রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বিদ্রোহী স্পার্টাকাসের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। ইতিহাসের অন্যতম একজন বীর- ক্রীতদাসকে নিয়ে পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক-এর তৈরি সিনেমাটি এখনো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ইতিহাসের পাতায় বীর হিসেবে আবির্ভূত স্পার্টাকাস মূলত একজন রোমান ক্রীতদাস। যে সময়ে অন্যান্য সম্রাটরা রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে শত চেষ্টা করেও জয়লাভ করতে পারত না, সেই সময়ে সামান্য ক্রীতদাস থেকে উঠে আসা যোদ্ধা স্পার্টাকাস রোমানদের বিপক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করতে ভয় পেলেন না। বরং অনেকগুলো যুদ্ধে তাদের পরাজিতও করলেন।
ইতিহাসবিদগণের মতে, স্পার্টাকাস এর জন্ম রোমান সাম্রাজ্যের থ্রেস অঞ্চলের একটি গ্রামে। বর্তমানে যা বলকান অঞ্চল নামে পরিচিত। তরুণ স্পার্টাকাস শক্তিশালী গড়ণের কারণে প্রাথমিক জীবনে সেনাবাহিনীতে চাকরি লাভ করেছিলেন। একসময় সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ঠাঁয় হয় দাস বাজারে। বেশ কয়েক বছর ক্রীতদাস হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করেন তিনি। তৎকালীন রোমে শক্তিশালী ক্রীতদাসদের বাছাই করে, যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ দিয়ে- গ্ল্যাডিয়েটর নামক যোদ্ধায় পরিণত করা হত এবং তাদের দিয়ে রোমের বিভিন্ন অঞ্চলে মল্লযুদ্ধের আয়োজন করত। রোমের সভ্য নাগরিকগণ এই পাশবিক খেলা উপভোগ করতেন। দুর্ভাগ্য ক্রমে স্পার্টাকাস একজন গ্ল্যাডিয়েটর দালালের (ভাটিয়ার) নজরে পড়েন।
সেই দালাল স্পার্টাকাসকে ক্রয় করে ন্যাপলসের বিখ্যাত নেউস লেন্টুলুস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ক্রমে স্পার্টাকাস হয়ে উঠলেন এক গ্লাডিয়েটর যোদ্ধা। ক্রীতদাসের শিকল থেকে বেরিয়ে জড়িয়ে পড়লেন রোমান পাশবিকতার ফাঁদে। যুদ্ধক্ষেত্রে বহু প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করলেন। একসময় হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। এই পাশবিক হত্যাযুদ্ধ তার কাছে অনৈতিক মনে হলো। ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের আগুন দানা বাঁধতে শুরু করলো। একদিন সামান্য এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধাদের সাথে প্রশিক্ষকদের প্রথমে কথা কাটাকাটি ও পরে হাতাহাতি শুরু হলো। সুযোগ বুঝে ৭৮ জন গ্ল্যাডিয়েটরকে নিয়ে ভিসুভিয়াস পর্বতের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যান। পরে একটি ছোটখাটো সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন । প্রথমে রান্নাঘরে ব্যবহৃত লোহার সরঞ্জামাদিকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেও পরে অস্ত্র বোঝাই গাড়ি লুট করে অস্ত্রের ব্যবস্থা করলেন। ততদিনে সমগ্র রোমে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রীতদাস ও গ্ল্যাডিয়েটররা পালিয়ে এসে তার দলে যোগ দিতে থাকে। অনেকের ধারণা স্পার্টাকাসের সাথে তার স্ত্রীও পলায়ন করেছিল। তার স্ত্রী ছিল একজন থ্রেসীয় ক্রীতদাসী। কিন্তু প্রাচীন পুরোহিতদের মতো বিভিন্ন লক্ষণ বিচার করে ভবিষ্যৎবাণী করার গুণ ছিল তার। একবার তার স্ত্রী ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে স্পার্টাকাসের এই বিদ্রোহের করুণ পরিণতি হবে।
ধীরে ধীরে স্পার্টাকাস ও তার দাস বিদ্রোহীদের খবর রোমান সিনেটে পৌঁছে গেল। কিন্তু তারা এদের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে নারাজ ছিল। গ্লেবার নামক এক সেনাধ্যক্ষের অধীনে ৩ হাজার সাধারণ সৈনিকের একটি দলকে পাঠানো হলো স্পার্টাকাস কে বধ করতে। উল্টো শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে গ্লেবারের দল। আর তাদের অস্ত্র দখল করে স্পার্টাকাসের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। ৭২ খ্রিস্টপূর্বের শেষে স্পার্টাকাসের বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারে উন্নীত হয়। সঙ্গে অশ্বারোহী বাহিনীর সংযোজন হয়।
এভাবে রোমানদের অট্টহাসি ও পরিহাস ধীরে ধীরে আতঙ্কের রূপ নেয়। তাকে রুখে দিতে আরও শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করে। কিন্তু এবারও রোমান বাহিনী পরাজিত হলো। কিন্তু একেবারে শেষে সময়টা ৭১ খ্রিস্টপূর্ব, রোমান সেনা নেতৃত্বে আবির্ভাব হলো নতুন নেতা মার্কাস লিসেনিয়াস ক্রেসাসের। তার পরিচালিত বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই হল স্পার্টাকাসের বাহিনীর। স্পার্টাকাসের তীরন্দাজ অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী বীরের মতো লড়াই করেও পরাজয় বরণ করে। স্পার্টাকাস যুদ্ধে প্রাণ হারালেন।
ইতিহাসবিদগণ, এই যুদ্ধকে ” তৃতীয় সার্ভিল যুদ্ধ” বা “গ্লাডিয়েটের যুদ্ধ” নামে আখ্যায়িত করেছেন। মুক্তির স্বপ্ন বুকে নিয়ে, গ্লাডিয়েটর স্কুল থেকে পালিয়ে, যে স্পার্টাকাস রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তাকে পরাজিত বলা যাবে না কোনভাবেই। তারই মতো হাজারো স্পার্টাকাসের সংগ্রামের ফলেই একদিন পৃথিবীর বুক থেকে রোমান সাম্রাজ্যের নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে।তাইতো পৃথিবীর মানুষ চিরকাল তাদের কথা ভক্তিভরে স্মরণ করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাদের নাম।
Stay Curious SIS পরিবারের সদস্য
মুনীবা খান / রাবাব আহমেদ
Stay Curious SiS
Siddiqui’s International School