নানুরে রামী-চণ্ডীদাসকে নিয়ে একটি মিথ প্রচলিত আছে।সেটা এই যে, সেখানে রামী নামের একজন রজকিনী, যিনি ছিলেন বাল্য বিধবা তাঁর সংগে প্রেম হয় চন্ডীদাসের। জমিদারের নির্দেশে গ্রামদেবী বিশালাক্ষীর মন্দিরে পরিচারিকার কাজ করতেন রামী, ওই সময় মন্দিরের পুজারির দায়িত্বে ছিলেন চণ্ডীদাস, যিনি আদতে ছিলেন একজন বৈষ্ণব কবি। তাঁরই প্রচেষ্টায় এবং দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দিরে ঢোকার অধিকার পান তথাকথিত ‘অছুত’ধোপানি রামী। ক্রমে ক্রমে দু’জনের মধ্যে জন্ম নেয় গভীর প্রেম। কথিত আছে, রামী যখন ঘাটে কাপড় কাচতেন, তখন ছিপ হাতে পুকুর পাড়ে বসে থাকতেন চণ্ডীদাস। প্রেম যে মানুষের তৈরী জাত-পাতের ধার ধারেনা এটি তার একটি জলন্ত প্রমান।
নানুরের অদূরে তেহাই গ্রামে সেই রজকিনীর বাস । পিতৃমাতৃহীনা এই রামীর প্রতি সেই থেকেই ভালোলাগা এবং তার পরিণতি সার্থক প্রেমে। এখন বাসলীদেবীর মুখ মনে পড়লেই তাঁর মনে পড়ে যায় সেই রজকিনী রামীর মুখ। যেন অবিকল এক মুখশ্রী! আশ মেটেনা রামীকে দেখে, হাসিমুখে কাজ করে মেয়েটা কাজে-কর্মে কখনো কোনরকম অনীহা নেই। ভোরের পুবের আলোতে রামির রূপ একরকম, চাঁদের জ্যোছনায় তাকে দেখলে সর্বাঙ্গ অবশ করা এক অনুভূতি হয় ।অমাবস্যার অন্ধকারে সেই নারীমূর্তি যেন আচ্ছন্ন করে রাখে চন্ডীদাসকে । রামী যেন কৃষ্ণকলি। কালোমেয়ের এতরূপ! কাজলকালো আঁখি, নিটোল গড়নপেটন । আর চেহারায় যেন কি একটা যাদু আছে । চন্ডীদাস দিনে দিনে ক্রমশঃ উপলব্ধি করেন রামীর এই রূপ রহস্য। এই মেয়েকে দেবীমূর্তির মত মনে হয় তাঁর কাছে।
রজকিনী-রূপ কিশোরী স্বরূপ কাম-গন্ধ নাহি তায়
রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম বড়ুচন্ডীদাস গায় ।।
শিল্পীর তুলিতে চণ্ডীদাস ও রজকিনী
কখনো এই নারীমূর্তিকে তাঁর মনে হয় তাঁর বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধিকা আবার কখনো তাকে মনে হয় বাসলী দেবীর প্রতিমূর্তি। স্ত্রী পদ্মজাকে তিনি কিছুই দিতে পারেননি।মনের দুঃখে চলে গেছে সে ।
বৃন্দাবনে যেমন কানু ছাড়া গীত নাই, চণ্ডীদাস ছাড়া কথা নাই নানুরে! এ নেহাত মিল খোঁজা নয়, নানুর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের নাম। এখনও মানুষ একই শব্দে বলে থাকে চণ্ডীদাস-নানুর। সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রজকিনী-রামীর নামও,যিনি তাঁর সাধনের সঙ্গিনী ছিলেন।
শুন রজকিনী রামি
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া
শরণ লইনু আমি ।।
ক্রমে রামির প্রেম এবং বাসলীদেবীর আশীর্বাদ দুই মিলে যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন তা আজো বাংলাসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ ।
এই প্রেম অবশ্য জমিদার এবং সেই সময়ের সমাজপতিরা কেউই ভাল চোখে দেখেন নি। কবি রামীকে ত্যাগ না করলে চণ্ডীদাসের মৃত বাবার সৎকার করতে পর্যন্ত অস্বীকার করে সে সময়ের সমাজ। কিন্তু রামীকে ত্যাগ করেননি চণ্ডীদাস। দু’জনের এই ভালবাসা দেখে শেষে রামীকে চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয় সবাই।
চণ্ডীদাস-পূজিতা নান্নুরের বাশুলীদেবী
