অনেক, অনেক দিন আগের কথা—প্রাচীন পারথিয়া সাম্রাজ্যে ঘটেছিল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সেখানে এক রানি ছিলেন, যার গল্পটা কেবল সোনার মুকুট, জাঁকজমক বা সিংহাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—বরং তা ছিল ষড়যন্ত্র, শক্তির খেলা এবং দুর্দান্ত বুদ্ধিমত্তার এক অনন্য অধ্যায়। তার নাম ছিল মুসা।
মুসার জন্ম ইতালির এক অখ্যাত কোণায়, এক সাধারণ দাসী পরিবারে। কেউ তার নাম জানত না, কেউ ভবিষ্যতে তাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখত না। কিন্তু ভাগ্যের এক চক্রে, তিনি পৌঁছে যান রোমান সম্রাট অগাস্টাসের দরবারে।
সেখান থেকে শুরু হয় তার অজানা যাত্রা। একদিন অগাস্টাস তাকে উপহার দেন পারথিয়ার রাজা ফ্রাতেস চতুর্থকে—একজন ক্ষমতাধর শাসক যিনি দীর্ঘদিন রোমের সঙ্গে লড়াই করে এসেছেন। রাজা ফ্রাতেসের বহু রানি, বহু সন্তান থাকা সত্ত্বেও, মুসা তার সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের মাধ্যমে রাজপ্রাসাদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

রানি মুসা ও তার পুত্র ফ্রাতেস পঞ্চমের যুগ্ম শাসনের প্রতীক—পারথিয়ার রাজমুদ্রা © parthia.com
শিগগিরই তিনি জন্ম দেন একটি পুত্রসন্তানের, যার নামও রাখা হয় ফ্রাতেস। তারপর শুরু হয় তার বাস্তব জীবনের মহাকাব্য—নিজ সন্তানকে সিংহাসনে বসানোর নীরব ষড়যন্ত্র। তিনি রাজাকে বোঝান, অন্য স্ত্রীদের সন্তানদের রোমে পাঠিয়ে দেওয়া নিরাপত্তার জন্য জরুরি। রাজা সম্মত হন। একে একে সব প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপুত্র রাজ্যচ্যুত হয়।
তারপর এক রাতে—নিঃশব্দ, চুপচাপ এক রাত—রাজা ফ্রাতেস চতুর্থের খাবারে মিশে যায় বিষ। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মুসাই তাকে বিষ পান করান। রাজা মারা গেলে, তার ছেলে ফ্রাতেস পঞ্চম সিংহাসনে বসেন। মা-ছেলে একসাথে রাজত্ব করতে থাকেন। এমনকি রাজমুদ্রায়ও তাদের দুজনের মুখ খোদাই করা হয়। মুসা তখন “বাসিলিসা”—গ্রীক উপাধিতে রানি হিসেবে স্বীকৃতি পান।
তবে রাজপ্রাসাদে শুরু হয় ফিসফাস—একজন দাসী মেয়ে কেমন করে রানি হয়ে গেলেন? কেউ কেউ এমনও গুজব ছড়ায়, যে তিনি নাকি নিজের ছেলেকেই বিয়ে করেছেন! যদিও ইতিহাসবিদরা একে গুজব হিসেবেই দেখেন।
একটি প্রাচীন মূর্তিকে অনেকদিন মুসার প্রতিকৃতি মনে করা হতো। কিন্তু পরে গবেষণায় জানা যায়, সেটি আখামেনিদ যুগের অলঙ্কারসহ দেবী টাইখের মূর্তি, মুসার নয়। তার আসল মুখ দেখা যায় রাজমুদ্রায়, যেখানে তিনি এক ভিন্ন ধরনের মুকুট পরিহিত।

একটি গ্রীক আবক্ষ পাওয়া গেছে, যা প্রথমে মুসার বলে মনে করা হয়, এখন ইরানের জাতীয় জাদুঘর © wikipedia
মুসা ও তার ছেলে ছয় বছর রাজত্ব করেন। কিন্তু পারথিয়ার অভিজাতরা বুঝতে পারেন, তারা রোমের সাথে অত্যধিক ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। তাদের উপর ক্ষোভ দানা বাঁধে, এবং একদিন হঠাৎ তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নতুন রাজা হন ওরোদেস তৃতীয়।
কিন্তু ইতিহাস বারবার মোড় ঘোরায়। ওরোদেস মাত্র দুই বছর রাজত্ব করে নিহত হন। তারপর সিংহাসনে বসেন সেই যুবরাজ, যাকে একদিন মুসা রোমে পাঠিয়েছিলেন নিজের ছেলেকে রক্ষা করার জন্য!
মুসা ও তার ছেলে ফ্রাতেস পঞ্চম রোমে পালিয়ে যান। সম্রাট অগাস্টাস আবারও তাদের আশ্রয় দেন। কিন্তু এরপর? ইতিহাস চুপ করে যায়। কোথায় গেলেন মুসা? কেমন ছিল তার শেষ দিনগুলো?
সময় সবকিছু ধুয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু ইতিহাসে থেকে যায় এক সাধারণ দাসী নারীর গল্প, যিনি তার বুদ্ধি, সাহস ও কৌশলে একসময়ের সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যের রানি হয়ে উঠেছিলেন—রানি মুসা।