আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাসের সাথে অনেক গল্প জড়িয়ে আছে। সে সব গল্পের মধ্যে কিছু থাকে সত্য, কিছু গল্প। আজ আমরা এমন একজন ব্যক্তি সম্পর্কে জানবো, যিনি যশোরকে স্বতন্ত্রভাবে শাসন করেছিলেন, যিনি বারো ভূঁইয়াদের একজন ছিলেন, যিনি অঞ্চলের উন্নতির জন্য, জনগণের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি আর কেউ নন, রাজা প্রতাপাদিত্য।

আগে যশোরের জলাভূমিগুলো জসও হারা নামে পরিচিত ছিল, যার আক্ষরিক অর্থ ছিল ‘ গৌরভ বঞ্চিত’। এই নামের পেছনে কারণ ছিল বাংলার রাজধানী গৌড়ের গৌরব পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়বে। এই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য, প্রতাপাদিত্যের বাবা। প্রতাপাদিত্যের জন্মের সময় এক জ্যোতিষ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, এক সময় প্রতাপ তার বাবাকে হত্যা করবে। একথা জানার পরেও বিক্রমাদিত্য তার ছেলেকে হত্যা করেনি। বরং তার থেকে দূর আগ্রায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত, পরবর্তীতে তার ওপরে এসে পড়েছিল।

আগ্রায় থাকাকালীন প্রতাপ সবধরনের যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করেছিল। তার বুদ্ধি ও যোগ্যতা দিয়ে সম্রাট আকবরের মন জয় করেছিলেন। সম্রাট আকবর তাকে তার বাবা বিক্রমাদিত্যের রাজ্য শাসন করা অনুমতি দেন। ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হল। প্রতাপ ফিরে এলো। তার বাবার সহ পরিবারের সবাইকে সে হত্যা করে। প্রতাপাদিত্য রাজা হওয়ার পর প্রচুর সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অসংখ্য দুর্গ মন্দির নির্মাণের সাথে সাথে তার রাজত্ব দ্রুত প্রসারিতও করে। নিজের রাজত্ব শক্তিশালী করে নিজেকে দিল্লির সম্রাট থেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং বারো ভূঁইয়াদের সাথে যোগ দেন।

রাজা হওয়ার পর ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে ধুমঘটি দুর্গ নির্মাণ করেন। তার সাফল্যের পেছনে আরেকজনের অবদান ছিল, তিনি ছিলেন বসন্ত রায়, প্রতাপাদিত্যের চাচা। মুঘলদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক স্বাধীন রাজ্য পরিচালনার সিদ্ধান্তে বসন্ত রায় বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতাপ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।

The Jessoreshwari Temple

নানা ধরনের প্রজদরদি কাজের জন্য বসন্তরায় প্রজাদের কাছে প্রিয় ছিলেন। তার এই মান প্রতাপ সহ্য করতে পারেনি। সামান্য সন্দেহের বশবর্তি হয়ে প্রতাপ বসন্ত রায় ও তার ছেলেদের হত্যা করে। ছোট ছেলে রাঘব রায় কোনমতে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রতাপাদিত্য এতটাই শক্তিশালী রাজা ছিলেন যে, অনেকে ধারণা করতো, হয়তো তার উপর কোন অলৌকিক শক্তি ছিল তাই সে এত শক্তিশালী।

তার রাজত্বকালে প্রতাপাদিত্যের রাজবাড়ী কোথায় ছিল তা অনুমান করা কঠিন ছিল। অনেকের ধারণা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরে অবস্থিত ঈশ্বরীপুর রাজবাড়ী ছিল তার বাসস্থান। কারণ এই প্রাসাদটি তৎকালীন প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যের মধ্যেই পরে। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্রের বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রাসাদটি জাঁকজমক ও মহিমা এখনো কিছুটা বজায় আছে। রাশেদের পাশেই আছে একটি পুকুর। শাহরুখ খান নাম আরেকটি ছোট প্রাসাদ ছিল।

The Shekher Tek Shibsha Temple of the Sundarbans

তার রাজত্বকালে বর্তমান সাতক্ষীরায় দামরাইল নামক একটি গ্রামে নবরত্ন মন্দিরে ঘুরতে যেতেন। আজ সেই মন্দির শুধুই ধ্বংসস্তূপ। এই মন্দিরটি ১৫৮২ সালে প্রতাপাদিত্যের বাবা বিক্রমাদিত্য নির্মাণ করেছিলেন। মজার বিষয় হলো, এই মন্দিরটি নাকি পুজো করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়নি। পরবর্তীতে এই মন্দিরটিকে সমাজ মন্দির বা সভা মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হত। বলা হয়ে থাকে নয়জন জ্ঞানী মানুষকে প্রধান করে স্থানীয়দের এই সমাবেশ বসতো বলেই এর নামকরণ করা হয় নবরত্ন মন্দির।বাবার হত্যার পরে প্রতাপ নিজেও সেই সভা বজায় রেখেছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক, ফৌজদারি বিষয়ে রায় দিয়েছিলেন। এই মন্দিরটি স্থানীয়দের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল।

