আমরা অনেকেই ছোটবেলায় নিজামউদ্দিন ডাকাতের সম্বন্ধে একটি গল্প শুনেছি, সেখানে তিনি ৯৯ জন লোক খুন করার পর আউলিয়া হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সেটা আদতে অন্যান্য কল্পকাহিনীর মতো বানানো, স্থানীয়রা এমনটাই দাবি করেছেন।নিজামউদ্দিন আউলিয়া উঠতি বয়সেই সুফি মতবাদের আদর্শ মেনে চলতেন, এবং তা চর্চা করে আধ্যাত্মিকতা লাভ করেছিলেন। তিনি আদতে কোনো খুন করেননি। পাক-ভারত উপমহাদেশে যাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
ভারতীয় উপমহাদেশে যে কজন সাধক এসে সুফি মতবাদ জনপ্রিয় করেছেন, নিজামউদ্দিন আউলিয়া তাদের মধ্যে একজন। চিশতিয়া তরিকার সুফি সাধক ছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদরা বলেন, তৎকালীন দিল্লিবাসীর ওপর ব্যক্তিত্বের জাদু নিয়ে নিজামউদ্দিন আউলিয়া প্রবল প্রভাব বিস্তার করেন এবং পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনেন।
ছোট বয়সেই হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পিতা খাজা আহমদ ইন্তেকাল করেন। তিনি মৃত্যুকালে কোনো সম্পদ রেখে যাননি। তখন তিনি ও তাঁর মাকে খুব অভাবের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। অধিকাংশ সময় অভুক্ত থাকার মতো পরিস্থিত দেখা দিত। তাঁর মা ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী এবং আল্লাহভক্ত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মায়ের কথা উল্লেখ করেছেন।মায়ের সঠিক পরিচর্যায় নিজামের লালন-পালন হয়েছে। তার মা অধিকাংশ সময় তাকে ওলি-দরবেশদের জীবনকাহিনী শুনাতেন। তিনি মোজাহেদ ও সাধকদের কাহিনি আকর্ষণীয়ভাবে বর্ণনা করতেন। নিজামের কাছে এসব কাহিনি এবাদত বলে মনে হতো। নিজাম তার মার উপদেশ বাণী গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনতেন। দিনের পর দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রোজা রাখতেন। লোকেরা বলত, নিজাম এখনো তোমার ওপর রোজা ফরজ হয়নি। নিজাম বলতেন, খাবারের চেয়ে রোজাই আমার কাছে প্রিয়।
তাঁর মা কোরআন শিক্ষার জন্য তাকে মক্তবে পাঠিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন, তাই অল্প দিনের মধ্যে কোরআন পাঠ খতম করেন ও আরবির প্রাথমিক শিক্ষা স্বল্প সময়ের মধ্যেই শেষ করেন। তিনি ফিকার কিতাব কুদুরি বদায়ুনের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আলাউদ্দিন উসুলির কাছে কোরআন খতম করেন। উপমহাদেশে যাদের ত্যাগ, শ্রম ও আধ্যাত্মিকতার বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষ দীনের সন্ধান পেয়েছেন তারমধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন অন্যতম। জীবদ্দশায় কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে পথভ্রষ্ট লাখো মানুষকে হেদায়েত করে গেছেন। শেখ খাজা সৈয়দ মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক। তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়া নামেই জনপ্রিয়। তাঁর গুরু ছিলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার। তিনি ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাদায়ুনে ১২৩৮ সালের ৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩২৫ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে তিনি দিল্লি আসেন। ২০ বছর বয়সে পাকিস্তানের পাকপাত্তান চলে যান এবং সুফি ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের কাছে সুফিবাদের দিক্ষা নেন।
