‘পম্পেই’ নগরীর নাম তো অনেকেরই জানা। এটি এমন এক নগরী যেটি ধ্বংস হবার সময় সেখানকার মানুষেরা চোখের পলক ফেলার সময় পর্যন্ত পায় নি। মুহূর্তেই ভস্মে পরিণত হয়েছিলো পম্পেই। হঠাৎ করেই যেনো ঘুমিয়ে গেছে সবাই, আর রেখে গেছে তাদের ব্যবহৃত ঘর–বাড়ি ও আসবাবপত্র, আমাদেরকে গল্প বলার জন্য। তাদের ফেলে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো আমাদেরকে হারিয়ে নিয়ে যায় হাজার বছরের পুরনো অলিগলিতে।
পৃথিবীর প্রাচীনতম অভিজাত জনপদগুলোর একটি ছিলো এই ‘পম্পেই’ নগরী। দুই হাজার বছরের পুরনো প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি ছিলো নগরটি। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, ৭৪ সালের এক ভরদুপুরে শহরের পাশে অবস্থিত ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নেয়গিরিতে শুরু হয় এক ভয়াবহ অগ্ন্যূৎপাত, যাতে পম্পেই শহরসহ শহরের দুই লাখ অধিবাসী দিনদুপুরে মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে অন্তত ৭৫ ফুট আগ্নেয় লাভা আর ছাইভস্মের নিচে বিলীন হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক জীবন্ত কবর রচিত হয় শহরের সব মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদসম্ভারের। পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতহাসে এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ। দুই হাজার বছর আগে একটি শহরের মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিলো, সে সম্পর্কে এক বিশদ ধারণা পাওয়া সম্ভব হয় পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে। এতো বছর পরেও এই ধ্বংসাবশেষ আমাদের অন্তঃর্দৃষ্টি খুলে দেয়, ঐ শহরে বসবাসকারী মানুষগুলোকে নতুনভাবে জানতে পারি আমরা। রোম সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো এই নগরী। ৭৯৯ সালে ভিসুভিয়াস পর্বতের বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হবার আগে শহরটি ছিলো এক সমৃদ্ধ রোমান জনপদ, ছিলো এক রমরমা বাণিজ্যকেন্দ্র! কিছু দূরেই ভূমধ্যসাগর। বণিকেরা ভিড় করে এখানে আসতো নানা দেশ থেকে, চলতো পণ্য বেচাকেনা। সবার বিনোদনের জন্য শহরে গড়ে তোলা হয়েছিলো রোমান স্টেডিয়াম বা অ্যারেনা। বিশাল সব কাজ–কারবার! কিন্তু হায়! ভিসুভিয়াসের এই প্রলয়ংকারী বিস্ফোরণ কেবলমাত্র রোমান এই শহরকেই ছাই ও কয়লার আস্তরণে ঢেকে দেয় নি, বরং কি ঘটছে তা বুঝে ওঠার আগেই শহরের বাসিন্দাদেরকে মৃত্যুর কোলে ফেলে দিয়েছিলো।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এমন ভয়াবহ দুর্যোগের পরও মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো কিন্তু একরকম অলৌকিকভাবেই অক্ষত রয়ে গিয়েছিলো। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিস্ফোরণের পর ঐ এলাকাতে অক্সিজেন এবং আর্দ্রতার অভাব ঘটে। আর এর ফলেই এতো হাজার বছর পরেও সেখানকার মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলোকে আমরা অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি।
১৯৩০ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পম্পেই নগরীর ধ্বংসস্তুপ থেকে যে সমস্ত জিনিসপত্র উদ্ধার করেছিলেন তার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রত্নবস্তু নিয়ে আজ কথা বলতে চাই। এটি হচ্ছে প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে তৈরীকৃত হাতির দাঁতের একটি নগ্ন নারীমূর্তি, যেটি বর্তমানে নেপলসের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে রক্ষিত আছে। নগ্ন মূর্তিটির সম্পূর্ণ শরীর ভারী গহনা দিয়ে আবৃত। শিল্পী অদ্ভূত দক্ষতার সাথে মূর্তিটির শারীরের প্রতিটি বক্ররেখা এবং সূক্ষ্ম রূপগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন, যা হাতির দাঁত থেকে তৈরি এক অনবদ্য সৃষ্টি।
