আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, আনারকলি নামের পোশাকের সাথে জড়িত রয়েছে একটি ‘মোঘল গল্প’। এটি মোঘল দরবারের আনারকলি নামের একজন বিখ্যাত তাওয়াইফ বা বাঈজির ব্যবহার করা পোশাক থেকে এসেছে। নর্তকী আনারকলি যে ঘাগড়াটি পরতো, তা ছিলো খুবই চমৎকার ও রোমাঞ্চকর। এই ঘাগড়া ছিলো বেশ বড় এবং গোল আকৃতির…. সেটা নাচের সময় গোল হয়ে ঘুরতো! এটা অনেকটা তুর্কি দরবেশ নাচের মতো এবং আভিজাত্যের প্রতীকও বটে। তখনকার দিনে তাওয়াইফ বা বাঈজিদের সংস্কৃতি ছিলো খুবই সন্মানের। তারা এতোটা উন্নত কৃষ্ঠি, জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন ছিলো যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদেরকে তাদের কাছে পাঠানো হতো আদব-লেহাজ, কায়দা-কানুন, নাচ-গান ও সংস্কৃতি শেখানোর জন্য।
মোঘল সময়ে শাহজাহানবাদে ছিলো তাওয়াইফদের ঘর। চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এলো, পালকি করে নবাব ও তাদের নবাবজাদা বা শাহজাদারা এসেছেন। তাওয়াইফদের ঘরগুলো ছিলো রঙ্গিন আলোর দুনিয়া। কিন্তু সেখানে মদ নিষিদ্ধ, তাই পানওয়ালারা দাঁড়িয়ে থাকতো পান নিয়ে, শুধু পান খাওয়া যেতে পারে সখানে। অবশ্য ঐ পানের মধ্যে সামান্য আফিমের স্বাদও থাকতো! এই পান খেয়ে ও নাচ দেখে ঝাড়বাতির ঝলমলে আলোয় নবাবজাদা ও শাহজাদারা একটা সন্মোহনী ভাবের মধ্যে ডুবে যেতো। সেখানে চলতো এক অনন্য সংস্কৃতির ধারা, ধীরে ধীরে তবলা– ঘুঙুরের আওয়াজ একটা স্বর্গীয়ভাব নিয়ে আসতো। অথচ সেখানে ছিলো না কোনো নোংরামী…. ছিলো রূপার পানদানী, আতরদানী, সুগন্ধির মায়াময় ছন্দ যা তাদেরই সংস্কৃতির একটি অঙ্গ। সেই সাথে আনারকলির ঘাগড়া, চুড়িদার পায়জামা, স্কার্ট নাচের মঞ্চকে করে তুলতো আরও জমকালো!! তাদের দর্শকরাও ছিলেন একেকজন নাচ-গানের পারদর্শী এবং তারা নির্মল আনন্দ বিনোদনের মধ্যেই থাকতো।ফ্রান্সিস বার্ণিয়ার এসকল তাওয়াইফদের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তার লেখা থেকে জানা যায় , “তাওয়াইফ বা বাঈজিরা কোনো সাধারণ দেহ ব্যবসায়ী ছিলো না। তারা ছিলো অনেক শিক্ষিত ও উন্নত যোগ্যতা সম্পন্ন নর্তকী। এছাড়াও কাঞ্চনবালাদের দেহের গড়ন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এতোটাই নরম ও কোমল ছিলো যে নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিমা চমৎকার তালের মাধ্যেমে লীলায়িত হয়ে উঠতো , তাদের কণ্ঠও ছিলো অতুলনীয়। তারা এতোটা ঝলমলে আর জমকালো পোশাক পরতো যে দেখে মনে হতো যেনো কোনো রক্তমাংসের নারী নয়, এরা সব অপ্সরা বা হুর!” মুঘল দরবার চিরকালই ছিলো গান-বাজনার সমঝদার। সেই দরবারে কাঞ্চনীদের মতো শিল্পীদের কদরও ছিলো অনেক।
