কল্পনা করুন, আপনি সময়ের ঘড়ি পেরিয়ে চলে গেছেন আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, ইতালির এক উষ্ণ সন্ধ্যায়। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে অস্তগামী সূর্যের রঙিন আলো। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর, কাঠের ফটক ঠেলে আপনি প্রবেশ করছেন এক অভিজাত এট্রুসকান প্রাসাদের ভেতরে, তখন চলছে এক রাজকীয় ভোজসভা।
প্রাসাদে অসাধারণ আয়োজন, এখানে সবকিছুই যেন সযত্নে সাজানো। সুগন্ধে ভরা বাতাস, অল্প আলোয় ঝলমল করা রঙ্গিন দেয়াল। রঙিন কাপড়ে মোড়া একপাশে হেলান দেওয়ার সোফাসদৃশ আসন, এর পাশেই তিনপায়া ছোট টেবিল সাজানো যাতে সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয়তে পূর্ণ। অতিথিরা আসছেন রঙিন পোশাকে, ফুলের মালা গলায়, মুখে উৎসবের হাসি। নারী-পুরুষ পাশাপাশি বসে আছেন, জ্বলজ্বল দৃশ্যমান গহনাতে নারীরা। এই দৃশ্য সে সময়কার অন্যসব সভ্যতায় ছিল বিরল। এটি এমন প্রাচীন সভ্যতা যেখানে নারী পুরুষের সমান উপস্থিতি ছিল ।
আসরের শুরু হয়, সুর, স্নেহ ও স্নিগ্ধতা দিয়ে। অর্থাৎ যখন ভোজ শুরু হয়, তখনই শুরু হয় সঙ্গীত। বাঁশির সুরে রয়েছে একধরনের ধ্যানমগ্নতা, কচ্ছপের খোলের তৈরি বাদ্যযন্ত্রে বেজে ওঠে মৃদু ঝঙ্কার, আর মৃদঙ্গের টুংটাং শব্দের ছন্দে আন্দোলিত হয় সেই পরিবেশ। দাসেরা দিচ্ছে পিপাসা মেটানো পানীয়, পরিবেশন করছে নানা বাহারী খাবার—শুধু খাবার নয়, যেন তা ছিল এক শিল্প।
অতিথিদের সামনে মাংসের বিশাল ভাণ্ডার। গরু, হরিণ, শূকর, খরগোশ, পাখি, আবার পাশাপাশি রাখা আছে টুনা মাছ, জলপাই, কিশমিশ, বাদাম, রুটি, পনির আর সুস্বাদু সবজি। কিছু রান্না এসেছে স্থানীয় কৃষকের ক্ষেতের ফসল থেকে। কিছু এসেছে বহু দূরের দেশ ফিনিসিয়া, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা থেকে। আর আছে উৎকৃষ্ট মানের মদ। এটি তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাই উৎপাদন করত, আবার অন্য দেশেও রপ্তানি করে তারা হয়েছিল বিত্তশালী ।

এট্রুসকানদের উৎসবমুখর ভোজের দৃশ্য © The British Museum
এই ভোজসভা শুধু বিলাসিতার জন্য ছিল না, ছিল এক ধরণের রাজনৈতিক মঞ্চও। শাসকেরা জানতেন, আনন্দ ছড়িয়ে দিলে প্রজাদের মন জেতা যায়। তাই এই ভোজে আমন্ত্রণ পেতেন সেখানের শক্তিশালী সব পরিবার, বিশ্বস্ত অনুগত, এমনকি সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীও। বড় ভোজ মানেই বড় বার্তা” আমরা আছি, আমরা শক্তিশালী, আমাদের সঙ্গে থাকো।”
আজ, হাজার বছর পরে, আমরা এই ভোজের দৃশ্য দেখতে পাই সমাধির দেয়ালে আঁকা চিত্রে। তার্কুইনিয়ার “সিংহী সমাধি”। বস্তুত সেখানে আসলে দুটি প্যান্থার পাহারা দিচ্ছে এক পানভোজের দৃশ্য। ছাদের উপর চেকার বোর্ডের মতো নকশা, পাশে ছয়টি রঙিন কাঠের স্তম্ভ। মনে হচ্ছে তাঁবু, বা কোনো প্রাচীন খোলা মাঠে চলছে এই আয়োজন। দেওয়াল চিত্রের এই গল্প আমাদের তাদের জীবনকে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।
চিউসির “বানর সমাধি”-তে দেখা যায় মাথায় ধূপদানি রেখে মহিলা নাচছেন , আর চারপাশে পানভোজীরা খেলছে গ্রিক খেলা ‘কোত্তাবোস’। যেখানে পানপাত্রের শেষ অংশ ছুড়ে ফেলা হয় এক কলসির মধ্যে। হাসি, হুল্লোড়, চিৎকার সব যেন সেই আঁকা ছবিত থেকে শোনা যাচ্ছে। আর ওরভিয়েতোর গোলিনি সমাধিতে? সেখানে রান্নাঘরের ছবি, দাসেরা ব্যস্ত, কেউ মাংস কাটছে, কেউ আটা মাখছে, আবার একজন বাঁশি বাজাচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে। কেবল ভোজের টেবিল নয়, তার পেছনের প্রস্তুতিও তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
শুধু দেয়ালেই নয়, পাথরের শবাধারে বা কবরের ফলকে খোদাই করা ভোজের দৃশ্যগুলো যেন মৃত্যুকে অতিক্রম করে জীবনের উৎসবে পৌঁছানোর চেষ্টার গল্প। অনেকেই বলেন, এসব দৃশ্য ছিল মৃতের সুখের স্মৃতি, কেউ বলেন শোকসভায় আয়োজিত ভোজের চিত্র, আবার কারো মতে, এটি ছিল পরলোকের কল্পনা, যেখানে মৃত্যুর পরও আনন্দ চলতে থাকবে, কেউ কখনো আর ক্ষুধার্ত হবে না। মৃতদের সঙ্গে রাখা হতো থালা-বাসন, পানপাত্র, কাপ, যেন তারা পরলোকে গিয়েও ভোজ চালিয়ে যেতে পারেন।

