‘কলকাতা ‘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় শহর।বাংলা সংস্কৃতির পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিল্প-সংস্কৃতি ও স্থাপনার অদ্ভুত মিশ্রণে সমৃদ্ধ এ শহরটি।প্রাচীন শিল্পশৈলীর নিপুনতায় আধুনিক কলকাতা পর্যটন রাজ্যের অন্যতম একটি শহর। পাশ্চাত্যের শিল্পের প্রকাশ, বাঙালিয়ানা সংস্কৃতি, ভাষার ঐক্য কিংবা ভৌগোলিক অবস্থান সব মিলিয়ে কলকাতা ভ্রমণ পর্যটকদের কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি। সৌভাগ্যক্রমে, এই “প্রাসাদ নগরী ” কলকাতাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।ভ্রমণে গিয়ে সৌন্দর্যের সাথে সাথে অনেক স্থাপত্যের ইতিহাসও মুগ্ধ করেছে আমায়।ডালহৌসি পাড়ার “ফেয়ারলি প্যালেস” কিংবা সেন্ট জনস চার্চের সমাধিক্ষেত্র — সবটাই অদ্ভুত ইতিহাসের কথকের ভূমিকায়, আবার কখনও ইতিহাস জানার আগ্রহকে জাগিয়ে তুলছে ।
সেন্ট জনস চার্চে জোব চার্নকের সমাধি সবারই নজর কাড়ে।কেননা জোব চার্নক বণিক হওয়ার পাশাপাশি কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা সময় থেকে এই শহরের সাথে যুক্ত l গ্রিক মন্দিরের আদলে তৈরি সাদা দেয়াল, দুখানা গম্বুজ, আর সরু সরু খিলানপথ নিয়ে তাঁর সমাধিটি চোখে পড়ার মতোই।জোব চার্নকের পাশে উত্তর কোণে অন্য একটি সমাধি।জানেন,এই সমাধিটি কার?– এখনো চির নিদ্রায় আছেন এক বিচিত্র নারী।যিনি কলকাতা নগরের টানে স্বামী সন্তানকেও ত্যাগ করেছেন।যিনি ক্লাইড -ওয়াটসনের কলকাতায় প্রকৃত নায়িকা ;বেগম ফ্রান্সিস জনসন। তার আসল নাম মিস ফ্রান্সিস ক্রুক।নামের সাথে বেগম যুক্ত থাকলেও তিনি কিন্তু কোনো নবাবদুহিতা নন।তাঁর শরীরে ছিল পর্তুগিজ রক্ত।মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট ডেভিড দূর্গের গভর্নর, মিস্টার এডওয়ার্ড ক্রুকের দ্বিতীয়া কন্যা ছিলেন ফ্রান্সিস। ছোট থেকেই ফ্রান্সিস হাসিখুশি নজর কেড়ে নেওয়া মিষ্টি স্বভাবের এক মানুষ।
তৎকালীন বাংলার গভর্নরের নিকটাত্মীয় প্যারী পারপল টেম্পলারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফ্রান্সিস। ভাগ্যের পরিহাসে তাদের দুটো সন্তান হওয়া সত্বেও কেউ-ই বাঁচে নি।এবং বিয়ের ঠিক চার বছর পর পরই মৃত্যু হয় তাঁর প্রথম স্বামীর। টেম্পলারের মৃত্যুর ন’মাসের মাথায় তিনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন মিস্টার জেমস আলথেনকে।তবে এবারেও ভাগ্য বাধ সাধে,বিয়ের ঠিক দশদিন পর বসন্তরোগে মারা যান দ্বিতীয় স্বামীও। অতঃপর তৃতীয় স্বামীরূপে তৎকালীন কলকাতার কাউন্সিলের প্রধান সদস্য উইলিয়াম ওয়াটসনকে গ্রহণ করেন।যিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠির অধিকর্তা। এবারে, ১৭৫৬ সালে সিরাজ উদ-দৌলা কাশিমবাজার কুঠি আক্রমণ করলে,সস্ত্রীক ওয়াটসন তিন নাবালক সন্তানসমেত বন্দী হন।ওয়াটসনকে রাজবন্দিদের সাথে রাখা হলেও তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের এখানে রাখা সমীচীন নয়;এ কথা ভেবে সিরাজের নানীর অভিভাবকত্বে তার মহলে রাখা হয় তাদের। সকলের সঙ্গে সহজ ভাবে মেশার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল ফ্রান্সিসের।