তিনি চিশতিয়া তরিকার একজন সাধক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেন এবং ধীরে ধীরে হজরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠেন।মুর্শিদ বাবা ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার তাঁকে খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন।উপমহাদেশে চিশতিয়া মতাদর্শের একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক ছিলেন তিনি। পাক-ভারত উপমহাদেশে যাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। হজরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি, হজরত বাবা হাজী আলী, হজরত মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জে মোরাদাবাদী মোহাজের মাক্কিসহ অসংখ্য ওলি-আউলিয়ার পদচারণায় পথহারা কোটি কোটি মানুষ দীনের সন্ধান লাভ করেছিলেন। তৎকালীন দিল্লিবাসীর ওপর ব্যক্তিত্বের জাদু নিয়ে নিজামউদ্দিন আউলিয়া প্রবল প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হন এবং পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়া বলতেন, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ আর তাই মানুষকে ভালোবাসলেই আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন। তাঁর মতে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা মানবতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়।
ইতিহাসে নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে অনেক ঘটনার একটি হলো তৎকালীন সম্রাটের দরবার, দিল্লির সিংহাসনে তখন গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৫-১২৮৭)। যিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন এবং যার নাম শুনলে প্রজাদের ঘুম হারাম হয়ে যেত।সেই সম্রাটের দরবারে আসামি করা হয়েছিল নিজামউদ্দিনকে। অভিযোগ ছিল, মুসলমান ও বিধর্মীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেন না তিনি, শরিয়তের আইন না মেনে খামখেয়ালি করেন।নিজামউদ্দিন সব অভিযোগই খন্ডন করলেন। বললেন, হে সুলতান, এ কথা সত্য যে, আমি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান কারও মধ্যে ভেদাভেদ করি না। কারণ আল্লাহর জমিনে সবাই তার বান্দা, আদম সন্তান। একথার পর কেউ কেউ অভিযোগ করলেন যে, নিজামউদ্দিন মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে প্রেমের কথা বলেন। জবাবে নিজামউদ্দিন বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই সেই ঘুঘুর গল্প জানেন, যে তার সঙ্গীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি। পুরুষ ঘুঘু আবেগে বলেছিল, তুমি যদি নিজেকে সমর্পণ না কর তাহলে আমি বাদশাহ সোলায়মানের সিংহাসন উল্টে দেব। তার কথা বায়ুতাড়িত হয়ে বাদশাহ সোলায়মানের দরবারে পৌঁছলে বাদশাহ সেই ঘুঘুকে ডেকে পাঠান। ঘুঘু বলেছিল, ‘হে আল্লাহর বান্দা, প্রেমিক-প্রেমিকার কথার কোনো ব্যাখ্যা আশা করা উচিত নয়।’ ঘুঘুর উত্তরে বাদশাহ সোলায়মান খুশি হয়েছিলেন। এরপর তিনি বলেন,আমিও আশা করি আমার উত্তরে সুলতান বলবন সন্তুষ্ট হবেন।’ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কথা শুনে সম্রাটের দরবারে উপস্থিত সবাই বাহ বাহ করে উঠেন।
জিয়াউদ্দিন বারানি নামের চৌদ্দ শতকের একজন ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, দিল্লির মুসলমানদের ওপর তাঁর এমনই প্রভাব ছিল যে, পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্মিক ইবাদতের প্রতি মনোযোগী এবং দুনিয়াদারীর চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। কথিত আছে যে, হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক এলেম ছিল অনেক উঁচুস্তরের। উপমহাদেশের লাখো লাখো মানুষকে হেদায়েত করে গেছেন তিনি। উপমহাদেশের লাখো লাখো মানুষ হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে যান। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিজামউদ্দিনের দরগাহে প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার মুসলমানসহ, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আসেন। খাজা-ই-হিন্দ হজরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের পূর্বে দিল্লিতে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার শরিফ জিয়ারত করার একটা নিয়মও প্রচলিত আছে। প্রতি বছর আরবি ১৭ রবিউস সানি দিল্লিতে তাঁর মাজার শরিফে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃতু্বার্ষিকী পালিত হয়।
