বিশাল এক অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল পারস্য সাম্রাজ্য। সেই পারস্যের রাজধানী ছিল টেসিফোন, যা আজকের ইরাকের বিস্তৃত ভূমির এক অংশে দাঁড়িয়ে আছে। তাক কাসরা সেই পারস্যের হৃদয়ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা পারস্য সভ্যতার স্থাপত্য কৌশলের এক অনন্য নিদর্শন । একে আর্ক অফ টেসিফোন নামেও ডাকা হয়।
সময়ের সাথে সাথে নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে, পারস্য সম্রাটের শিল্প, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার জীবন্ত প্রতীক হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে তাক কাসরা। এটি আমাদের সাসানিয়ান এবং পার্থিয়ান বীরপুরুষদের মহিমার কথা মনে করিয়ে দেয়।

১৯২৩ ইরাকি ডাকটিকিট, দ্বারা ডিজাইন করা মার্জোরি মেনার্ড, খিলান সমন্বিত © wikipedia
সাসানিয়ান সম্রাট আর্দেশির শাসনকালে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে, এই তাক কাসরার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সম্রাট তখন পারস্য স্থাপত্যে কলার বিকাশে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে উঠেন এবং এরই মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের শক্তি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন।
কাসরা বিশাল অর্ধবৃত্তাকার এক স্থাপনা। এর সূক্ষ্ম এবং বিস্তৃত অলংকরণ সাসানিয়ান শিল্পীদের সুনিপুণ দক্ষতার প্রকাশ। এর কেন্দ্রীয় খিলান প্রায় ২৫ মিটার প্রশস্ত এবং বিশ্বের অন্যতম একক স্প্যান খিলান হিসেবে তাক কাসরার মর্যাদা লাভ করেছে। ছোট ছোট ইট দিয়ে তৈরি এই নকশা সাধারণ মানুষকে সত্যি বিস্মিত করে তুলে। প্রতিটি ইট যত্নের সাথে এমনভাবে বসানো, যাতে করে কোন আঘাতেই খিলানের স্থাপত্যে নকশাটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে না পারে।
এটি কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এর মাধ্যমে সম্রাট তার দার্শনিক ভাবনাকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেন। খিলানের বিশাল আকার স্বর্গ এবং পৃথিবীর মিলনের ছবি তুলে ধরে। এর মাধ্যমে সম্রাট রাষ্ট্রের সাথে আধ্যাত্মিক জগতের সংযোগকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেন। বাইরের দিকে রয়েছে ফুলের নকশা, বিভিন্ন জ্যামিতিক প্যাটার্ন এবং খোদাই করা শিলালিপি। পারস্য শিল্পীরা সৌন্দর্যকে কতটা ভালোবাসতেন তারই প্রমান এটি। ভিতরের অংশের গভীর খাঁজগুলো স্থাপত্যকে শক্তিশালী করে রাখার কাজ করত। এই আলো-ছায়ার খেলা দর্শকের মনে এক ত্রিমাত্রিক প্রভাব তৈরি করত, যেন সে স্বর্গীয় এক জগতে প্রবেশ করেছে।

১৯৫০ সালের ছবি © wikipedia
খিলানের বিশাল উচ্চতা ও অসাধারণ আকৃতি দেখে রাজ্যের মানুষতো বটেই ভিন্ন রাজ্যের অতিথিরাও সম্রাটের মহিমা অনুধাবন করতে পারতেন। খিলান নির্মাণে ব্যবহৃত ইটগুলো ট্রু আর্ক কনস্ট্রাকশন পদ্ধতিতে স্থাপিত হয়েছিল। এর ফলে উপরের কাঠামোর ওজন নিচের সারি সারি ইটগুলো বহন করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৌশল দক্ষতা এবং নির্মাণ কৌশলের উপরে গভীর জ্ঞান থাকলেই এই ধরনের সৃষ্টি সম্ভব।
স্থাপত্য ও সৌন্দর্য ছাড়াও এটি পারস্যের সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতীক। সাম্রাজ্যের ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই স্থাপনা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখানেই সম্রাট তার নানারকম রাজকীয় অনুষ্ঠান, সভা এবং কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সকলের কাছে তার শক্তি ও ঐতিহ্য প্রদর্শনের চেষ্টা থাকতো সেই সাথে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটলেও, তাক কাসরা আজও পারস্যের ইতিহাস ও সংস্কৃতির রক্ষক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় , এক সময় এখানে একজন শক্তিশালী সম্রাট শাসন করেছিলেন, যাকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল শক্তিশালী রোমান সম্রাটরাও। তবে দুঃখের বিষয় বেশ কয়েক বছর ধরে এই আর্কের বেশ কিছু অংশ ধ্বংস হতে শুরু করেছ। বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পারাসিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে যাচ্ছেন। কিন্তু ইরান বা ইরাকের সরকারি কর্মকর্তারা কেউই এই আহ্বানে সারা দেয়নি। আমাদের মনে সন্দেহ হচ্ছে; কতদিন এটি আমাদের কাছে অক্ষতভাবে বেঁচে থাকবে।

২০১৬ সালের ছবি © wikipedia