ওয়াটসনের থেকে বাংলাভাষাটাও মোটামুটি ভালোই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি।এই বাংলা ভাষা, আর মিষ্টি কথায় তিনি সিরাজের নানীকে প্রভাবিত করতে সফল হন।নানীর সাহায্যে ফ্রান্সিস বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে গিয়ে চন্দননগরে আশ্রয় নেন। সেই থেকেই তাঁর নামের সাথে “বেগম” শব্দটি জড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে নানীবেগমের সহায়তাই মিস্টার ওয়াটসনও মুক্তি পান।
ওয়াটসন ছাড়া পাওয়ার পর রাজ পুরুষ হিসেবে ভারতে বেশ কয়েকবছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সপরিবারে ইংল্যান্ড চলে যান।কিন্তু ফ্রান্সিস কলকাতার বিরহে আকুল হয়ে পড়েন।১৭৬৪ তে ওয়াটসন মারা গেলে -বেগম দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে এবং এক ছেলেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে একা কলকাতায় ফিরে আসেন। আমরা জানি যে ১৮১২সালে যিনি ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন লর্ড লিভারপুল ; তিনি ছিলেন বেগম ফ্রান্সিসের নাতি।
ফ্রান্সিস কখনোই ভাগ্যের কাছে হার মেনে বসে থাকার পাত্রী ছিলেন না।তাঁর জীবন নাটকের রোমাঞ্চের থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার। এবার কলকাতা ফিরে তিনি চতুর্থবারের মতো বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়েন সেন্ট জনস চার্চের যাজক উইলিয়াম জনসনের সাথে।উইলিয়াম বিয়ের চার বছর পর পাড়ি দেন স্বদেশের পথে। কিন্তু ফ্রান্সিস আবার কলকাতাকে ছেড়ে যাওয়ার ভাবনাকে কখনও মেনে নিতে পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন বাকিটা জীবন এই শহরে,এই সংস্কৃতিতে মিশে কাটাতে। এভাবেই নিজের মতো করে কলকাতা নগরীতেই কাটিয়েছেন তাঁর শেষ জীবন। বেগম ফ্রান্সিস জনসন এবার বিধবা হলেন না বটে, কিন্তু মনে বহন করে চললেন এক অব্যক্ত যন্ত্রনা।
বিয়ের সূত্রে ক্ষমতা আর বৈভবের অধিকারিণী হয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সিস কলকাতার মানুষদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তাঁর রঙিন স্বভাবের জন্য। ফেয়ারলি প্যালেসে প্রতিনিয়তই বসত বেগমের আড্ডার আসর।ব্রিটিশ অভিজাত মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষরাও আসতেন তাঁর গল্প উপভোগ করতে।সন্ধ্যার অন্ধকারকে ম্লান করে বেগমের প্রাসাদপম বাড়িটি আলোয় আলোয় সেজে উঠতো। বেগম ফ্রান্সিস রবার্ট ক্লাইভ থেকে লর্ড মিন্টোর আমল পর্যন্ত পুরো সময়টাই স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। ফিলিপ ফ্রান্সিস বনাম ওয়ারেন হেস্টিংস ডুয়েল, নন্দকুমারের ফাঁসি, নীলকুঠি পত্তন, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বিধ্বস্ত বাংলা, মারাঠাদের গৌরব রবির অস্তাচল যাত্রা, ক্যাথরিন গ্রান্ডের চুঁচুড়া থেকে যাত্রা শুরু করে নেপোলিয়নের সভায় পৌঁছানো– সব ঘটনার প্রত্যক্ষ দর্শী তিনি।অনেকদিন পর এইচ.ই.