আরও জানা যায়, এইসব বাঈজিরা সকাল বেলায় তাদের রেওয়াজ করতো এবং বিভিন্ন জিনিস নিয়ে গল্প করে সময় কাটাতো। বিকাল বেলায় তাদের নিয়মিত আড্ডার বিষয় থাকতো কার কাছে কোন অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত নবাবজাদা বা আমীর এসেছিলো এবং তাকে কি কি উপহার বা নজরানা দিয়েছেন। এছাড়া সকলের মধ্যে এই বিষয়ে প্রতিযোগীতাও হতো…. কার কাছে কতো বেশি অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত নবাবজাদা বা আমীর এসেছেন তার ওপর ভিত্তি করে কে কতো উচ্চমানের ও সুনামের তা বিচার হতো! তারা যে শুধু নৃত্যেই পারদর্শী ছিলো তা নয়, তাদের অনেক ক্ষমতাও ছিলো। তারা যেমন শাহাজাদাদের নাচ দেখাতো, তেমনি অনেক সময় তাদের ডিসিশান মেকিং ও স্পাই হিসেবেও কাজ করতো। সম্প্রতি, লেখক দেবাশিষ দাস ‘রেড ফোর্ট: রিমেম্বারিং দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট মোঘলস’ বইয়ের মাধ্যমে সেসব বিষয় তুলে ধরেছেন।
যদিও আজ মানুষেরা তাদেরকে খারাপ চোখে দেখে থাকে। মূলতঃ ইংরেজরা তাদেরকে সমাজের সামনে খারাপভাবে উপস্থাপন করেছিলো এবং সাধারণ দেহ ব্যবসায়ীর সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলো।
পরিবর্তন আসলো কি ভাবে? শুরু করতে হবে বিদেশীদের দিয়ে l বৃটিশরা যখন প্রথম ভারতে আসে, তখন তারা তাদের পরিবারের অন্য সদস্য , বউ, বাচ্চা বা ছেলেমেয়েদের ছাড়াই ভারতে আসে। ঐসময় তাদের নিয়মই ছিলো অল্প বয়সী যুবকদেরকে পাঠানো। পরিবার-পরিজন ফেলে ভিন্ন একটা আবহাওয়া সম্পন্ন দেশে এসে তারা একাকীত্ব বোধ করতো, যার ফলে তারা তাদের স্বদেশের বিরহ ভুলে থাকার জন্য এ সকল বাঈজিদের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাতো। এছাড়াও তারা মোঘলদের সাথে ওঠাবসা করার জন্য এবং বাণিজ্যের সুবিধার জন্য মোঘল ঘরানার সাজ পোষাক ও আচার ব্যবহার করতো। মোঘল হাওয়া যেন স্ট্যাটাস সিম্বল l শুধু সাজ পোশাক না, অনেক সময় তারা ভারতীয়দের বিয়ে-শাদি করেও ভারতীয় সাজার চেষ্ঠা চালাতো। সেসময় তাদের মধ্যে অনেকেই ঐসব বাঈজিদেরকে বিয়েও করেছিলো…ফলে তাদের ঘরে সন্তানও হয়েছিলো এবং ঐ সকল সন্তানদেরকে তাদের উত্তোরাধিকার হিসেবে সম্পদও দিয়েছিলো। কিন্তু ১৮০৩ সালের পর যখন ইংরেজদের স্বজাতীয় স্ত্রী বা মেমসাহেবরা ভারতে এসে বসবাস করতে থাকে তখন এই বাঈজিদের সাথে তাদের স্বামীদের মেলামেশাটাকে একদমই মেনে নিতে পারেনি এবং বাঈজিদের থেকে তাদের স্বামীদের সরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় চেষ্টা তারা করেছিলো। সেটা কিভাবে করলো? তখন তারা বুদ্ধি আটে…… নিজেদেরকে বাঈজিদের থেকেও আরও সম্ভ্রান্ত জাতির বলে ভাবতে শুরু করে l এমনকি তারা যে মোঘলদের চেয়েও উন্নত তা প্রচার করতে থাকে। সামাজিক বিভেদ তৈর করে এভাবে আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা এসব বাঈজিদের সংস্বর্গ ছাড়তে শুরু করে।
