আকারে অতি ক্ষুদ্র, মাত্র ১৯ সেন্টিমিটার লম্বা আর ১০ সেন্টিমিটার চওড়া এই ছোট্ট ব্রোঞ্জের বাক্সটি হাতে ধরে রাখা যায় খুব সহজেই। অথচ এই ক্ষুদ্র মঞ্জুষার মধ্যে লুকানো ছিল গৌতম বুদ্ধের অমূল্য দেহাবশেষ—এক অসাধারণ ঐতিহ্য, যা সময়ের বিবর্ণতার মাঝেও অম্লান।
বাক্সটি যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেই স্থান কোনো বিখ্যাত শহর বা তীর্থ নয়। আজ সেখানে কেবল একটি নিস্তব্ধ ঢিবি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এক সময় সেই নির্জন ঢিবিই ছিল প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধানের কেন্দ্র। খননের পর বেরিয়ে আসে বহু নিদর্শন, যা কুষাণ সাম্রাজ্যের বৌদ্ধ শিল্প ও ঐতিহ্যের কথা বলে। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে কুষাণরা উত্তর ভারত ও বর্তমান পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছিল।
কুষাণরা এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে। হুনদের আক্রমণে তারা ভিটেমাটি হারিয়ে উজবেকিস্তানের আমু দরিয়ার উপত্যকায় বসতি গড়ে তোলে। পরে রাজপুত্র কোজোলা কাদফিস (খ্রিস্টীয় ১৫–৭০) আফগানিস্তান, গান্ধার ও সোয়াত উপত্যকা জয় করে কুষাণ সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। সাম্রাজ্যের শক্তি ও ঐশ্বর্য তার শিখরে পৌঁছায় সম্রাট কনিষ্কের (৭৮–১৪৪ খ্রি.) শাসনকালে। তখন সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল উজবেকিস্তান থেকে ভগলপুর, আর আফগানিস্তান থেকে সাঁচি পর্যন্ত। রাজধানী ছিল পুরুষপুর (বর্তমান পেশোয়ার) ও মথুরা।

১৮৯৯ খোদাইতে কনিষ্ক স্তূপের অবশিষ্টাংশ দেখানো হয়েছে সাজি-কি-ধেরি © wikipedia
কনিষ্ক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের মহান পৃষ্ঠপোষক। তার আমলেই মহাযান সম্প্রদায়ের জন্ম হয় এবং গান্ধার ও মথুরা শিল্পধারা বিকশিত হয়। গান্ধার শিল্পে গ্রিক ছাপ স্পষ্ট, অন্যদিকে মথুরার শিল্পে দেশীয় রূপকল্প প্রধান। কনিষ্ক এক বিশাল স্তূপও নির্মাণ করেছিলেন, যদিও তার সঠিক অবস্থান আজ অজানা। তবে চীনা ভ্রমণকারীরা এই স্তূপের উল্লেখ করেছেন। স্থানীয় কাহিনি বলে, কনিষ্ক বুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। স্তূপ বারবার ধসে পড়লেও তা পুনর্নির্মাণ করা হতো।
চীনের দুনহুয়াং-এর একটি কাহিনী বলেছে, চারজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা কনিষ্কের কাছে বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা জানান। সেখানে বলা হয়েছিল, সম্রাটকে অবশ্যই একটি বিশাল স্তূপ গড়তে হবে, যেখানে বুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ রাখা হবে।
৬ষ্ঠ শতকে চীনা ভ্রমণকারী সুং ইউন স্তূপের বর্ণনা দেন। তার মতে, স্তূপটির উচ্চতা প্রায় ৭০০ ফুট। কাঠের খোদাই করা স্তম্ভে দাঁড়ানো এই স্তূপের ভিতরে ছিল সিঁড়ি, মণ্ডপ, আর উপরে লোহার স্তম্ভ। বজ্রপাত ও ভূমিকম্পে এটি বহুবার ধ্বংস হলেও পুনর্নির্মাণ করা হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি অন্তত চারবার গড়ে তোলা হয়েছিল।
কালের প্রবাহে নবম–দশম শতকে ইসলামের আগমন হলে এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম ক্রমে বিলীন হয়। মানুষ ক্রমেই ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। শতাব্দী পরে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের উদ্যোগে আবার নতুন করে আবিষ্কৃত হয় বৌদ্ধ ঐতিহ্য।
১৯০৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক ডেভিড ব্রেনার্ড খনন করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন সেই বিখ্যাত ব্রোঞ্জের বাক্স। শক্তভাবে বন্ধ ঢাকনায় খোদাই করা ছিল বুদ্ধমূর্তি, চারপাশে ইন্দ্র ও ব্রহ্মা। পদ্মাসনে বসা বুদ্ধ এক হাতে অভয় মুদ্রা, অন্য হাতে পোশাকের প্রান্ত ধরে আছেন। চারপাশে উড়ন্ত রাজহাঁস, যা গ্রিক শিল্পশৈলীর ছাপ স্পষ্ট।
খোদাই করা কনিষ্কের কাসকেট কনিষ্ক স্তূপের স্থানে পাওয়া যায় এবং রয়েছে অবশেষ বুদ্ধের, এখন মধ্যে পেশোয়ার জাদুঘর, পাকিস্তান, যখন ধ্বংসাবশেষ আছে মান্দালে, বার্মা। © wikipedia
বাক্সে আরও দেখা যায় কনিষ্কের প্রতিকৃতি, সূর্য ও চন্দ্র দেবতা, আর ধ্যানরত বুদ্ধের ছবি। খরোষ্ঠী লিপির শিলালিপি জানায়, এটি কনিষ্কের প্রথম রাজবর্ষেই নির্মিত। এক শিলালিপিতে এমনকি আগিসালা নামের এক গ্রীক শিল্পীরও উল্লেখ রয়েছে।
বাক্সের ভেতরে তিনটি অস্থি পাওয়া গিয়েছিল, যা হুয়েন সাং-এর মতে বুদ্ধের অবশেষ। ব্রিটিশরা সেগুলো ১৯১০ সালে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বার্মার মান্দালেতে পাঠায়, আজও সেখানে সংরক্ষিত আছে।
কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ নয়। পেশোয়ার জাদুঘরের বাক্সটি আসল, নাকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের—এ নিয়ে বিতর্ক আজও চলমান। কেউ বলেন দুটোই আসল, কেউ বলেন দুটোই নকল। আবার কারও মতে, আসল বাক্সটি কোথাও হারিয়ে গেছে।
একসময় পেশোয়ারের স্তূপ ছিল বিশ্বজোড়া আলোচনার কেন্দ্র, আজ তা প্রায় বিস্মৃত। শুধু বাক্সটির কপি টিকে আছে, স্তূপের কোনো চিহ্ন আর নেই।
তবুও কনিষ্কের এই ক্ষুদ্র বাকসো আজও বিস্ময় জাগায়। এর ভেতরে লুকানো আছে কেবল শিল্প নয়, ইতিহাস, ধর্ম আর এক অমোঘ রহস্যের দীর্ঘ গল্প—যা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়েও অম্লান রয়ে গেছে।