প্রথম চণ্ডীদাস হিসেবে পদাবলীর চণ্ডীদাসকে ধারণা করা হয় যিনি আনুমানিক ১৪ শতকে (১৩৭০-১৪৩০) পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার নানুরে জন্মগ্রহন করেন। তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যের বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা। সে কারনে তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। চৈতন্যদেবের জন্মের আগে থেকেই চণ্ডীদাসের বহু গীতিপদ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। পরে চৈতন্যদেব নিজে তার পদ উপভোগ করতেন বলে শোনা যায়। সহজ ভাবধারায় পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস রচিত মানবিক প্রেমের কয়েকটি পদ এখানে তুলে দিলাম—
“ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন, কেহ না জানয়ে তারে।
প্রেমের আরতি যে জন জানয়ে সেই সে চিনিতে পারে।।”
“মরম না জানে, মরম বাথানে, এমন আছয়ে যারা।
কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহুন তারা।
আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে – ভিতর দুয়ার খোলা।”
“কহে চণ্ডীদাস, কানুর পীরিতি – জাতিকুলশীল ছাড়া।”
“প্রণয় করিয়া ভাঙ্গয়ে যে। সাধন-অঙ্গ পায় না সে।”
“কি লাগিয়া ডাকরে বাঁশী আর কিবা চাও।
বাকি আছে প্রাণ আমার তাহা লৈয়া যাও। “
সহজিয়া গুরুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি লেখেন,
“শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ বড়, তাহার উপরে নাই।
বাংলা ভাষায় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রায় ১২৫০ টিরও বেশি কাব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে রচয়িতা হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস ও চন্ডিদাস এই চারটি ভিন্ন নামের উল্লেখ রয়েছে আবার কোনোটিতে রচয়িতার নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি। এ কাব্যগুলো ‘ভণিতা’ নামে পরিচিত। ভণিতা একই ব্যক্তি রচনা করেছে কিনা সেটা পরিষ্কার করে জানা যায় না। কারও কারও মতে, তিনিই মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতার অন্যতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন রচনা করেন । তবে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন।
এই কাব্যে কবি নিজেকে অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস হিসাবে ভনিতা দিয়েছেন। তার আসল নাম অনন্ত, কৌলিক উপাধি বড়ু, এবং গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। তিনি বাসলী/বাশুলী দেবীর উপাসক ছিলেন (বীরভূমের নানুরে এই দেবীর মন্দির আছে)। “বড়ু” শব্দটি “বটু” বা “বাড়ুজ্যে” (বন্দ্যোপাধ্যায়) শব্দের অপভ্রংস বলে মনে করা হয়। বৈষ্ণব পদকর্তা রূপে চণ্ডীদাসের নাম সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কাছে যেমন সুবিদিত তেমন বিতর্কিতও। তাঁর পরিচয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত।
কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতরা ধারনা করে থাকেন যে, বর্তমান যে সব কবিতা চণ্ডীদাসের নামে রয়েছে তা অন্তত চারজন ভিন্ন চণ্ডীদাস রচনা করেছেন। ভণিতা কাব্যের রচনাশৈলী অনুযায়ী তাদের আলাদা করা যায়। কোনও কোনও সাহিত্যের গবেষক বলেন, চার জনই একই ব্যক্তি। একাংসের মতে, যে পদকর্তার বিভিন্ন রচনায় নানুর এবং সংলগ্ন এলাকার কথা ঘুরে ফিরে এসেছে তিনিই নানুরের চণ্ডীদাস।
চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা বসন্তরন্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ একটি স্থানীয় প্রবাদের উল্লেখ করেছেন, বীরভূমের নানুরে বাশুলীদেবীর মন্দিরের কাছে চণ্ডীদাসের কীর্তন দলের একটি নাট্যশালা ছিল।
