স্বামী সদ্য সিংহাসনে বসেছেন। ভীষণ ভালো মানুষ, পড়তে পছন্দ করেন। তার বাবা তাকে সিংহাসনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেন বলে রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকেই নির্বাচিত করেন। কিন্তু না, শের শাহ সূরির শক্তির সাথে তিনি পেরে ওঠেননি। তাছাড়া ভাইয়ে ভাইয়ের মধ্যকার অন্তর কলহ সিংহাসন হারাবার জন্য অনেকটা দায়ী ছিল। শুরু হলো স্ত্রীকে নিয়ে নির্বাসিত জীবন। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে একটা পর্যায়ে আবার ফেরত আসলেন তার নিজের আস্তানা ভারতবর্ষে। জ্ঞান অন্বেষণে মন তার। ফেরত এসে লেগে গেলেন লাইব্রেরি গড়তে। সাথে আরও অনেক কিছুতে মনোযোগ দিলেন।

হুমায়ুনের সমাধি দিল্লি – মুঘল স্থাপত্য ও বাগান © wikipedia
রাজ্য পরিচালনায় মন দিলেও তিনি কিন্তু পড়ার জন্য সময় ঠিকই বের করে নিতেন। আর তার তৈরি এই লাইব্রেরির সিঁড়িতে হঠাৎ করে পড়ে যাওয়াতে একেবারেই ইহলোক ত্যাগ করলেন তিনি। বৈরাম খাঁকে ভীষণ ভালোবাসতেন। মৃত্যুর আগে তার ছেলের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খাঁকেই নির্বাচিত করে ফেলেছিলেন তিনি। তার ছেলের নাম আকবর। মৃত্যুর সময় সেই কোন দূরে তার ছেলে অবস্থান করছে। দ্রুত তার অভিষেক করাতেই হবে। তা না হলে রাষ্ট্র স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে না। ব্যস সেখানেই ঘোষিত হলো আকবরই হচ্ছে পরবর্তী সম্রাট। ছোট্ট ছেলে, মাত্র ১৩ বছর বয়স তার। তার মা চিকের পর্দার আড়ালে বসে নির্দেশনা দিতেন ও সাহায্য করতেন তাকে। মা ও ছেলের ইচ্ছে স্বামী বা বাবার জন্য মাজার করা। বিখ্যাত পারস্যবিদদেরকে নির্দেশনা দিতে শুরু করলেন তারা। পারস্যের স্থাপত্য মুঘলদেরকে মুগ্ধ করেছিল। বহুকাল ছিলেনও সেখানে তারা। নিজের চিন্তায়, ইচ্ছায় তারা তৈরি করতে শুরু করলেন হুমায়ুনের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল। কার কার কবর, আর কোথায় কবর হবে, কোথায় গাছ লাগাতে হবে, কেমন বাগান হবে সব চিন্তা করে রেখেছেন তারা। হয়তো মাঝে মাঝে মা তার স্বামীর পাশে গিয়ে কথাও বলতেন।

হুমায়ুনের সমাধিকক্ষ © wikipedia
পারস্যের নারী স্বাধীনতা প্রভাবিত করেছিল হুমায়ুনের স্ত্রীকে। সাসানিদ বা সাইরাসের শিক্ষা আছে তার মধ্যে। সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে ঘোড়ায় চড়ে স্বামীর সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। হুমায়ুনের জন্য অদ্ভুত সুন্দর এক মাজার তৈরি করলেন। ছাদের চারপাশে ঝকঝকে চারটি ছত্রি। রঙিন টাইলস দিয়ে মোড়ানো হলো। লাল এবং সাদা রং মুঘলদের খুব পছন্দের। সেই সাথে মার্বেল। এক পর্যায়ে বহু মানুষ আশ্রয় পেল এখানে।
তারপর ১৮৫৭ সালের পরে চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছি একজন বৃদ্ধ স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আহা লাল কেল্লায় আর থাকার অধিকার নাই তাদের। বন্দী করে তাদেরকে নিয়ে আসা হলো তার পূর্বসূরীদের কাছে। পূর্বসূরীদের তৈরি বিশাল আকারের প্রাসাদ, পারস্যের স্মৃতি মাখা বাগান দেখে বুক ভেঙে যাচ্ছে তার। হাজী বেগম, হামিদা বেগম। কে নেই, ফারুক সিয়ার, দারাশিকোহও এখানে শায়িত। কুরআনের প্রতিলিপি, তলোয়ার—সবই দিয়ে সাজানো হয়েছিল জায়গাটিকে। কিন্তু কিছুই থাকল না তাদের। রাজত্ব চলে যাওয়ার সাথে সাথে সম্রাটদের সম্পত্তিও সব হারিয়ে গেল।

ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ২য় বাহাদুর শাহ প্রতিকৃতি © wikipedia
আমরা কার কথা বলছি জানেন? বাহাদুর শাহ জাফরের কথাই বলছি। নত মাথায় দখলদারীদের হাতে আত্মসমর্পণ করছেন সম্রাট। এমনি কোনো এক রাতে বহু আগে দারাশিকোহও এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তার ছেলেও ছিল সাথে। আজ এত বছর পরে ক্যাপ্টেন হাডসন এসে দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই উত্তরসূরীদের হাতে হাতকড়া পরাবে বলে। সেই সময় বাহাদুর শাহ জানতে পারেননি, এমনকি বুঝতেও পারেননি, কিছুক্ষণ পরে তার চোখের সামনে তার নাতি এবং তার দুই সন্তানকে হত্যা করা হবে। কে জানে, এমন অভিজ্ঞতা তার কেমন লেগেছিল। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয় পূর্বপুরুষের কোন ঘরটিতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। কেমন লাগছিলো তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া এই বিষাদময় ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে।
মনে রাখতে হবে বহু বাস্তুহারা মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল এই হুমায়ুনের সমাধি। বহু আগে তাদের পূর্বপুরুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এই ভারতে। তারপর সময় গেল। ১৯৪৭ সাল। সেই বাস্তুচ্যুত সম্রাটদের মতই কিছু রিফিউজি বাঁচার জন্য এখানে এসে ঘাঁটি গাড়লো। হ্যাঁ, বহু স্মৃতি বুকে ধারণ করে রয়েছে এই হুমায়ুনের সমাধি। হয়তো কবরে শায়িত হুমায়ুন তাদেরকেই নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন।