ডাচ শিল্পী রেমব্রান্ট হার্মেন্সজ (১৬০৬–৬৯) চিত্রকলার ইতিহাসে আলো ও ছায়ার জাদুকর হিসেবে যত বিখ্যাত, ততই রহস্যে মোড়া তাঁর ভারতীয় অনুপ্রেরণায় আঁকা একগুচ্ছ ছবি— যা বিশ্বব্যাপী পরিচিত “Rembrandt’s Indian Drawings” নামে। ১৬৫৬ থেকে ১৬৬১-এর মধ্যে আমস্টারডামের স্টুডিও ‘কুনস্টকাম্মার’-এ তৈরি এই ২৫টি ড্রয়িং মূলত মুঘল ও ডেকানি মিনিয়েচার ঘরানার ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আঁকা। তবে অনুলিপি নয়, বরং নতুন এক দৃষ্টি দিয়ে শিল্পীর সৃজনশীল পুনর্গঠন। শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানের প্রতিকৃতি, তীরন্দাজ, কবি থেকে শুরু করে অন্দরমহলের নারী পর্যন্ত— কারও চেহারা পরিচিত, কেউবা সম্পূর্ণ কল্পিত।

রেমব্রান্টের আত্ম-প্রতিকৃতি(১৬৬১) © wikipedia
রেমব্রান্টের শিষ্য আরেন্ট ডে গেল্ডার সেই সময় তাঁর পাশে ছিলেন। ধারণা করা হয় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারতীয় শিল্পের অ্যালবামগুলো ইউরোপে আসে, যা দেখে রেমব্রান্ট মুগ্ধ হয়ে যান। তাঁর ছবিতে ভারতীয় পোশাক ও অলঙ্কারের জাঁকজমকের সঙ্গে যুক্ত হয় ইউরোপীয় চিত্রকলার গভীর ছায়া-আলোর কৌশল। ফলাফল— দুই সংস্কৃতির শিল্পরুচির এক অভিনব সম্মিলন।
এমন শিল্পভ্রমণ কি শুধুই তুলি-কাগজের অনুশীলন? নাকি পূর্বের প্রতি এক গোপন ভালোবাসা? লেখক শাকিল বাদাউনি যেমন কাঁপা গলায় লিখেছিলেন—
“মেরে হমনाफস মেরে হমনওয়া,
মুঝে দোস্ত বন্ কে দাগা না দে…”
—রেমব্রান্ট যেন সেই আকুতি নিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশকে আঁকতে গিয়েছিলেন; দূরত্বের বাধা পেরিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তুলির মাধ্যমে।
রেমব্রান্টের মৃত্যুর পর ১৭৪৭ সালে তাঁর নাতি ‘ছোট’ জোনাথন রিচার্ডসন “A Book of Indian Drawings, by Rembrandt, 25 in number” শিরোনামে লন্ডনের কনভেন্ট গার্ডেনে নিলামে তোলেন। আজ পর্যন্ত মাত্র তেইশটি ছবির খোঁজ পাওয়া যায়— বাকি দুটি হারিয়ে গেছে ইতিহাসের ধুলোয়। যেগুলো আছে সেগুলো সংরক্ষিত আছে আমস্টারডামের রিজক্স মিউজিয়াম, হার্ভার্ডের ফগ আর্ট মিউজিয়াম, বার্লিনের প্রুশিয়ান কালেকশানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে।
এই ড্রয়িংগুলোকে অনেকে ইউরোপে ভারতীয় শিল্পের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার বলে ধরা হয়। রেমব্রান্ট যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন— শিল্প এমন এক বস্তু, যা সমুদ্রপথে আসে, কিন্তু শেষমেশ হৃদয়েই বাসা বাঁধে। মুঘল নারী চরিত্রদের আঁকার সময় তিনি কেবল তাঁদের মুখচ্ছবি তোলেননি; তাঁদের আবেগ ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁর ছবির চোখজোড়া আজও যেন বলে ওঠে—
“আজ যাও না, জিদ না করো,
ইহি পেহলু মে বেঁঠে রোহো…”
—যেন শিল্প ও ভালবাসার মধ্যে কোনও বিদায় নেই, কেবল অবস্থান আছে।
রেমব্রান্টের ‘ভারতীয় অনুপ্রেরণা’ অ্যালবাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ঐতিহ্য শুধু ইতিহাস নয়, অনুভূতিরও উত্তরাধিকার। ভারতীয় উপমহাদেশের মাটি থেকে উঠে আসা রং, নকশা ও অনুভব ইউরোপের ঠান্ডা আবহাওয়া ও রেনেসাঁস-পরবর্তী শিল্পচর্চাকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করেছিল। তাই এই অ্যালবাম শুধু কয়েকটি সাদাকালো ড্রয়িং নয়; বরং একটি নীরব শিল্প-সংলাপ— যা মুঘল দরবার থেকে ডাচ স্টুডিও পর্যন্ত প্রসারিত। এ যেন সরোবরে চাঁদের ছায়া, যাকে ছুঁতে গেলে জল কাঁপে— কিন্তু সেই কাঁপনে তৈরি হয় নতুন সৌন্দর্য।