তারকুইনিয়ার এট্রুসকান ভোজীরা] — প্রাচীন ঐশ্বর্যের ছোঁয়ায় রচিত এক দৃশ্য © Wolfgang Sauber (CC BY-SA)
এট্রুসকান ভোজসভাগুলো আরেক দিক থেকে ব্যতিক্রমী। এখানে নারীরা ছিলেন পুরুষদের সঙ্গে এক আসনে সমানভাবে। তারা শুধু অতিথি ছিলেন না, অংশীদার ছিলেন আনন্দে, সুরে, পোশাকে, আলোচনায়। এ ছিল এমন এক দৃশ্য যা গ্রিক লেখকদের কাছে ছিল অচিন্তনীয়। কারণ গ্রিসে নারীরা থাকতেন গৃহবন্দি, কেবল নর্তকী বা বিনোদনদাত্রী হেতায়রাই থাকতেন ভোজসভায়। এট্রুসকানদের সমানাধিকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীর অংশগ্রহণ, তাদের সমাজকে আরও বৈচিত্রপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করেছিল।
বাণিজ্যের সুবাদে তারা সংযুক্ত ছিল পূর্বের সভ্যতার সঙ্গে ফিনিসিয়া, আয়োনিয়া, এমনকি মিশর পর্যন্ত ছিল তাদের যোগাযোগ । ফলে পোশাক, শিল্প, ভোজসভা সবকিছুতেই তাদের প্রভাব দেখা যায়। তাদের পোশাক, অলঙ্কার, আসবাব সব ছিল সূক্ষ্ম ও সৌন্দর্যে ভরপুর।

মাটির নিখুঁত শৈলীতে নির্মিত এক ভোজ পরিবেশন সেট, যেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০–৫০০ সালের পরিশীলিত নৈশভোজের নিস্তব্ধ প্রতিধ্বনি। © the Art Institute of Chicago) (CC BY-SA)
যে কারণেই হোক না কেন শাসকের কৌশল, পরলোকের কল্পনা বা সমাজের মিলনস্থল এট্রুসকান ভোজসভা ছিল শুধু খাওয়ার আসর নয়, এটি ছিল শিল্প, কূটনীতি, আনন্দ ও সম্পর্কের এক জটিল, জাঁকজমকপূর্ণ মঞ্চ। হাজার বছরের ব্যবধানেও, সমাধির দেওয়ালে আঁকা দৃশ্য, পাথরে খোদাই করা ভোজনের মুহূর্ত আর টেরাকোটার অলংকরণ দেখে আমরা আজও বুঝতে পারি এই প্রাচীন জাতি আনন্দ করতে জানত। তারা জানত জীবনের ক্ষণস্থায়ী এই যাত্রাকে কিভাবে রঙে, সুরে আর ভোজে রাঙিয়ে তুলতে হয়। ইতিহাস শুধু অতীত জানার বিষয় নয়, এটি আজকের সমাজ বুঝতে সাহায্য করে। এট্রুসকানদের ভোজসভা আমাদের শেখায়, কীভাবে খাদ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্পর্ক একসঙ্গে গড়ে তোলে এক সভ্যতার পরিচয়।