রাজত্বের প্রথম দশকে প্রতাপাদিত্য অধিপত্যের সাথে রাজত্ব করেছিল। বিভিন্ন শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে চাপের মুখে পড়লেও তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। এদিকে সম্রাট আকবর ও গঙ্গার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুটের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন। মোঘলরা ছাড়াও পর্তুগিজ ও আরাকানরাও আক্রমণ করা শুরু করে এই ব-দ্বীপকে। কিন্তু সে দক্ষ হাতে তা প্রতিহত করেছিলেন।

প্রতাপের এই বিষয়গুলো তাকে অহংকারী করে তোলে। ধীরে ধীরে সে নির্দয় ও কঠোর শাসকে পরিণত হয়। যে তারা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতো তাকে তিনি হত্যা করতেন। প্রচলিত আছে, প্রতাপের এই নির্দয়তা কালী দেবীর সহ্য করতে পারতেন না। প্রতাপের উপর থেকে আশীর্বাদ তুলে নিতে থাকেন। তার পতন শুরু হয় তার পরিবার থেকেই।

রাঘব রায়ের কথা মনে আছে? যে প্রতাপের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল। প্রতাপের স্ত্রীই এই বাচ্চাটি কে লালন পালন করেছিলেন।১৬০৮ সালে জাহাঙ্গীর যখন সম্রাট হিসেবে অভিসিক্ত হন তখন এই রাঘব রায় ন্যায় বিচারের আশায় সম্রাটের দরবারে যায়।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশেই মোঘল সেনাপতি ইসলাম খান ১৬০৮ সালে বাংলায় পৌঁছান। বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খান কে পরাজিত করার পর, রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করেন।১৬১১ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সাল কার পাশে যুদ্ধ হয়েছিল। প্রায় এক হাজার যুদ্ধ নৌকা নিয়ে প্রতাপ পরাজিত হন। মোঘল যুদ্ধের কৌশল বোঝার জন্যে যমুনার তীরে তৈরি এক সুরক্ষিত দুর্গে বাস করতে থাকেন। কিন্তু প্রতাপের দুর্বল যুদ্ধ বহন গুলো বারবার হেরে যাচ্ছিল। এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম খান দুর্গের প্রবেশদ্বার ভেঙে তাকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তারপরও ঈসা খানের মৃত্যুর ১৩ বছর পরেও প্রতাপাদিত্যের শত্রু প্রতিহত করার এই শক্তি তাকে বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে শক্তিশালী হিসেবে সম্মানিত করা হয়।

রাজা প্রতাপাদিত্য কিভাবে মারা গিয়েছিলেন তা নিয়েও আছে নানা গল্প। অনেকে বলেন বন্দি করে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার পথেই আংটিতে লুকানো বিষ খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। আবার অনেকের ধারণা, তাকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঠিকই। সেখানে তিনি দুটি কবুতরের সঙ্গ চান। তিনি বলেন, তার মৃত্যুর পর যেন কবুতর দুটোকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তার পরিবার যেন এই কবুতর দেখে পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেন।

কিন্তু অবাক করার বিষয় ছিল, সম্রাট কিছু উপটোকন এর( ঘুষ) বিনিময়ে প্রতাপাদিত্যকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু প্রতাপ মারাত্মক ভুল করে বসেন। তিনি খাঁচার দরজা খোলাই রেখেছিলেন, যার ফলে কবুতর দুটো উড়ে যায়। প্রতাপ যতক্ষণে ঈশ্বরীপুর প্রাসাদে পৌঁছায়, ততক্ষণে তার পুরো পরিবার ‘হাওয়া খান’ প্রাসাদের পাশের পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল। এই ঘটনায় প্রতাপাদিত্য নিজেও খুব ভেঙে পড়েন এবং নিজেও সেই পুকুরে ডুবে আত্মাহুতি দেন।

এভাবে শেষ হয়েছিল বারো ভূঁইয়ার এক শক্তিশালী রাজা প্রতাপাদিত্যের গল্প। ব্যক্তি প্রতাপাদিত্যের কথা বলতে গেলে বলা হয়, তিনি ছিলেন শক্তিশালী নির্ভীক। জন্ম থেকে শুরু করে তার পুরো জীবনটাই ছিল একটি নাটক। বিশ্বাসঘাতকতা, পিতা হত্যা, ভাই হত্যা, পরিবারের আত্মহুতি এই সব কিছু মিলিয়েই ছিল তার জীবন। এখনো যশোরের ঈশ্বরীপুরে তার নামের গল্পগুলো মুখে মুখে লেগে আছে।