কটন লিখেছেন, ” আমরা পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ সেই ব্যক্তির আকর্ষণকে কেবল কল্পনাই করতে পারি যিনি ক্লাইভের ভাষণ শুনেছেন,দেখেছেন এডমিরাল ওয়াটসনকে।যিনি সিরাজের সাথেও দেখা করেছেন। আর সর্বোপরি নিজের জীবদ্দশায় দেখে গেছেন -যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই মারাঠাদের উপর শর্ত আরোপ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছে,যাদের আক্রমণের ভয়ে একদিন তাদের পরিখা খুঁড়ে আত্মরক্ষা করতে হয়েছিল। “
তাছাড়াও বাবুদের দুর্গোৎসব দেখেছেন, ছাপাখানা চালু হতে দেখেছেন, শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনও দেখেছেন, আর তিনি কিছুকাল তো নানী অভিভাবকত্বে ছিলেনই।সুতরাং বোঝাই যায়, গল্পের আসর মাতিয়ে রাখার মতো অফুরান গল্পের ভান্ডার ছিল তাঁর। সন্ধ্যা নামতেই ফেয়ারলি প্যালেসে অতিথি অভ্যাগতদের আগমন শুরু হতো।কলকাতার এসকল সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের তিনি শোনাতেন রঙিন সব কাহিনী। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত এবং সাহেবদের নিয়ে এই আসরে যেদিন উপযুক্ত কোনো প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যেতো না,সেদিন সাহেবরা স্বয়ং বেগমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতেন, রঙ্গতামাসায় মুখরিত থাকতো আসর।ইংরেজদের মুখে এমন প্রশংসা শুনে বেগম জনসন লজ্জায় আধখানা হয়ে যেতেন । এমন নাটকীয় এবং নিত্য রঙিন জীবনের ইতি টেনে চির নিদ্রায় শায়িত হন বেগম জনসন।দীর্ঘ ৮৭টি বর্ণাঢ্য বসন্ত পার করে তিনি পরলোকে যাত্রা করেন।
আর তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে নিভে যায় ফেয়ারলি প্যালেসের বাড়িটির আড্ডার ঝাড়বাতি। আজীবন যে ভালোবাসা, সম্মান, আার মর্যাদা তিনি পেয়ে এসেছিলেন, মৃত্যুর পরও তার ব্যতিক্রম হয় নি। তাঁর শেষকৃত্যে কলকাতার সকল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ,কাউন্সিলের সদস্যরা,সুপ্রিম কোর্টের জাজগণ,এমনকি স্বয়ং বড়লাট মিন্টোও উপস্থিত হন আনুষ্ঠানিক ভাবে ছয় ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। শেষকৃত্যে পরিবার দূরে থাকলেও, কলকাতা শহরই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিবার। কলকাতার ইতিহাসে এর আগে কখনও এমন রাজকীয়ভাবে কোনো নাগরিকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় নি।
বেগমের শেষ ইচ্ছে ছিল,সেন্ট জনস চার্চে চিরঘুমে শুয়ে থাকবেন। পূর্বেই তিনি ওয়েলেসলির থেকে সেই অনুমতি আদায় করে রেখেছিলেন। তাই উনার মৃত্যুকালে যদিও সেখানে সমাধি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়,তথাপি বেগম জনসনের শেষ ইচ্ছার সম্মানার্থে তাঁকে সেন্ট জনস চার্চে জোব চার্নকের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সেই অনিন্দ্য সুন্দর সমাধি স্তম্ভের ফলকে লেখা আছে — “The oldest British resident in Bengal Universally beloved, respected and revered. ” বেগম জনসন তাঁর সমগ্র জীবনে কলকাতা শহরকে যেভাবে ভালোবাসায় সিক্ত করে গেছেন,তেমনিই আজও তিনি কলকাতার বুকে চির অম্লান হয়ে আছেন।