সিলেট, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো এই জেলা। জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলং এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, ভোলাগন্জের সারি সারি পাথরের স্তূপ, পাথরের বিছানাখ্যাত বিছনাকান্দি, রাতারগুল জলাবন পর্যটকদের টেনে আনে বার বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেট জেলাকে ভেঙ্গে চারটি জেলায় ভাগ করা হয় । বর্তমানে সিলেট জেলা ১২ টি উপজেলা নিয়ে গঠিত।
১৭৬৭ সালে এ অঞ্চল ব্রিটিশদের অধীনে যাবার পর, ১৭৭২ সালে সিলেট জেলার সৃষ্টি হয় এবং প্রথম কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান মিষ্টার উইলিয়াম থ্যাকারে।
সে সময় সিলেটের দ্রুত বিকাশ হয়। সিলেটে ১৮৭৮ সালে পৌরসভা গঠন করা হয় । ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্পে পুরা সিলেট শহরটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ধ্বংসস্তুপের ওপর তৈরি করা হয় ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর ও আধুনিক শহর। ১৮৯০ দশকের শেষ দিকে বেশ কিছু রাস্তাঘাটও তৈরি করা হয়। ১৯১২-১৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি শাখা সিলেটের সাথে যুক্ত হলে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সিলেটের যোগাযোগ ব্যাবস্থা সহজ হয়ে যায়।
খ্রীষ্টাব্দ আট শতকের মাঝামাঝি সিলেট বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ ত্রিপুরা রাজ্যের এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের অনেক অংশ হরিকেল (ত্রিপুরার শৈলশ্রেণির সমান্তরাল অঞ্চল সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হরিকেল বিস্তৃত) রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাদ-বাকি অংশে সিলেটের প্রাচীন রাজ্য জয়ন্তীয়া, লাউড় ও গৌড় বিস্তৃত ছিল। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহ জালাল সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সুলতানী আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ।
এবারে আসি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়র আবিষ্কারের কথায়—-
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নসম্পদের খোঁজে জুড়ীতে আসেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা, সিলেটের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও এখানকার পুরাকীর্তি অনুসন্ধানে মাঠে নামে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটি। জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিরপাড় এলাকায় প্রাচীন চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নসম্পদ আছে বলে ধারণা করা হয়।
চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র দশম দশকের মাঝামাঝি ৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল গ্রামে ‘চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে পড়ানো হতো চতুর্বেদ, চান্দ্র ব্যাকরণ, হিন্দু শাস্ত্রবিদ্যা, হেতু বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, ধাতু বিদ্যা, শব্দ বিদ্যাসহ নানা বিষয়।
সে হিসেবে এটি অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজের আগের বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে। আর ১২০৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। সেই হিসাবে ‘চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ।
বিভিন্ন লেখার সূত্র দিয়ে স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন রাজা শ্রী চন্দ্র দশম শতকের প্রথম দিকে আনুমানিক ৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে সম্পূর্ণ রাজকীয় আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিশাল এই বিদ্যাপীঠটি তখন গড়ে উঠেছিল। প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচন্দ্র প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে ৪০০ পাটক জমি (১ পাঠক=৫০ একর বা ১৫০ বিঘা) বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ করেছিলেন। কালের বিবর্তনে এটি হারিয়ে গেলেও সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আগ্রহ আর আলোচনার। বিষয়টি জানতে পেরে নড়েচড়ে বসেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরী তার বিখ্যাত ‘Copper plates of Sylhet’ বইয়ে পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এবং তাম্রশাসন সর্ম্পকিত তার লেখা কিছু প্রবন্ধে জুড়ীতে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। লেখক সুজিত চৌধুরী তার ‘শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস’ এবং নীহার রঞ্জন রায় তার ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)’ বইয়ে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু তথ্য সংযোজন করেছেন।
