পৃথিবীর ইতিহাসের বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে বুকে ধারণ করে রেখেছে ইরাক। সভ্যতার সূতিকাগার মেসোপোটেমিয়ায় প্রাচীন এক শহরে নিরলসভাবে খনন করে যাচ্ছে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ লিওনার্ডো উলি। সেখানে খনন কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে কোনোবারই নিরাশ হতে হয়না প্রত্নতাত্ত্বিকদের। প্রতিবারই চমৎকৃত করার মতন কিছু না কিছু প্রত্নবস্তু উঠে এসেছে তাদের হাতে। প্রচন্ড শ্রম ,কষ্ট এবং ব্যয় সাপেক্ষ হলেও মুখে শেষ পর্যন্ত হাসি ধরে রাখতে পেরেছেন তারা।
‘উর’ এর বর্তমান নাম ধি-কার অঞ্চল। সেখানে খনন করতে করতে এমন একটা জায়গা তারা আবিষ্কার করলেন যেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন সময়কার কিছু প্রত্নবস্তু। কেউ যেন খুব যত্ন করে জাদুঘর তৈরির প্রবল ইচ্ছে নিয়ে এই জায়গাটিকে তৈরি করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদ উলি বেশ আশ্চর্য হলেন; আড়াই হাজার বছর আগের এই সংগ্রাহকের কাজের নিষ্ঠা দেখে। এত বছর আগে সংগৃহীত ঐ প্রত্নবস্তুগুলোর প্রত্যেকটির নিচে নাম, কোথা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে বা তার ইতিহাস, যত্নের সাথে লিখে রাখা হয়েছিল। একে প্রাচীন ব্যবিলনের এক জাদুঘর বলা যেতে পারে। তারা বুঝলেন এক সংগ্রাহকের সংগ্রহশালায় তারা হাত দিয়ে বসেছেন। তাহলে সংগ্রাহক কে ছিল? তারও পরিচয় বের হয়ে আসলো। সম্রাট নাবোনিডাস মেসোপোটেমিয়ার সভ্যতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি।
সেই সময়ের রাজনীতিতে পুরোহিতদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। শুধুমাত্র জাদুঘর তৈরির কাজেই তার কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ না রেখে ৫৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রধান মহিলা পুরোহিতের পদেও তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন তাকে বলা হতো এন্তু। চন্দ্রদেব ‘সিন’ এর প্রতি তার সমস্ত বিশ্বাস এবং দায়িত্ব নিবেদন করতে হতো। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম নেবুচাঁদনেজারের পর এই পদটি শূন্য ছিল। খ্রীস্টপূর্ব ৫৫৪ সালে হঠাৎ যখন চন্দ্র গ্রহণ হয় তখন রাজা নবোনেডাস এটিকে একটি শুভ লক্ষ্মণ হিসেবে গননা করেন এবং চন্দ্রগ্রহণের সময়টিতে এন্নিগাল্ডিকে এন্তুর পদে দায়িত্ব দেন। এন্তু ছিল রাজার সুস্থতা, রাজত্বের উন্নতি এবং দৈহিক শক্তির উৎস। মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বের সাথে সাথে মন্দিরের আশেপাশে যে বিশাল সম্পত্তি ছিল সেগুলোরও মালিক ছিলেন তিনি। অত্যন্ত শক্তিশালী এই পদ। শুধুমাত্র ধর্ম বা জাদুঘর স্থাপনই না, দেখা গিয়েছে রাজকার্যেও তিনি সক্রিয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করতেন।
এতো যার অবদান ইতিহাস থেকে সেই এন্নিগাল্ডি হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে এন্নিগাল্ডির জীবনে কি হয়েছিল তার হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। বহু আগেই নাবোনিডাসের রাজত্ব শেষ। ইউফ্রেটিস নদীর উপরে বয়ে গেছে নানা রকম ঝড়-ঝঞ্ঝা। খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মিলিয়ে অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় নেমে আসে অভিশাপ। এক পর্যায়ে হারিয়ে যায় এন্নিগাল্ডির সংগ্রহ শালাও। সত্যি ইতিহাস খুব আশ্চর্যের।
একজন নারী, যে সকলের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে এক বিশাল সংগ্রহশালা তৈরি করে বিভিন্ন প্রত্নবস্তুগুলোকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেন, অতীতকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন সময়ের আবর্তে তিনিই একদিন মাটির নিচে চাপা পড়ে যান। কিন্তু আমরা ভাগ্যবান। হাজার বছর পর খুঁজে পাওয়া গেল তার কৃতিত্বকে। তার এই কর্ম বিশ্বের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের চোখ খুলে দিল নারীর যোগ্যতা সম্পর্কে। সেই সাথে ইতিহাসকে জানার জন্য পথকে প্রশস্ত করে দিলেন। হাজার হাজার বছর তার ইতিহাস মাটিচাপা পড়ে থাকলেও আবার তিনি নতুন করে জন্ম নিলেন বিশ্ববাসীর কাছে। প্রাচীনতম সংগ্রহশালার গল্প উঠে আসলো নতুন সংগ্রাহকদের কাছে।স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রথম যাদুঘরের কিউরেটর এন্নিগাল্ডি।