আজ বলবো এক অমূল্য রত্নের গল্প—যাকে আমরা সবাই “তৈমুর রুবি” নামে চিনি। নামটা শুনলেই মনে হয়, এটা হয়তো তৈমুর লঙের নিজের রুবি তাই এর নাম সবাই যানে তৈমুর রুবি নামে। কিন্তু সত্যিটা একেবারেই অন্যরকম। প্রথমেই বলে রাখি, এটি আসল রুবি নয়। বাংলায় যাকে লোহিতক বলা হয়, সেটিই আসলে এই পাথর। বৈজ্ঞানিক নাম স্পাইনেল। দেখতে উজ্জ্বল লালচে, আকারে বিশাল—৩৬১ ক্যারেটের এই স্ফটিকের উপর একে একে পাঁচ সম্রাটের নাম খোদাই করা আছে। আকবর, জাহাঙ্গীর, ফারুক সিয়ার, নাদির শাহ, আর আহমদ শাহ দুররানী—এই মহাশক্তিশালী শাসকদের নামই গেঁথে আছে রুবির গায়ে। মজার ব্যাপার হলো, জাহাঙ্গীর সেখানে নিজের বাবার নামও লিখে দিয়েছিলেন। এই তৈমুর রুবির যাত্রাপথ ছিল যেন এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। প্রথমে ভারতে, পরে ইরান ও আফগানিস্তানে ঘুরে আবার ভারতে ফিরে আসে এটি। তারপর ইতিহাস ঘুরলো নতুন দিকে।
১৮১৩ সালে শিখ সাম্রাজ্যের উত্থান। মহারাজা রঞ্জিত সিং ছিলেন এর অধিপতি। তার রাজদরবারেই এসে পৌঁছায় তৈমুরের রুবি। ১৮৪০ সালে তার মৃত্যু হলে রুবির মালিক হন ছেলে শের সিং। কিন্তু কিছুদিন পরই আততায়ীদের হাতে খুন হন তিনি। তখন রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার মাত্র পাঁচ বছরের ছোট ভাই, দলীপ সিংকে। এত অল্প বয়সে রাজ্য চালানো কি সম্ভব? সুযোগটা লুফে নেয় ইংরেজরা।

তৈমুরের রুবি পরিহিত রাজা শের সিংয়ের চিত্র © Wikimedia
১৮৪৮–৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিখ সাম্রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দলীপ সিং তখন মাত্র দশ বছরের শিশু। ইংরেজদের সুসংগঠিত বাহিনীর সামনে তার টিকতে না পেরে রাজ্য সমর্পণ করতে হয়। এরপর দলীপের দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় এক স্কটিশ অভিভাবকের হাতে। কৌশলে তাকে পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, যাতে ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করার কোনো সুযোগ না থাকে।
দলীপ সিংয়ের কাছে তখন দুটি রত্ন ছিল—কোহিনূর হীরা আর তৈমুরের রুবি। ইংরেজরা সেগুলো দখল করে নিয়ে সাফাই গাইল—নাকি সম্রাট দলীপ এগুলো উপহার হিসেবে দিয়েছেন! সত্যিই, উপহার নয়, ছিল নগ্ন লুট।
রুবি আর কোহিনূর পৌঁছে গেল লন্ডনে, রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে। সেখানেই গ্যারার্ড নামের রাজ-জহুরি রুবিটিকে বসিয়ে দিলেন এক ঝকঝকে নেকলেসে, হীরে আর সোনার সাজে। নকশা এমনভাবে করা হয়েছিল, যাতে চাইলে কোহিনূর বা তৈমুরের রুবি—যেকোনোটিই বসানো যায়। ইতিহাসে দেখা যায়, কোহিনূর ওই নেকলেসে বহুবার ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু তৈমুরের রুবি খুব কমই দেখা গেছে কারো গলায়।
এদিকে দলীপ সিংয়ের জীবন পরিণত হয় এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিতে। নিজের দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন বহুবার, কিন্তু তাকে আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। শুধু একবার, ১৮৬০ সালে, দুই দিনের জন্য ফিরতে পেরেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৩ সালে, নির্বাসিত রাজা দলীপ সিং মারা যান প্যারিসে।
রুবির গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৯৬৯ সালে বিবিসি একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে “রয়্যাল ফ্যামিলি” নামে। তাতে দেখা যায়, রানী নিজে নেকলেস হাতে নিয়ে এর কথা বলছেন। সেই দৃশ্য প্রচার হতেই কোহিনূর আর তৈমুরের রুবি নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ শুরু হয়। তখন থেকে রত্নগুলোকে প্রকাশ্যে আনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

একশো পাঁচ ক্যারেটের ডিম্বাকৃতির এই কোহিনুর পৃথিবীর সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত হীরা। © Getty Image
আজও সেগুলো ব্রিটিশ রয়্যাল কালেকশনে তালাবদ্ধ। কিন্তু একদিন হয়তো প্রবল দাবি উঠবে—রত্নগুলোকে তাদের নিজস্ব দেশে ফেরত দিতে হবে। হয়তো একদিন সত্যিই ফিরে আসবে কোহিনূর, আর তৈমুরের এই রুবিও।
এই আশাতেই রইলো গল্পের শেষ কথা—এক অমূল্য রত্ন, যে নিজের দেশে নয়, বরং ঔপনিবেশিক লুটের সাক্ষী হয়ে আজও বন্দি বিদেশের রাজকীয় ভাণ্ডারে।