১৪ বৎসরের এক তরুণ ডাচম্যান। নাম তার মরিস ভ্যানডারলুব। ১৯৩৪ সালের জানুয়ারী মাসের দশ তারিখে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। মৃত্যুদণ্ডের কারণ হল অগ্নিসংযোগ। তার অপরাধ সে এমন একটি আগুনের সৃষ্টি করেছে যা রাইখষ্টাগকে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। বার্লিনে জার্মানীর সংসদ ভবন বা রাইখষ্টাগে আগুন দেওয়া অবশ্যই গুরুতর অপরাধ।
কম্যুনিষ্ট ভ্যান্ডারলুব কি সত্যিই অপরাধী ছিলেন? নাজিদের তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন বটে। তিনি কি হিটলারের অথবা তার নৎসী অনুচরদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন ? কিংবা অন্য কোন রূপ ষড়যন্ত্রের জাল কি এতে জড়িত ছিল? জার্মানীর ইতিহাসেএই আগুন এক যুগান্তকারী মোর এনে দেয়।আর- আগুনের সুযোগ নিয়েই হিটলার ক্ষমতা দখলের সুযোগ পেয়েছিলেন।
১৯৩৩ সালের ২৭ এ ফেব্রুয়ারী । রাত ৯ টার ঠিক পরপরই হ্যান্স ক্রোস্টার নামে ধর্মতত্ত্বের এক ছাত্র ঐ অট্রালিকার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনিই প্রথম লক্ষ্য করলেন এই আগুনের শিখা। মড় মড় করে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে তিনি উর্দ্ধ দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলেন কেউ যেন জ্বলন্ত কিছু হাতে নিয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
ছুটে গিয়ে তিনি কাছাকাছি কোন পুলিশ সার্জেন্টের কাছে ঘটনাটি বিবৃত করলেন । সার্জেন্টটি তৎক্ষণাৎ ঐ অট্টালিকার সম্মুখে গিয়ে উপস্থিত হলেন। জ্বলন্ত মশাল হাতে লোকটিকে দেখা মাত্র সার্জেন্টটি তাকে তাক করে রিভলভারের গুলি ছুড়লেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, দোতালার এ জানালা থেকেও জানালার লোকটি প্রজ্বলিত মশাল নিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে বেগে ছুটে চলেছে।
৯-৪০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে প্রায় ষাটটি আগুন নেভাবার পাম্প এনে হাজির করা হল-অট্টালিকার এসেম্বলি হলের দেয়াল দেখে দেখে মনে হল-যেন প্রজ্জ্বলিত আগুনের দেয়াল। অট্টালিকার অন্যান্য অংশেও আগুন হুহু করে ছুটে চলেছে। আগুনের লেলিহান শিখা মুহুমুহু দ্রুতবেগে এগিয়ে গিয়ে সমগ্র বাড়িটিকে যেন ঘিরে ফেললো।
বিসমার্ক হলের সম্মুখে বন্দুক উঁচিয়ে একজন পুলিশ একটি লোককে আটক করলো ঘর্মাক্ত কলেবর দীর্ঘদেহী লোকটির কোমর পর্যন্ত অনাবৃত। তার রাস্পরর্টটি মরিস ভইয়ান্ডারলুব নামের পরিচিতি বহন করছে। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল কেন সে এ কাজ করতে গেল-সে সরাসরি জবাব দিলো ‘প্রতিবাদে’। এ কথাও স্বীকার করলো যে সে আরও তিনটি অট্টালিকায় আগুন ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়েছে।
এই আগুন রাজনীতিক্ষেত্রে ভীষণভাবে একটি আলোড়নের সৃষ্টি করলো । হিটলার তখন মাত্র সাতাশ দিনের জন্য চ্যান্সেলরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এই আগুন তাকে জার্মান সেনাবাহিনীর ‘ফুয়েরার’ পদে উন্নীত করলো।
জেরিন যখন হিটলারকে এই আগুনের বিষয়ে অবগত করলেন এবং এজন্য দায়ী ভ্যানডার লোককে বন্দী করার কথা বললেন কথিত আছে হিটলারের জবাব বলেন ঈশ্বরের তরফ থেকে এটা একটি সংকর বৈ আর কিছু নয়
কমিউনিস্টদের উত্থানের এটাই হচ্ছে সূত্রপাত
সর্বময় ক্ষমতা
