ক্লিওপেট্রা কিন্তু সরাসরি আলেকজান্ডারের বংশধর ছিলেন না। তবে আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত সেনাপতি টলেমি (I)-এর সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক ছিল। টলেমি ছিলেন ম্যাসিডোনিয়ার অধিবাসী। সে দিক থেকে ক্লিওপেট্রাকে মেসিডোনিয়ার ক্লিওপেট্রা বলা যেতে পারে। আমরা জানি, টলেমি রাজবংশের শেষ শাসিকা ছিলেন ক্লিওপেট্রা এবং সেইসঙ্গে মিশরের শেষ সক্রিয় ফারাও। তিনি নিজে আলেকজান্ডারের বংশধর না হলেও তার পূর্বপুরুষ টলেমি (I)-এর সঙ্গে আলেকজান্ডারের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব। গ্রিক বংশের পবিত্রতা রক্ষার জন্য তারা অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন এবং সংস্কৃতিকে সুসংহত রাখার জন্যও বদ্ধপরিকর ছিলেন।

ক্লিওপেট্রা ও মার্ক অ্যান্টনি বা জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে ঐতিহাসিক দৃশ্য © wikipedia
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হলে তার সেনাপতি ও উত্তরাধিকারীরা তার বিশাল সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। টলেমি মিশরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে নিজের রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ৩০০ বছর ধরে মিশর ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ক্লিওপেট্রা ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে টলেমি দ্বাদশ আউলেটসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ক্লিওপেট্রার মায়ের পরিচয় নিশ্চিতভাবে জানা যায় না, তবে অনেকে বলেন তার নাম ছিল ক্লিওপেট্রা ট্রাইফেনা।
ক্লিওপেট্রার পূর্বসূরিরা তাদের বংশের পবিত্রতা বজায় রাখতে অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন এবং সংস্কৃতিকে সংহত রাখার জন্যও ছিলেন বদ্ধপরিকর। এই কারণেই রাজারা সেই সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। তারা মূলত আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাস করতেন। গ্রিক ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। রাজা ও অভিজাতরা বেশিরভাগই নতুন শহরেই থাকতেন। মিশরের উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যে এলাকায় বাস করতেন, তারা সেই এলাকাগুলো মোটামুটিভাবে এড়িয়ে চলতেন। তারা নিজেদের মধ্যে গ্রিক ভাষায় কথা বলতেন, কিন্তু সাধারণ মিশরীয়রা তাদের নিজস্ব মিশরীয় ভাষাতেই কথোপকথন চালিয়ে যেতেন।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরের শিল্পিত চিত্র © wikipedia
ক্লিওপেট্রা ছিলেন অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন এক নারী। তিনি একাধিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন, এবং মিশরীয় ভাষা সেই ভাষাগুলোর একটি। ক্লিওপেট্রার এই ধরনের ভাষা-চর্চা টলেমি শাসকদের মধ্যে ছিল এক বিরল বৈশিষ্ট্য। নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা ধরে রাখলেও টলেমিরা মিশরীয় ধর্ম ও ঐতিহ্যকে আংশিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। তারা শহরে গ্রিক শিক্ষা ও জিমনেসিয়াম চালু করেছিলেন এবং শিল্পকলা ও স্থাপত্যে গ্রিক প্রভাবটিকে সমন্বিত রাখার চেষ্টা করতেন। তারা নিজেদের পরিবারে বিবাহ করতেন রক্তের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য।
তবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তারা দেবতা সেরাপিসের পূজা শুরু করেন। সেরাপিস ছিলেন মিশরীয় ও গ্রিক দেবতাদের এক মিলিত রূপ। দুটি জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে তারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও, দুই দলের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য থেকেই গিয়েছিল। গ্রিকরা গ্রিক ভাষায় আইন ও শিক্ষালাভ করত, অন্যদিকে মিশরীয়রা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ মিশরীয় ভাষাতেই সম্পাদন করত।
বহু শতাব্দী ধরে টলেমীয় মিশর হেলেনিস্টিক বিশ্বে এক শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে ক্লিওপেট্রার পিতার সময় থেকে রাজনৈতিক পরিবর্তন শুরু হয়। সে সময় থেকে তারা রোমের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়। ক্লিওপেট্রার ভাইয়ের হাতে পম্পেই দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর রোমানরা সরাসরি মিশরের সঙ্গে শত্রুতায় জড়িয়ে পড়ে। বিপদ দেখে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য ক্লিওপেট্রা জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং এর মাধ্যমে শাসনভার নিজের হাতে নেওয়ার সুযোগ পান।

জুলিয়াস সিজারের মূর্তি © wikipedia
পরবর্তীতে সিজারের মৃত্যুর পর তিনি মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই সম্পর্কের মাধ্যমে রোমান ও হেলেনিস্টিক রাষ্ট্র তৈরির ইচ্ছাই নিহিত ছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না তাদের। ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে তারা পরাজিত হন। ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের সম্মান অক্ষত রাখার চেষ্টা করেন। শত্রুরা সাথে সাথেই তার সন্তান সিজারিয়নকেও হত্যা করে।
এভাবেই টলেমীয় রাজত্বের অবসান ঘটে এবং মিশর রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ক্লিওপেট্রা সরাসরি আলেকজান্ডারের বংশধর না হলেও, তার শাসনকাল ছিল আলেকজান্ডারের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীর চূড়ান্ত অধ্যায়। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হেলেনিস্টিক যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আলেকজান্ডারের গড়ে তোলা উত্তরাধিকার রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