চণ্ডীদাসের জন্মের মতোই মৃত্যু নিয়েও নানা রকম মত রয়েছে। চণ্ডীদাস একবার গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করতে সেখানে যান। তার কণ্ঠে ভক্তি-প্রেমের গান শুনে নবাবের বেগম মুগ্ধ হয়ে যান এবং তিনি চণ্ডীদাসের গুণের অনুরাগিণী হয়ে পড়েন। বেগম একথা নবাবের কাছে স্বীকার করলে নবাব ক্রোধের বশে চণ্ডীদাসকে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেন। আত্মীয় বন্ধুদের সামনে চণ্ডীদাসকে হাতির পিঠে বসিয়ে নিদারুণ কশাঘাতে তাঁর জীবনাবসান হয়, বেগম সেই দৃশ্য দেখে শোকে জ্ঞান হারিয়ে মারা যান। কথিত আছে, শূদ্র কন্যা রামীর সঙ্গে তার প্রেম ছিল বলে স্থানীয় লোকজন তাকে মেরে তার বাড়িতে চাপা দিয়ে দেয়। আবার কারও মতে তিনি সেই সময়ের বৈষ্ণব পীঠস্থান ইলামবাজারে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
চণ্ডীদাসের ভিটে
আরেকটি মত হল, একদিন বিশালাক্ষী মন্দিরের আটচালায় কীর্তন গানে বিভোর ছিলেন সাধক কবি। তাতে যোগ দিয়েছিলেন নবাবের বাড়ির মহিলারাও। তাই নবাবের নির্দেশে কামান দাগা হয় ওই আসরে। তাতে সকলেই ধংসস্তুপে চাপা পড়েন। সে স্তুপ আজও রয়েছে। পুরাতত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ একেই চণ্ডীদাসের সমাধি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাধিক্ষেত্র এবং বিশালাক্ষী মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তারা নিয়েছে।
নানুরে রামী-চণ্ডীদাসকে ঘিরে এমন নানারকম গল্প-গাঁথা ছড়িয়ে রয়েছে। অতীতের নানা নির্দশনও ছড়িয়ে রয়েছে নানুরের আনাচে-কানাচে। অনায়াসেই ওইসব নির্দশন ঘিরে একটি পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলা যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি।
চণ্ডীদাসের সমাধি মন্দির
পরবর্তীকালে নানুরের চণ্ডীদাসের স্বতন্ত্র পরিচিতি ঘটেছে। রামী চণ্ডীদাস হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন নানা জনের লেখায়। এখনও কবির সঙ্গে সমোচ্চারিত হয় তাঁর প্রেম-সাধিকা রামীর নামও। চণ্ডীদাসের বিভিন্ন পদেও রয়েছে তার উল্লেখ। স্বভাবতই কবির পাশাপাশি তাঁর প্রেমিকাকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন এলাকার মানুষ। কবির সঙ্গে তাঁর যুগল মুর্তি নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ সেই উদ্যোগেরই নজির। যে ঘাটে রামী কাপড় কাচতেন সম্প্রতি সেটি পাকা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে রজকিনীর ঘাট। যে পাটাতে রজকিনী কাপড় কাচতেন সেটিও সযত্নে রাখা আছে, ঘাট লাগোয়া রক্ষাকালী মন্দিরের পাশে। ভ্রমনার্থীরা ওই ঘাট ও পাটা দেখতে ভিড় জমান নিত্য।
নানুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তেরাস্তার মোড়ে রামী-চণ্ডীদাসের যুগল মূর্তির দিকে কারও নজর পড়ে না। বছর দশেক আগে প্রশাসনিক উদ্যোগে ওই যুগল মূর্তি তৈরি হয়েছিল, সেই মূর্তিও অবহেলায় অনাদরে পড়ে আছে। শুধুমাত্র দোল এলেই পরিষ্কার করা হয় মূর্তিটি। সোনালি রঙের মূর্তির সর্বাঙ্গ ধুলোময়। মূর্তির চারপাশে গ্রিলের ঘেরার ভিতরে প্লাস্টিক-ফাইবারের কাপ-ডিস পড়ে। গ্রিল ঘিরে ব্যবসায়ীদের পসরায় ঢাকা চণ্ডীদাস-রামীর মুখ!
প্রাচীন এই কবির নাম এখন জুড়ে গিয়েছে নানুরের গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে স্কুল-কলেজ, গ্রন্থাগার, সবজি বাজারের সঙ্গেও। স্থানীয়দের দাবি, কবির কীর্তিকে স্মরণে রেখে, তাঁর স্মৃতি-চিহ্নগুলির সংরক্ষণে তাঁদের সঙ্গে প্রশাসনের সহযোগিতাও কাম্য। এখানেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় গড়ে তোলা যায় পর্যটনক্ষেত্র।
তথ্যসূত্র
আনন্দবাজার ডট কম
ইন্টারনেট