মো. জহিরুল হক ও বায়োজিত আলম ‘প্রাচীন সিলেটের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় একটি ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা’ শিরোনামে একটি গবেষনামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোজাম্মেল হক বলেন, সিলেটের পশ্চিমভাগে শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্য ছিল। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শ্রী চন্দ্রের শাসনামল ছিল ৯০৫-৯৫৫ সাল পর্যন্ত। তার সাম্রাজ্যভুক্ত এলাকার মধ্যে ছিল মানিকগঞ্জ, ঢাকা ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট অঞ্চল ও কুমিল্লা। যার রাজধানী ছিল বিক্রমপুর’। এসব লেখা পড়ে জানা যায় যে, দশ শতকের প্রথম ভাগে উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে মনু নদী এবং পূর্বে ইন্দেশ্বরের পাহাড়ি অঞ্চল বা পাথরিয়া অঞ্চল, এই সীমানার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত ছিল।
এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিরপাড় এলাকার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কোনো এককালে এখানে বড় শিক্ষাঙ্গন ছিল বলে জনশ্রুতিও রয়েছে। এছাড়াও দীঘিরপাড় এলাকায় এককালে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এই জনশ্রুতির পাশাপাশি এ এলাকায় স্থানীয় কবরস্থানে কবর খুঁড়তে গেলে এখনো প্রাচীনকালের পয়সা, ইটের টুকরা ও মাটির বাসনের ভাঙা টুকরা পাওয়া যায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালককে চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি)। চিঠিতে ‘কথিত বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি অ্যান্টিকস অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুসারে সংরক্ষিত ঘোষণা ও সংস্কার-সংরক্ষণের কোনো সুযোগ আছে কিনা এ সম্পর্কে সরজমিন পরিদর্শনসহ ফটো ও মতামতসহ প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, এ বিষয়টি জানার পর আমি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। মৌলভীবাজার জেলায় ১৯৬১ সালে একটি তাম্রশাসন আবিষ্কার করা হয়। যেটির তথ্য মতে, আনুমানিক ৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে সিলেটে সম্পূর্ণ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রাজা শ্রীচন্দ্র। তবে সেটা যে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে ছিল কিনা সেটা জানা নেই।
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন বরাদ্দ করা হয়েছিল ব্রাহ্মণদের বসবাসের জন্য, যেখানে ব্রাহ্মণদের ধর্মপ্রচার আর পূজা-অর্চনা ছাড়াও শিক্ষা-দীক্ষার একটা ব্যবস্থা ছিল। তিনি গৌড়দের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিলেন। দ্বিতীয় গোপালের শাসনকালে পালদের ক্ষমতা রক্ষাকল্পে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভূমিদান সম্পর্কিত তার ৬টি তাম্রশাসন এবং তার উত্তরাধিকারীদের তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্র সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে বঙ্গ ও সমতটের বিস্তীর্ণ এলাকায় তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।
ভারতবর্ষে তাম্রশাসনের ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, প্রাচীনকালে তাম্রশাসন ছিল তামার পাতে লেখা দলিল। রাজা-বাদশারা বিভিন্ন রাজকীয় নির্দেশ তামার পাতে খোদাই করে রাখতেন। চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র এই তাম্রশাসন চালু করেছিলেন। দশম শতকে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক খোদিত পশ্চিমবাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি সিলেট জয় করেছিলেন।
রাজা শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমবঙ্গ তাম্রশাসন বা মৌলভীবাজার তাম্রশাসনটিও (৯২৫-৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় কম্বোজ শাসকদের শাসনকালে জারিকৃত একটি লিখিত দলিল। চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রী চন্দ্র (৯২৫-৯৭৫ খ্রি.) এই তাম্রশাসনটি জারি করেন। এতে সমতট দেশের খিরোদা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল দেবপর্বত-এর নাম উৎকীর্ণ বা খোদিত এবং রাজা শ্রীচন্দ্রের পিতা রাজা তৈলক্যচন্দ্র কর্তৃক (৯০৫-৯২৫ খ্রীষ্টাব্দ) কম্বোজদের পরাজিত করার তথ্য ধারন করে। তাম্রলিপিটি পাঠোদ্ধার করে তাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আহমেদ হাসান দানী। সম্পূর্ণ লিপিটি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, লালমাই বনাঞ্চল থেকে কম্বোজদের সৈন্য সমতট অঞ্চলে আক্রমণ করেছিল এবং চন্দ্র বংশীয় রাজা তৈলক্যচন্দ্র তাদের পরাজিত করে লালাম্বী রক্ষা করেছিলেন। চন্দ্র রাজবংশের রাজাদের মধ্যে শ্রী চন্দ্র ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ রাজা।
চন্দ্র রাজবংশ দশম ও একাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে শাসন করা একটি বৌদ্ধ ধর্মালম্বী রাজবংশ, ভারতীয় উপমহাদেশের এই রাজবংশ মূলত বাংলার সমতট অঞ্চল ও উত্তর আরাকান শাসন করত। চন্দ্র রাজবংশের পাঁচজন উল্লেখযোগ্য রাজার মধ্যে চন্দ্র রাজবংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজা ছিলেন শ্রীচন্দ্র । ৪৫ বছর তিনি শৌর্য-বীর্য ও সাফল্যের সঙ্গে রাজত্ব করে গিয়েছেন। সমগ্র বঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বে কামরূপ পর্যন্ত চন্দ্রদের ক্ষমতা বাড়ানোর কৃতিত্ব শুধুই শ্রীচন্দের। চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষ যদি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশ জন্য এক বিশাল গৌরবের ব্যাপার এবং এটা হবে একটা ইতিহাস।আর এটি এই অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হবে।
#তথ্যসূত্র #উইকিপিডিয়া #দৈনিক_ইত্তেফাক_১৯_জুলাই_২০২০ #মানবজমিন_৩_আগস্ট_২০২০