কাগজের আবিস্কারক যদিও মুসলমানরা নয়, কিন্তু মুসলিম সভ্যতার বিকাশে কাগজশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য্। আরো মজার বিষয় হলো, মুসলমানরাই ইউরোপসহ সারা বিশ্বের কাছে কাগজকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সেটা কীভাবে? এখন আমরা সেই আলোচনাই করবো। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের দিকে যদিও চীনারা কাগজ আবিষ্কার করে তবে চীনারা সেটা গোপন রাখে এবং চীনের মধ্যেই সীমিত আকারে ব্যবহার করে। বাইরের দুনিয়া এই বিষয়ে কিছুই জানতো না। তারপর মুসলমানরা যখন কাগজ বানানোর পদ্ধতি শেখে এবং মুসলিম এলাকাগুলোতে কাগজ বানানোর কারখানা তৈরি করে তখন বিশ্ব সভ্যতার এক নবজাগরণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে মুসলমানরা কুরআন ও হাদিসের বই লেখার পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, প্রকৌশল, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে থাকে।
৮ম শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় ইসলামের সোনালী যুগ। এ সময়ে মুসলিমরা সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেছিল। অন্যদিকে তখন ইউরোপে চলছিল অন্ধকার যুগ। সেই সময়েই মুসলমানরা কাগজকে এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছে দেয়, যা পরবর্তীতে ইউরোপের রেঁনেসার সূচনা করে। দুঃখের বিষয় হলো!! আজ সেই মুসলমানরাই ইউরোপে সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার এবং অবাঞ্চিত-উপেক্ষিত। এছাড়া সারা দুনিয়ায় মুসলমানরা অন্যান্য সকলের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সবদিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। চলুন তাহলে আমরা ঘুরে আসি ইতিহাসের পেছনে গিয়ে, কীভাবে ইউরোপে কাগজকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মুসলমানরা।
ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমরা ঈমান ও আত্মবিশ্বাসের বলে বিশ্বকে জয় করেছিলেন। তারা বিজিত এলাকার জ্ঞান-বিজ্ঞানকে উদারতার সাথে গ্রহণ করে নিজেদেরকে আরো উন্নত করে গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে আব্বাসীয় শাসনামলে মুসলিম মনীষীরা প্রাচীন গ্রিক, ভারতীয় এবং চীনা শাস্ত্র চর্চা করে নিজেদেরকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যান। এসবের পেছনে সবচেয়ে বিরাট ভূমিকা ছিল কাগজ শিল্পের। কাগজ আবিষ্কার হওয়ার আগে লেখালেখি করা, তথ্য সংরক্ষণ করা ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। প্যাপিরাস থেকে পেপার শব্দটি এসেছে এবং চীনা ‘গু জি’ শব্দ থেকে কাগজ শব্দটি এসেছে। চীনে প্রথম কাগজ আবিস্কার হলেও আটশো বছর চীনের বাইরে কেউ তা জানতো না। তারাও তেমনভাবে বই-পুস্তক বা, সরকারি কাজে কাগজ ব্যবহার করতো না। চীনের খুব অল্প সংখ্যক লোক কাগজ বানাতে দক্ষ ছিল এবং নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে কড়া পাহাড়ায় রাখা হতো। প্রাচীনকাল থেকেই চীনের সাথে আরব বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালু ছিল। সেইসূত্রে আরব বণিকরা কাগজের কথা কিছুটা জানতো, কিন্তু কাগজ তৈরির পদ্ধতি জানতো না। তাদের কাছেও এটা নিয়ে বেশ রহস্যই ছিল। ৮ম শতকে আব্বাসীয় খিলাফতের শাসন শুরু হলে তারা বিশ্বের চারদিকে আরো ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বাইজান্টাইন জয় করে গ্রীক-রোমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে আরো পরিচিত করে তোলে।
