শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।
দুর্গা পূজার আগে আগে ফোটে বলে ভারতীয়রা শিউলিকে দুর্গা পূজার আগমনী বার্তাবাহক ফুল হিসেবেও আখ্যা দেয়। বহুবর্ষজীবী এই গাছটির অনেক রকম ভেষজ গুণাগুণও রয়েছে। শিউলি পাতার চা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা উপশমে, শিউলির বীজ মাথার খুশকি অপসারণে এবং শিউলি পাতার রস কৃমিনাশক হিসেবে বেশ উপকারী। তবে পাঁচ থেকে সাতটি শুভ্র পাঁপড়ি ও লালচে কমলা বৃন্তবিশিষ্ট এই রাতজাগা ফুলটি নিয়ে একটি বেদনাবিধূর গল্প প্রচলিত আছে।
শিউলির অপর নাম পারিজাতিকা। আসলে পারিজাতিকা ছিলো এক রাজকন্যা। সুন্দরী রাজকন্যাকে বিয়ে করবার জন্য পাত্রের কোনো অভাব ছিলো না। কিন্তু রাজকন্যা মনে মনে সূর্যকে ভালোবেসে ফেললো। কিন্তু সূর্যদেব পারিজাতিকাকে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালো। পারিজাতিকা এই অপ্রাপ্তির বেদনা ও অপমান নিতে পারলো না। দুঃখ-কষ্টে বুক ভার হলো তার। সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো পারিজাতিকা।
তবে এখানেই শেষ নয়। পারিজাতিকার দেহাবশেষের উপর জন্ম নিলো একটি গাছ, যার নাম রাখা হলো পারিজাতিকার নামেই। বিশ্বাস করা হয়, পারিজাতিকা সেই গাছে ফুল হয়ে আসে শরতের সন্ধ্যায়, সূর্য ডোবার ঠিক পর পর। সে সূর্যকে দেখা দিতে চায় না, কেননা সূর্য তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
শিউলি ফুলের রূপে আজও মন ভরা বিষণ্ণতা নিয়ে আমাদেরকে মুগ্ধ করে চলেছে অপ্রাপ্তির বেদনা বয়ে বেড়ানো রাজকন্যা পারিজাতিকা। তাই তো শিউলি গাছকে বলা হয়, ‘ট্রী অফ সরো’, অর্থাৎ ‘বিষণ্ণতার গাছ’।
এমনকি শিউলির বৈজ্ঞানিক নামটিও তার দুঃখকেই প্রকাশ করে। ‘নিক্টান্থেস আর্বোর-ট্রিস্টিস’ –এটিই শিউলির বৈজ্ঞানিক নাম। ‘নিক্টান্থেস’ শব্দটি ল্যাটিন, যার অর্থ ‘সন্ধ্যার ফুল’ এবং ‘আর্বোর-ট্রিস্টিস’ এর অর্থ হলো ‘বিষণ্ণ গাছ’।
দক্ষিণ এশিয়ার রাতজাগা বিষণ্ণ ঝরে পড়া এই ফুলটি ভোর বেলায় শিশির ভেজা ঘাসের উপর থেকে ছেলেবেলায় আমরা কতোই না কুড়িয়েছি। সে সময় শিউলির এই বিষণ্ণতার গল্পটি আমাদের জানা না থাকলেও দিনের আলোতে সদ্য ফোটা শিউলি ফুলের সৌন্দর্য দেখবার ইচ্ছা আমাদের প্রত্যেকের মনেই কখনো না কখনো উঁকি দিয়েছে। শিউলির অন্তরের ব্যথা তো কবি নজরুলের হৃদয়কেও ছুঁয়ে গিয়েছিলো। তাই তো তিনি বলেছেন- “শিশির ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেনো কান্না পায়!”
রেফারেন্স: