইন ফুটো হয়ে পড়ায় বোবো শহরে তেল ছড়িয়ে পড়ে। আশেপাশের নদীতেও তেল ভাসতে থাকে। তেলের কারণে লোকজন বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। নদীর মাছ মরে যায়। ফসল নষ্ট হয়। এর জন্য তেল কোম্পানি নগরবাসীকে মাত্র ৪ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। পরে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হস্তক্ষেপে এ নিয়ে মামলা হয়। মামলায় শেল হেরে গিয়ে ৫৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়।
এভাবে যে সম্পদ একটা জাতির সমৃদ্ধির কারণ হওয়ার কথা ছিল, সেই সম্পদ একটা দেশের মাটি, পানি এমনকি জনগোষ্ঠীকে বিষাক্ত করে তুলছে। সম্পদই হয়ে উঠেছে নাইজেরিয়ার বড় বিপদের কারণ।
সূত্র: ‘Curse of the Black Gold: 50 Years of Oil in the Niger Delta’, edited by Michael Watts, www.independent.co.uk, www.reuters.com, africanarguments.org, www.amnesty.org