এর পর আসলো স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ l এই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা তাওয়াইফদের পুরো বিরোধী হয়ে যায়। কারণ, উত্তর ভারতে তাওয়াইফরা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সিপাহী বিদ্রোহের সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো… সেসময় তারা সিপাহীদের আশ্রয় এবং অর্থ ও খাদ্য সরবরাহ করেছিলো। পরবর্তীতে এ সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণের ফলে ব্রিটিশরা এবং ভারতের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা তাদের বাড়িঘর ও ধন- সম্পদ কেড়ে নিয়ে সমাজের একটা কোনায় তাদের ফেলে দিয়েছিলো….. স্বাধীনতা আন্দোলনে তারা মূল্যবান ভূমিকা পালন করলেও পরে তাদেরকে নির্মম পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো! এ সেই বাঈজি যাদের ছিলো এতো সুনাম, এতো ক্ষমতা, এতো মর্যাদা অথচ পরবর্তীতে তাদের জীবিকার তাগিদে ধীরে ধীরে পতিতাবৃত্তির দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে! এমনকি যখন ভারত স্বাধীন হয় তারপরও এদেরকে আর জায়গা দেওয়া হয়নি, শুধু তা-ই নয়…. রেডিওতে তাদের গান গাইতে দেওয়া হলেও যোগ্য সম্মান টুকু দেওয়া হয় নি l যার ফলে অনেকেই ধীরে ধীরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায় l তারা হারিয়ে যায় l
ভাবতে অবাক লাগে l কি ছিল আর কি হলো!! মোঘল আমলে ঐ বাজারকে ‘মার্কেট অব বিউটি’ বলা হতো। ঝাড়োখাগুলির মাধ্যমে তারা নীচের গলিতে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোকে দেখতো l সেই সময়ের বাজার এলাকা ব্যবসায়িক কেন্দ্রে অবস্থিত ছিলো, যেখানে নারী পুরুষেরা তাদের দিন কাটাতো। নাগরিকরা নাচ, সংগীতের পাশাপাশি দোকানগুলোতে আতর বা সুগন্ধি, ফুল এবং অলঙ্কার বিক্রি করতো, যেগুলো পুরুষেরা ব্যবহার করতো এই প্রভাবশালী নর্তকীদের খুশি করতে। এরা অপ্সরী নামেও পরিচিত ছিলো। এদেরকে এক ঝলক দেখার জন্যে কত মানুষ রীতিমত অপেক্ষা করতো l এদের কেউই নিজের দেহ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো না বরং এরা ছিলেন শিল্প, ক্লাসিক নৃত্য ও ভাষার জ্ঞানের ভাণ্ডার। কিন্তু বৃটিশ উপনিবেশকারীরা এইসব মেয়েদেরকে তাদের সুবিধার্থে পাবলিক বিনোদন হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো এবং সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারকদের মাধ্যমে পতিতা দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচার করেছিলো। যার ফলে এই মোঘল তাওয়াইফ ঐতিহ্য, সংগীত, নৃত্য দক্ষতা শাহজাহানাবাদ শহরের আকর্ষণীয়তা থেকে একসময় চিরতরে হারিয়ে যায়!
পূর্বে দরবারের নাচওয়ালিদের জন্য হারেমের দরজা ছিলো বন্ধ… সম্রাট শাহজাহান ভেঙ্গেছিলেন সেই নিয়ম! শাহী হারেমের বিরোধীতা সত্ত্বেও তিনি তাদের ঠাঁই দিয়েছিলেন বেগম-মহলে। এমনকি কাঞ্চনীদের হারেমের মেলাতেও প্রবেশের অধিকার দিয়েছিলেন তিনি। বিরক্ত হয়েছিলো বেগমখানা…..এই প্রথম দরবারের চৌকাঠ পার হয়ে কাঞ্চনীরা পা রাখলো হারেমে। কিন্তু, দুর্ভাগ্য তাদের! মুঘল দরবারের দুর্দশায় তারাও হারিয়ে যেতে থাকলো। সেই জৌলুস হারিয়ে পরবর্তীতে শুধু ‘কাঞ্চনী’ নামটুকুই বজায় থাকলো, হারিয়ে গেলো তাঁদের আভিজাত্য। আর দশ জন বারবিলাসিনীর সাথে তাদের কোনো পার্থক্যও থাকলো না। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে একসময় তারাও বিস্মৃত হয়ে গেলো!