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার প্রায় ৬০০-এর বেশি শিষ্য ছিলেন। সবাই শিষ্য হতে পারতেন না, একজন যোগ্য শিষ্যকে অংগিকার করার অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে শিষ্যত্ব দেওয়া হতো।
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কয়েকজন বিখ্যাত শিষ্য হলেন নাসিরউদ্দিন চিরাগ দেহলভি, আমির খসরু, আঁখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ, বোরহানউদ্দিন গরীব, জালালউদ্দিন ভান্ডারী, সৈয়দ মাহমুদ কাশকিনাকার, আজান ফকির প্রমুখ। সবার মধ্যে আমির খসরু ছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। তিনি তার এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, একদিন নিজামউদ্দিন আউলিয়া বলেন, ‘যদি শরিয়ত আমাকে অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সঙ্গে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম।’ তিনি আরও বলেন, কেউ যদি আমার রওজা (সমাধিস্থল) জিয়ারত করতে আসে, তাহলে সে যেন প্রথমে আমির খসরুর রওজা আগে জিয়ারত করে পরে তাঁর রওজা জিয়ারত করে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পরলোকগমনের কয়েক মাস পর আমির খসরুও পরলোকগমন করেন। তাঁকে তার পীরের পায়ের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ছিলেন আমির খসরু। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গায়ক, সুফি, দার্শনিক ও যোদ্ধা। প্রধানত ফার্সি ও হিন্দি ভাষায় তিনি গান ও কবিতা লিখতেন। অসাধারণ গান ও কবিতার মাধ্যমে তিনি ভক্তদের কাছ থেকে উপাধি পেয়েছিলেন ‘তুত-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা পাখি’ হিসেবে। আমির খসরু একই সঙ্গে তুর্কি, ইরানি এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন।
নিজামউদ্দিন আউলিয়া বংশগত দিক থেকে ছিলেন হজরত আলী (রা.)-এর উত্তরসূরি। তার মৃত্যুর পর ফিরোজ শাহ তুঘলক কবরে সমাধিসৌধ নির্মাণ করলেও পরে তা অবলুপ্ত হয়। এরপর ১৫৬২-৬৩ সালে ফরিদ খান নামে এক ধনী আর একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন যা বর্তমানের দরগাহ শরিফের মতো বলে মানেন স্থানীয়রা। তারা আরও বিশ্বাস করেন হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া আধ্যাত্মিক এলেমে এতই উঁচুস্তরের ছিলেন যে, ভালো যে কোনো নিয়তে তার দরবারে গেলে এই ওলি-আউলিয়ার ওছিলায় মহান আল্লাহতাআলা তার মনোবাসনা পূর্ণ করে দেন।
বাংলাদেশের সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে আমরা যে জালালি কবুতর দেখতে পাই তা দিয়েছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। অনেক ইতিহাস বইয়ে এ বিষয়ে লেখা আছে। হজরত শাহজালাল (রহ.) ভারতবর্ষ সফরকালে দিল্লিতে এসেছিলেন।দিল্লিতে পৌঁছার পর হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া জানতে পারলেন তার এলাকায় একজন দরবেশ সুদূর ইয়েমেন থেকে এসেছেন, যার সঙ্গে অনেক শিষ্যও রয়েছেন। এরপর নিজামউদ্দিন আউলিয়া তার এক শিষ্যকে পাঠিয়ে হজরত শাহজালাল রহ.) কে তার দরবারে আমন্ত্রণ জানান।দিল্লিতে হজরত শাহজালাল (রহ.) যতদিন ছিলেন ততদিন হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) দরবারে শিষ্যদের নিয়ে অবস্থান করেন।
দিল্লি থেকে সিলেটের দিকে আসার সময় হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া হজরত শাহজালাল (রহ.)কে একজোড়া কবুতর উপহার দেন। সেই কবুতরই ‘জালালি কবুতর’ নামে পরিচিতি পায় সর্বত্র। এই জালালি কবুতরই সিলেট ও বিভিন্ন জেলায় সর্বত্র মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়।আদতে এই কবুতর জোড়া এসেছিল দিল্লি থেকেই।