এজিয়ান সাগরের ঢেউয়ের মতোই বদলে গেছে সভ্যতার ইতিহাস। তারই আলো ছড়ানো দুই অধ্যায় হলো মাইনান ও মাইসেনীয় স্থাপত্য।
মাইনানদের উত্থান : ইউরোপের প্রথম উন্নত সমাজ
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে এজিয়ান সাগরের মাঝখানে ক্রিট দ্বীপে জন্ম নেয় এক অসাধারণ সভ্যতা—মাইনোয়ান সভ্যতা। পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আর্থার ইভান্স গ্রিক পুরাণের রাজা মিনোস-এর নাম অনুসারে এর নাম দেন Minoan Civilization। মাইনোয়ানদের নৌ-শক্তিশালী ছিল ইর্ষা করার মত। তারা শুধু সমুদ্রপথে বাণিজ্যই করেনি, খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ পর্যন্ত সমগ্র এজিয়ান সাগরকে নিজেদের বাণিজ্য সাম্রাজ্যের অধীন করে রেখেছিল। গ্রিক সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া আর শিল্পকলার ধারা এসেছে এদের কাছ থেকেই।

রাজা মাইনোসের প্রাসাদ – নসোসের ধ্বংসাশেষ
মাইনোয়ান স্থাপত্যকে “প্রাসাদ স্থাপত্য” বলা হয়। তাদের সবচাইতে চমকপ্রদ স্থাপনাগুলো ছিল প্রাসাদের মত ছিল। ক্নোসোস, মালিয়া আর ফাইস্টোস তার জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রাসাদগুলো শুধুমাত্র রাজাদের আবাসস্থলই ছিল কি না, তা আজও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। রাজপরিবারের বাসভবনসহ, রাজনীতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড—সবকিছুরই মিলনস্থল ছিল এই প্রাসাদগুলো। প্রতিটি প্রাসাদেই ছিল বিশাল খোলা আঙিনাকে, তার চারপাশে অসংখ্য কক্ষ ও করিডর। ক্নোসোস ও ফাইস্টোসের আঙিনা প্রত্নতত্ত্ববিদরা নাম দিয়েছেন “থিয়েট্রিক্যাল এরিয়া”—এখানে জনসমক্ষে ক্রীড়া, সংগীত, ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। এখানেই মাইনোয়ানদের বিখ্যাত “বুল লিপিং” খেলাটি অনুষ্ঠিত হতো। এই চিত্র তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রঙিন ফ্রেসকোতে এঁকে রেখেছে।
মাইনোয়ান প্রাসাদগুলো অনেকটাই নিকটপ্রাচ্যের সমকালীন মন্দিরগুলোর মতো, ধ্রুপদি গ্রিক মন্দিরের সঙ্গে মিল নেই বললেই চলে। গবেষক প্রেজিওসি ও হিচককের ভাষায়— “একটি মাইনোয়ান প্রাসাদ হলো মাইনান জীবনের অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও শিল্পের মিলিত প্রতিরূপ, এগুলো দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সুর মেলিয়ে।”

মাইসেনিয়ানদের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম – রাজা অ্যাগামেমননের মুখোশ
মাইনানদের পতন, মাইসেনীয়দের উত্থান
খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ শতাব্দীতে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের ফলে ভেঙে পড়ে মাইনান সভ্যতা। এ ছাড়াও দ্বীপগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও থেরা দ্বীপের আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ বিস্ফোরণ তাদের শক্তি নষ্ট করে দেয়। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মূল ভূখণ্ডের গ্রিকভাষী জনগোষ্ঠী—মাইসেনীয়রা—ক্রিট দখল করে নেয় (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ অব্দে) এরপর দ্রুত সমগ্র এজিয়ান অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০–১২৩০ অব্দে পেলোপনিস উপদ্বীপের পাইলোস নগরে মাইসেনীয়রা তৈরি করে এক বিরাট প্রাসাদ। ঐ প্রাসাদ মাইসেনীয় স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এখানে চারটি ভবন ছিল, একটি ছিল দুইতলা। আঙিনার পূর্ব দিকে ছিল রাজসিংহাসন কক্ষ, আর এর সঙ্গে যুক্ত ছিল মেগারন। মেগারন হচ্ছে প্রাসাদের মধ্যে একটি বৃহৎ প্রাঙ্গণ, এটি গ্রীসের ব্রোঞ্জ যুগের প্রায় সব প্রাসাদেরই বৈশিষ্ট্য। পাইলোস থেকে পাওয়া লিনিয়ার লিপির ফলক প্রমাণ করে এ স্থানটি সত্যিই রাজপ্রাসাদ ছিল। একই ধরনের প্রাসাদ মাইসিনি, তিরিন্থস এমনকি ক্রিটের ক্নোসোসেও পাওয়া গেছে। তাদের নির্মাণকৌশলও ছিল মাইনান স্থপতিদের দ্বারা প্রভাবিত। ভেতরের দেয়াল কাঠ দিয়ে বানানো হত ও পাথর দিয়ে মুড়ে দেয়া হত। সেই সাথে বাইরের দেয়ালে বসানো হতো সুন্দর করে কাটা চুনাপাথর দিয়ে তৈরি টাইলস বা ব্লক। ব্লকগুলো “V” আকৃতিতে কেটে আবার এমনভাবে জোড়া দেওয়া হতো, যাতে শক্তি আর সৌন্দর্য দুই-ই বজায় থাকে।

ল্যাবিরিন্থ – যার মধ্যে মাইনোটরকে আটকিয়ে রাখা হত
থোলস সমাধি : মৌচাকের বিস্ময়
প্রাসাদের পাশাপাশি মাইসেনীয় স্থাপত্যের সবচেয়ে চমকপ্রদ নিদর্শন হলো থোলস সমাধি। এগুলো ছিল গোলাকার গম্বুজাকৃতি সমাধি, যা দূর থেকে দেখলে সারি সারি মৌচাক বলে মনে হতো। সবচেয়ে বিখ্যাত হল থোলস সমাধি। “অ্যাট্রেয়াসের ধনভাণ্ডার” (Treasury of Atreus)। পাহাড় কেটে তৈরি করা এই বিশাল সমাধির ব্যাস প্রায় ৫০ ফুট এবং লম্বায় ১১৮ ফুট। ধারণা করা হয় এটি রাজা অ্যাট্রেয়াসের সমাধি, যদিও কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি এই বস্তুটাকে নিশ্চিত করতে। সম্ভবত এটি কোনো মাইসেনীয় রাজপরিবারের বিশাল কবর ছিল। এভাবেই এজিয়ান জগতের মাইনান ও মাইসেনীয় সভ্যতা স্থাপত্যে রেখে গেছে এক অনন্য বিস্ময়।
করবেল খিলান, অ্যাট্রিয়াসের ধনভাণ্ডারের প্রবেশপথ, মাইকেনে, গ্রিস। © wikipedia

