কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রিটা দেখার ইচ্ছা ছিলো, কারন এখানে সত্যজিৎ রায়ের ‘ গোরস্তানে সাবধান’ ছবিটির শুটিং হয়েছিলো।

পরে এই সেমিট্রি সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে পড়েছি। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম নন-চার্চ সেমিট্রিগুলির মধ্যে একটি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সম্ভবত এটিই ছিল ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে খ্রিস্টানদের বড় সেমিট্রি।

সেখানে প্রচুর মার্বেল করা সমাধি আছে, কিছু কিছু সমাধির মার্বেল ভেঙ্গেও গেছে। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম, এপিটাফ পড়ে দেখলাম সে সময়ের বেশিরভাগ মানুষগুলি খুব কম বয়সে প্রয়াত হয়েছেন।

হেনরী লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও তেমন একজন, যিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে মারা গেছেন, কিন্তু সেইটুকু সময়ের মাঝে তিনি রেখে গেছেন তার অসামান্য কীর্তি।

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও

মাত্র ১৪ বছর বয়সে ডিরোজিও শিক্ষা জীবন শেষ করে কাজে যোগ দেন। তার বাবা যে কোম্পানিতে কাজ করতেন সেখানে কাজ নেন।

কিন্তু বেশিদিন এইকাজ ভাল না লাগায় তরুণ হেনরী লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও মাত্র সতেরো বছর বয়সে কলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষক হন। তিনি নিজেকে আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালিই ভাবতেন।

ছাত্রদের সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ছিল খুব কম। কেউ কেউ ছিলেন তার সমবয়সী। তার পাণ্ডিত্য ও মেধার জন্যই হিন্দু কলেজের খ্যাতি ও গৌরব বেড়েছিল।

কিছু  গবেষক মনে করেন ডিরোজিওর জনপ্রিয়তাই তার পতনের কারণ। তার প্রত্যক্ষ ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব, দিগম্বর মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র বসাক। তেমনই হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রশিককৃষ্ণ মল্লিক।তিনি ছাত্রদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘friend philosopher and guide’।

বহু যুগের কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এই সমাজে তিনি ঝড় তুলেছিলেন। একাধারে শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক এই মানুষটি তাঁর উপলব্ধি আর কর্মোদ্যমে বদলাতে চেয়েছিলেন সমাজটাকে।

এর বদলে তার কপালে জুটেছিল অপমান, তাচ্ছিল্য আর দারিদ্রতা। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক অবিস্মরণীয় নাম হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও।

হেনরির জন্ম ১৮০৯-এর ১৮ এপ্রিল কলকাতার মৌলালি অঞ্চলে এক ইউরেশীয় পরিবারে। তাঁর বাবার নাম ফ্রান্সিস, মা সোফিয়া। মাত্র ছ’বছর বয়সে তার মা মারা যান, বাবা আনা মারিয়া নামে এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেন। আনার নিজের সন্তান ছিলোনা তাই তিনি তাদের নিজের সন্তানের মতোই দেখতেন।

ভারতের ডাক টিকেটে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও

তখন সমাজের নিপীড়িত সম্প্রদায়ের জন্য কিছু কিছু পেশায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, সরকারি স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ মিলত না এই সম্প্রদায়ের মানুষের। তিনি জানতেন এ সব বিষয়ে আন্দোলনের পথে কোনও রকম সংকীর্ণতা বা ধর্মান্ধতা কিংবা কোন বিভেদকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আর হয়তো এই কারণেই সে কালের সবচেয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক জন মানুষ হয়েও হিন্দু সমাজে আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন। রক্ষণশীল খ্রিস্টান এবং হিন্দুরা নানা ভাবে তার বিরোধিতা করলেও তাকে উপেক্ষা করতে পারেননি।

তার কবিতা রচনায় প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেটে’-এর সম্পাদক ডক্টর জন গ্রান্ট। ডিরোজিও ‘জুভেনিস’ ছদ্মনামে লিখতেন। ১৮২৮-য় প্রকাশিত হয় ‘দ্য ফকির অফ জঙ্ঘীরা, এ মেট্রিকাল টেল; অ্যান্ড আদার পোয়েমস’। এর পাশাপাশি চলতে লাগল তার নিজের পড়াশুনা। ধীরে ধীরে তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।

১৮২৬ সালে তিনি কলকাতায় দু’টি চাকরি পেয়েছিলেন। প্রথমটি ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেটে’-এর সহ সম্পাদক হিসেবে, দ্বিতীয়টি হিন্দু কলেজে শিক্ষকতার।কারও মতে তিনি দু’টি চাকরি এক সঙ্গে কিছুদিন করেছিলেন।

তখন শুরু হয় পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরোধ।ভারতীয় হয়েও তিনি রক্ষণশীল হিন্দুর কাছে বিধর্মী এবং খ্রিস্টান হয়েও ইউরেশীয় হওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর সাহায্য পাননি।

১৮৩১-এর ২৩ এপ্রিল কলেজের পরিচালন সমিতির বিশিষ্ট সদস্যরা কলেজে এক বিশেষ সভায় মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে দেখা গেল উপস্থিত ব্যক্তিরা ডিরোজিওর শিক্ষার কুফল বিষয়ে নিশ্চিত নন। তাই একটি প্রস্তাব রাখা হল জনসাধারণের বর্তমান মনোভাব বিবেচনা করে ডিরোজিয়োওকে বরখাস্ত করা সময়োচিত কিনা। তাদের  মধ্যে চন্দ্রকুমার ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন জানিয়েছিলেন তাকে বরখাস্ত করা প্রয়োজন।

অধ্যাপনার কাজটা চলে গেলেও থেমে যায়নি তার জীবন সংগ্রাম, এরমধ্যেই চলতে থাকে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ।ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার লেখালেখিও থামান নি।

ডিরোজিও’র সমাধি

পত্রিকার ব্যায়ভার মিটানোর জন্য তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের লাইব্রেরির সব বইপত্র এবং দামী আসবাবপত্র। শেষের দিনগুলিতে তাকে পড়তে হয়েছিল নিদারুণ অর্থাভাবে।

১৮৩১-এর ১৭ ডিসেম্বর ডিরোজিও ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। সে দিনই তিনি কলেরায় আক্রান্ত হন। সে সময় রোগটি ছিল দুরারোগ্য। তাঁর অন্তিম কালে তার পাশে মা ও বোন ছাড়া ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, জন গ্রান্ট। ২৬-এ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয় এবং সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রিতে তাকে সমাহিত করা হয়।