তখন সময়টা ৭৫১ সাল। বর্তমান কিরঘিস্তান-কাজাকস্তান সীমান্তের তালাস নদীর কাছে চীনের হান রাজবংশের সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের একটি ছোট যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘তালাস নদীর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধই মুসলিম সভ্যতার জন্য বয়ে আনে এক অকল্পনীয় ব্যাপার। যুদ্ধে চীনা বাহিনী পরাজিত হলে মুসলিমরা চীনে প্রবেশ করে। এই যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বহু চীনা সেনা বন্দী হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল কাগজ তৈরির অত্যন্ত দক্ষ কারিগর। সেই কারিগরদের কাছ থেকেই মুসলমানরা কাগজ বানানোর পদ্ধতি শিখেছিল। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই মুসলমানরা জ্ঞানী বন্দীদেরকে সাধারণ বন্দীদের থেকে ভিন্ন ব্যবস্থা করতো। ইসলামের প্রথম যুদ্ধেই শিক্ষিত বন্দীদেরকে মুক্তিপণ হিসেবে মদীনার ১০ জন নিরক্ষর ব্যক্তিকে পড়ালেখা শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্যবস্থা আব্বাসীয় আমলেও চালু ছিল। সেই রীতি অনুসারে, তালাস নদীর যুদ্ধে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া জানা কারিগর দুজনকে আলাদাভাবে আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী কুফায় পাঠানো হয়েছিল। সেখানেই তাদের কাছ থেকে মুসলমানরা প্রথম কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া শেখে। ৮০০ বছর ধরে গোপন করে রাখা চীনের কাগজের প্রযুক্তি এভাবে বাইরের দুনিয়ার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। মুসলমানরা এর মাধ্যমে খুব অল্প দিনের মধ্যেই লেখার জগতে অভাবনীয় উন্নতি করে।
তখন ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের দ্বিতীয় খলিফা আল-মানসুরের শাসনামল (৭৫৪ থেকে ৭৭৫ সাল পর্যন্ত)। খলিফা আল-মানসুর দেশের সব কাজে কাগজ ব্যবহারের হুকুম জারি করেন। ফলে কাগজ কল তৈরির ধুম পড়ে গেল। রাজধানী বাগদাদ সহ দামেস্ক, লেবাননের ত্রিপলী, হামা, মানবিজ প্রমুখ শহরে কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হলো। ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ১৪ শতকে শুধুমাত্র মরক্কোর ফেজ শহরেই প্রায় ৪০০টি কাগজের কারখানা ছিল।
আরবীতে কাগজকে ‘কাঘাদ’ বলে। কয়েক দশকের মধ্যেই মুসলমানরা চীনাদের চেয়েও উন্নত মানের কাগজ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেলে। এর ফলে, মুসলিম সাম্রাজ্যে এক বিপ্লবী পরিবর্তন সূচিত হয়। কাগজে লেখা বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আগে প্যাপিরাস, চামড়া প্রভৃতির উপর লিখতে হতো বলে বইয়ের আকার হতো অনেক বড় বড় আকারের। বিশাল ভারী বই বহন করাও ছিল কষ্টকর। তাছাড়া সেগুলো সংরক্ষণ করাও ছিল বেশ কঠিন। অন্যদিকে কাগজের বই সহজে বহনযোগ্য। মুসলমানদের হাত ধরেই প্রথম কাগজের তৈরি মলাট বিশিষ্ট ও একপাশে বাঁধাই করা বই তৈরি শুরু হয়। এমনকি এখনও পর্যন্ত আমরা যে ৫০০ পৃষ্ঠার কাগজের বান্ডিলকে ‘রীম’ বলি, সেই শব্দটিও আরবি শব্দ ‘রিজমা’ থেকে এসেছে। প্রশাসনিক কাজে এবং কুরআন শরীফের অনুলিপি তৈরি করার কাজে কাগজ ব্যবহারের পাশাপাশি মুসলিম মনীষীরা বিভিন্ন ভাষার মূল্যবান সব পান্ডুলিপি কাগজের বইয়ে অনুবাদসহ বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করেন। এসবের ফলেই খলিফা হারুন অর-রশিদের পুত্র আল-মামুনের সময় ৮৩০ সালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র বাইতুল হিকমাহ। যা মুসলমানরদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম করেছিল।