‘প্রতিটি কম্যুনিষ্টকে গুলি করে হত্যা করা হোক ;প্রত্যেকটি কম্যুনিস্ট ডেপুটিকে আজ রাতের মধ্যে ফাঁসী দেওয়া হোক,- এ ব্যাপারে কোন রকম করুণা প্রদর্শন চলবে না’।
নাৎসীরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে জার্মান জনসাধারণকে কম্যুনিষ্টদের বিরুদ্ধবাদী করে তুলতে হবে। পার্লামেন্টে যদিও নাৎসিরা সংখ্যাগুরু ছিলেন তথাপি এই বামপন্থী দল নৎসীদের সর্বময় ক্ষমতার অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। রাতারাতি পাঁচ হাজার কম্যুনিষ্টকে বন্দী করা হল এবং চারজন দল নেতার বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হল।
১৯৩৩ সালের মার্চ মাসের সাধারণ ইলেকশনে নৎসীরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তিনি তিনভাগের দুইভাগ সংখ্যা গরিষ্ঠতাও তারা পায়নি। ভটের শতকরা মাত্র চুয়াল্লিশ ভাগ তারা পেয়েছিল। কিন্তু কম্যুনিষ্ট ডেপুটিদের মধ্যে যারা বাধার সৃষ্টি করতেন তাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে হিটলার পার্লামেন্টে এমন একটি আইন পাশ করিয়ে নেন, যার ফলে তার নিজের ক্যাবিনেটকেই সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।
বার্লিন অগ্নি নির্বাপন সংস্থার বিশারদরা অভিমত প্রকাশ করলেন যে কোন এক ব্যক্তি দ্বারা এত বিস্তৃতভাবে অগ্নি প্রজ্বলিত করা সম্ভবপর নয়। এ ধরনের কার্য সমাধা করতে ছয় কিংবা সাতজন কর্মীর প্রয়োজন। তাদের এই অভিমত সত্বেও লিপজিগের বিচার সভায় ভ্যানডারল্যুবের সঙ্গী অপরাধী হিসেবে ধৃত চারজন অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া হয়। হিটলার এই আগুনের জন্য কম্যুনিষ্টদের দোষী মনে করেন এবং দুর্বল চিত্ত ভ্যানডারল্যুব এ কারনে তার জীবন দান করেছে। কিন্তু পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের কারো মনে সন্দেহের লেশমাত্র অবকাশ ছিল না যে এই অগ্নির পরিকল্পনা স্বয়ং নৎসীরাই গ্রহণ করেছিলেন।
অপরদিকে কম্যুনিষ্টরা তাদের চমৎকার ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রচারণার মাধ্যমে প্রচার করে যে গোয়েরিঙও তার এই কুকর্মের একজন সঙ্গী।
রাইখষ্টাগের গোপন পথে গিয়ে তারা এই অগ্নি প্রজ্বলিত করে এবং গোপনেই তারা ফিরে আসে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে যখন নুরেমবার্গের বিচার সভা অনুষ্ঠিত হয়, জার্মান বাহিনীর প্রধান, জেনারেল ফ্রান্জ হালডার ঘোষণা করেন যে, ১৯৪২ সনে গোয়েরিং এই বলে রীতিমত গর্ব করতেন যে-‘রাইখষ্টাগে আগুন ধরানোর খবর একমাত্র আমিই জানি, কারণ এই আগুন আমিই ধরিয়ে ছিলাম’।
শেষ তথ্য মতে-গোইয়েরিং কিন্তু এ মন্তব্য করেননি বলেই দাবি করেন। তিনি সোজাসুজি অতীতের এই মন্তব্য কে অস্বীকার করে বসেন। কিন্তু সকলেই জানে নাৎসীরা সবসময় দ্বিমুখী চাল চলতে ওস্তাদ। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য । যুদ্ধের পর এক বৎসর পর আসল তথ্যটি বেরিয়ে আসে। আধুনিক পরীক্ষা অনুসন্ধানে এ খবর জানা যায় যে, ঐ স্থানে অসাবধানতায় ফেলে যাওয়া যে তিনটি ক্রস পাওয়া যায় তা নৎসীদের প্রতীক। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই আগুনের সূত্রপাত নৎসীদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল।
কার্যতঃ দেখা যাচ্ছে যে ভ্যানডারল্যুব প্যাকেট জ্বালানী ও একটি মাত্র ম্যাচ বাক্সের সাহায্যেনিজের বিনাশ সাধনের আগুনই জ্বালিয়েছিল। গোয়েরিং এর লোকেরা নির্মমভাবে তাকে ব্যবহার করেছে আর ফায়ার সার্ভিসের লোকদের অযথা হয়রানী করছে মাত্র।