২০০৩ সালের এক সাধারণ দিন। ইংল্যান্ডের এসেক্স কাউন্টির প্রিটলওয়েল এলাকায় নতুন রাস্তা বানানোর জন্য খননকাজ চলছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা তখনও ভাবতে পারেননি, তাঁদের কোদাল আর বেলচা এমন এক রহস্যের দ্বার খুলে দেবে যা ইংল্যান্ডের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করবে। মাটির নিচে, চোখের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক অক্ষত সমাধিকক্ষ, যেখানে শুয়ে ছিলেন এক রাজবংশীয় পুরুষ, আর তাঁকে ঘিরে সাজানো ছিল সোনা, রুপা, অস্ত্রশস্ত্র আর দূরদেশ থেকে আনা নানা জিনিসপত্র।
প্রথম দর্শনেই প্রত্নতত্ত্ববিদরা বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ সমাধি নয়। মাটির নিচে বিশাল বিশাল ওক গাছ কেটে এই কাঠের কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। খাড়া মোটা তক্তা বসিয়ে ছাদটিও দেয়াল বানানো হয়েছিল। মেঝেতে ছিল কাঠের আস্তরণ। সব মিলিয়ে এই সমাধিকক্ষ তৈরি করতে অন্তত ১৩টি ওক গাছ আর শতাধিক দিনের সমপরিমাণ শ্রম লেগেছিল। একদল দক্ষ কারিগর মিলে তৈরি করেছিলেন রাজকীয় মর্যাদার উপযুক্ত সেই ঘর। মাটির ঢিবি তৈরি করে তাকে চিরকালের জন্য আড়াল করে দেয়া হয়।

সমাধি কক্ষে আসল অবস্থায় পাওয়া পানীয়ের পাত্রসমূহ Credit : MOLA
কক্ষের ভেতরে সাজানো ছিল নানা জিনিসপত্র। এক পাশে ঝুলছিল তামার তৈরি দুর্লভ পাত্র, পাশে রাখা ছিল পান পাত্র, বাটি, বালতি, এমনকি সুরের যন্ত্র ‘লিয়ার’। অন্যদিকে রাখা ছিল লোহার আসন, এক বড় টব আর একটি বাক্স, সেখানে রাখা ছিল রুপার চামচ আর ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র। যেন মৃত ব্যক্তি পরলোকে গিয়েও সম্মান আর শক্তি ধরে রাখতে পারেন তাই অস্ত্রশস্ত্রও রাখা ছিল।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল সমাধিটিতে কোনো কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। কাঠের কফিনের চারপাশে শুধু লোহার কিছু ফিটিংস পড়া ছিল। গবেষকরা ভেবেছিলেন সম্ভবত এখানে কাউকেই সমাহিত করা হয়নি। কিন্তু পরে মাইক্রোস্কোপের নিচে পাওয়া গেল ছোট্ট দাঁতের এনামেলের টুকরো। সেটি প্রমাণ করল—হ্যাঁ, এখানে এক তরুণ বা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে সমাহিত করা হয়েছিল।
প্রায় আড়াই মিটার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় এক মিটার প্রস্থের এক বিশাল কফিন রাখা ছিল সেখানে। ওজন ছিল প্রায় ১৬০ কেজি। কফিনের ভেতরে মাথার কাছে রাখা ছিল দুটি সোনার পাতের ক্রস। এমন কিছু এর আগে ইংল্যান্ডে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। বোঝা গেল, যিনি এখানে শুয়ে আছেন তিনি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

১৪০০ বছরের পুরোনো এক অনন্য রঙিন কাঠের বাক্স, যা প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের রঙ করা কাঠের কাজের একমাত্র টিকে থাকা নিদর্শ Credit : MOLA
তবে এখানেই শেষ নয়। তাঁর কোমরের অসাধারণ সুন্দর ও নিখুঁত শিল্পকর্মেরএক চওড়া সোনার বকল। তাঁর জুতার ফিতাতেও ছিল সোনার ছোট ছোট বকল। পাশে রাখা ছিল দুটি ফ্র্যাঙ্কিশ স্বর্ণমুদ্রা। মুদ্রা ও বকলের নকশা দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদরা সমাধির সময়কাল নির্ধারণ করলেন। এটি খ্রিস্টীয় ৫৮০ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে তৈরি ।
এই হিসাব থেকে বোঝা গেল, এখানে শায়িত ব্যক্তি পূর্ব স্যাক্সন রাজপরিবারের কেউ। প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো রাজা সায়বার্ট, যিনি ৬১৬ সালে মারা যান। কিন্তু পরে দেখা গেল, সময়ের হিসাবে এটি তাঁর হতে পারে না। হয়তো তিনি ছিলেন সায়বার্টের ভাই অথবা কোনো কাছের আত্মীয় যিনি খুব অল্প বয়সেই মারা যান।
সমাধিতে রাখা ক্রসচিহ্ন প্রমাণ করে তিনি খৃষ্ট ধর্মে দিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর সমাধিতে রাখা অস্ত্রশস্ত্র, সোনাদানার সাথে প্রাচীন পৌত্তলিক প্রথার সঙ্গে মেলে। মনে হচ্ছে এটি ছিল এক রূপান্তরের সময়ের প্রতিচ্ছবি, যখন পুরনো বিশ্বাস আর নতুন ধর্ম একসঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।

সমাধি থেকে পাওয়া শৈল্পিক ব্রোঞ্জ ও সোনালি অলঙ্করণে ঢাকা ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠের পাত্রের অংশবিশেষ Credit : MOLA
সমাধির ভেতরের জিনিসপত্র একেবারে বিস্ময়কর। পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে আনা হয়েছিল রূপার ফ্ল্যাগন, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে এসেছিল চামচ, পশ্চিম ব্রিটেন থেকে ঝুলন্ত বাটি, আবার কেন্ট থেকে কাচের পাত্র। এর মানে দাঁড়ায়, এই রাজপরিবার শুধু ধনীই ছিল না, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর সাংস্কৃতিক যোগসূত্রেও তারা ছিল অগ্রগণ্য। শেষে উপরে এক ঢিবি তৈরি করে তাকে চিরকালের জন্য আড়াল করে দেওয়া। সব মিলিয়ে কয়েক ডজন কারিগর দিনের পর দিন খেটেছিলেন এই কাজে।
প্রিটলওয়েলের এই আবিষ্কার বদলে দিয়েছে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের পাঠ। এত দিন মনে করা হতো পূর্ব স্যাক্সন রাজ্য খুব শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু এই সমাধি প্রমাণ করল, তারা ছিল ষষ্ঠ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী রাজ্য। তাদের রাজপরিবার খ্রিস্টান ধর্মকে গ্রহণ করে ইংল্যান্ডে নতুন যুগের সূচনা করেছিল।
আজও গবেষকরা বলেন, প্রিটলওয়েলের সমাধি যেন সাটন হু-র রাজকীয় নৌকা সমাধির অনুজ। তবে এটির বিশেষত্ব হলো এখানেই পাওয়া গেছে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিস্টান রাজপুত্রের সমাধি।

প্রিটলওয়েল রাজকীয় সমাধি-কক্ষের ভেতরে পাওয়া বস্তুগুলোর জৈব প্রমাণের ভিত্তিতে কাঠের গঠনটির একটি বিশদ পুনর্গঠন। Credit : MOLA