প্রশ্ন হলো, এই মূর্তিটি আসলে কার? ভারতীয় উপমহাদেশের কোন এলাকা থেকে মূর্তিটি কোনোভাবে রোমে গিয়ে পৌঁছেছে- এমন ধারণা করা হলেও সেটা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিলো। প্রথমে মূর্তিটিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর মূর্তি মনে করা হয়েছিলো। কিন্তু লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা বা পদ্মফুল না থাকাতে এটাকে অনেকে যক্ষীর মূর্তি বলে মনে করেন। যক্ষী হলো একটি পৌরাণিক চরিত্র, হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেই এর উপস্থিতি রয়েছে। এখন আসা যাক আরেকটি প্রশ্নে, এই মূর্তিটি ভারতের কোথায় তৈরী হয়েছিলো? অনেকের মতে, এটি বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গান্ধার অঞ্চলে তৈরী। এক কালে গান্ধার অত্যন্ত সমৃদ্ধ রাজ্য ছিলো। বিভিন্ন সময় খনন করার মাধ্যমে একই রকম মূর্তি সেখানেও পাওয়া গিয়েছে। আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ জয়ের পরে গ্রীকদের সংস্পর্শে আসার ফলস্বরূপ গান্ধারা হেলেনিক শিল্পের জন্য ভীষণ খ্যাতি অর্জন করেছিলো। এ ধরনের আইভরি মূর্তিগুলো প্রাথমিকভাবে দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে তৈরী বলে মনে করা হয়েছিলো। তবে জুলিও-ক্লাউডিয়ান সম্রাটদের রাজত্বকালে নাকি এই মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয় -এ নিয়ে আবারও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
এই প্রত্নবস্তুটি প্রাচীন কালের এক অতি মূল্যবান সম্পদ। দুই হাজার বছর আগে ভারত ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে যে সমৃদ্ধ বাণিজ্য সংযোগ ছিলো তার একমাত্র প্রমাণ এই মূর্তিটি। মূর্তিটির জীবনও কিন্তু ছিলো ঘটনাবহুল। হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করে এক বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে রোমের কোনো এক স্থানে সে তার আস্তানা গাড়ে। এখানেই শেষ নয়, তাকে মুখোমুখি হতে হয় এক বিশাল বিপর্যয়ের, যদিও ভাগ্যগুণে সে বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত দুটি ভিন্ন সভ্যতার মধ্যকার যোগাযোগের নিদর্শন হিসেবে মূর্তিটি আমাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। আরব সাগরের বুকে পাল-তোলা জাহাজে বর্ষার বাতাসের ঝাপটায় রোমান নাবিকদের কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সেই বিষয়ে জানা না গেলেও দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কের অকাট্য দলিল এই মূর্তিটি। সকল গবেষক ও কর্মীদেরকে স্যালুট জানাতে চাই, যারা এতো নিখুঁতভাবে মূর্তিটিকে পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।
আহ! মন ভরে যায়। এতো বছর আগেও কি অপূর্ব ছিলো হাতের কারুকাজ! কি শিল্পবোধ! কি রুচি! কতো উন্নত জীবনাচরণ! ভাবতেই অবাক লাগে!
হারিয়ে যাওয়া এক নগরীর স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে যেনো নিজেকেই হারিয়ে ফেলি। সেখানেও তো একদিন মানুষ ছিলো, কথা ছিলো, গল্প–গান–আনন্দ–উৎসব সবই ছিলো। হঠাৎ করেই সব থেমে যাওয়া। অথচ ধ্বংসের আগের মুহূর্তেও জানতে পারে নি কেউ। কে জানে, হয়তো বিষণ্ণ কোনো কিশোরী তখন আকাশ দেখছিলো, হয়তো ভাবনায় বুঁদ হয়ে কবিতা লিখছিলেন কোনো কবি, হয়তো কোনো মা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন সন্তানের মাথায়, কোনো ভাই হয়তো তার বোনকে জ্বালাতন করছিলো, কোনো প্রেমিক হয়তো তার ভালবাসার মানুষের জন্য বাঁধছিলো সুর, কোন বাবা হয়তো দিন শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তার পরিবারের কাছে। এক নিমিষেই সবটা শেষ। কি ভয়ংকর!!!