এবার বাগদাদ ও দামেস্কের বাইরে আফ্রিকায় সর্বপ্রথম কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয় মিসরে ৮৫০ সালে মুসলমানদের হাত ধরে । তারপর মুসলমানদের মাধ্যমে মিসর থেকে আরো পশ্চিমে মরক্কো হয়ে একাদশ শতাব্দীতে কাগজ নির্মাণ প্রক্রিয়া পৌঁছে যায় ইউরোপের স্পেনে। সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের মাধ্যমে মুসলমানরা স্পেন জয় করে ৭১১ সালে। তারপর স্পেনে মুসলমানরা শাসন করতে থাকে কয়েকশো বছর। সেই সময় তারা স্পেনের ইয়াতিভা শহরে কাগজের কল তৈরি করে। এখান থেকেই ইউরোপে কাগজের যাত্রা শুরু হয়। ইউরোপে প্রথম যে কাগজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তা ছিল মুসলিম নিয়ন্ত্রিত স্পেনের ইয়াতিভা শহরের কাগজের কল থেকে আমদানি করা একাদশ শতকের। আজও ১১ শতকের পূর্বে ইউরোপে কাগজে লেখা কোনো বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায় নি। এমনকি ইউরোপে কাগজ পরিচিত ছিল ‘চার্টা ডেমাস্কেনা’ নামে, যার অর্থ দামেস্কীয় কাগজ।
প্রকৃতপক্ষে, খ্রিষ্ঠান ইউরোপীয়রা প্রথম কাগজের কলের সাথে যুক্ত হয় প্রথম ক্রুসেডের পর মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুজালেমসহ আশেপাশের এলাকা দখল করার পর। কিন্তু তখনও তারা কাগজ তৈরি করা শিখতে পারেনি। ১২৪৪ সালে ইউরোপীয়ানরা মুসলমানদেরকে পরাজিত করে স্পেনের ইয়াতিভা দখল করে নিলে সেখানকার কাগজ কলটির মুসলমান কারিগরদের কাছ থেকে ইউরোপীয়ানরা কাগজ তৈরির কৌশল শিখেছিল। কাছাকাছি সময়ে ইতালির নিকটবর্তী সিসিলিও রোমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং সেখানে মুসলমানদের স্থাপিত কাগজের কলটি থেকে তারাও কাগজ তৈরির কৌশল শেখে।
মুসলমানদের কাছ থেকে কাগজ নির্মাণ শেখার পর ইতালিয়ানরা সেটার আরো উন্নতি সাধন করেছিল। ইতালির নদীগুলোর তীরে স্থাপিত কাগজের কলগুলোতে নদীর পানির স্রোতের প্রচন্ড শক্তিকে ব্যবহার করে আরো উন্নত মানের কাগজ তৈরি করতে শুরু করে তারা। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই ইতালিয়ানরা কাগজের গুণগত মানের দিক থেকে মুসলমানদের প্রযুক্তিকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে এবং ১৪ শতকে তারা কাগজ উৎপাদনে এতই চমৎকারিত্ব অর্জন করে যে, তারা আরব দেশগুলোতে পাল্টা কাগজ রপ্তানি শুরু করে। এর মাধ্যমেই এশিয়া থেকে ইউরোপ এবং সেখান থেকে কাগজ নির্মাণ শিল্প পৌঁছে যায় নতুন আবিষ্কৃত আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কাগজের সহজলভ্যতায় ইউরোপে জ্ঞান চর্চা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইউরোপ প্রবেশ করে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের যুগে। মুসলিমরাই ইউরোপীয় সভ্যতার অগ্রযাত্রার সূচনা করে দিয়েছিল।
এরপর ইওহানেস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা ছিল একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। ১৪৩৯ সালে তিনি ও তার বন্ধু অ্যান্দ্রিয়াস ড্রিটজেন মিলে প্রথম প্রিন্টিং প্রেস নির্মাণ করেন। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার ছিল কাগজশিল্পের বিকাশেরই আরেকটি উন্নত ধাপ। অ্যান্দ্রিয়াস ড্রিটজেন নিজেও ছিলেন একটি কাগজ কলের মালিক। ইউরোপের নবজাগরণের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই সমগ্র ইউরোপে প্রিন্টিং প্রেস প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। মাত্র একশ বছরের মধ্যে অন্তত তিনশটি ইউরোপীয় শহরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল এবং অন্তত দুই কোটি কপি বই ছাপা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপ এ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে। নিউটন, গ্যালিলিও, দান্তেদের আবির্ভাব ঘটে এবং গড়ে ওঠে ভবিষ্যত পৃথিবীর এক নতুন শিক্ষিত জাতি। শুরু হলো ইউরোপের রেঁনেসা। যেখানে মুসলিমদের অবদান অনস্বীকার্য্য।