কিংবদন্তি হলো ইতিহাস ও কল্পনায় মিশ্রিত লোককাহিনী। ইতিহাসের কোনো ঘটনা যখন মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে, আর সাথে থাকে কল্পনার নানা গল্প, তখন পরবর্তীতে মানুষ নিশ্চিত হতে পারেনা আসলে কোনটা ইতিহাস আর কোনটা গল্প। এই ধরণের গল্পগুলোকে আমরা বলি কিংবদন্তি। আজ সেই রকমই একটি কিংবদন্তির গল্প শোনাবো। বানিয়াচং। বাংলাদেশের বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার এক সমৃদ্ধ জনবহুল উপজেলা। এই বানিয়াচং-এ রয়েছে সাগরদিঘি নামে এক বিশাল দীঘি। যে দীঘির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রানি কমলাবতীর আত্মত্যাগের করুণ কাহিনী। শোনা যেতো, বানিয়াচং-এর রাজা ছিলেন পদ্মনাভ। ফসলে পরিপূর্ণ রাজভান্ডার। শুধু অভাব একটাই তার কোনো রানি ছিল না। সংসারী হলে প্রজাদের প্রতি অবহেলা হতে পারে ভেবে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না রাজা পদ্মনাভ। একদিন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে তিনি এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ের দেখা পান। সে ছিল কমলাবতী। সে কোন রাজপরিবারের মেয়ে ছিল না, ছিল খুব সাধারণ ঘরের। কমলাবতীকে রাজা পদ্মনাভ এতই পছন্দ করে ফেলেন যে রানী করে তার রাজ্যে নিয়ে আসেন। প্রজারা তো মহাখুশি। এতদিনে তাদের প্রিয় প্রজাদরদী রাজা সংসারী হলেন। এরপর রাজ্যের উত্তরাধিকারী আসবে।
কিন্তু খুশি নয় একজন। সে ছিল পদ্মনাভের বোন কেউকা। মানসিক প্রতিবন্ধ এক রাজপুত্রকে সে বিয়ে করে। নিজের ছেলেকে নিয়ে সে ভাই পদ্মনাভের রাজ্যেই থাকে। তার মনে একটা আশা ছিল তার ছেলেই হবে ভবিষ্যৎ রাজা। রানী কমলাবতীর জন্যেই তার সে গুড়েবালি। তাই সে সুযোগ খুঁজতে থাকে রানী কমলাবতীর ক্ষতি করার জন্য। একসময় রাজ্যে খুব পানির কষ্ট দেখা দিল। একের পর এক দীঘি খনন করেও পানি দেখা মিললো না। আসলে নিয়তি হয়তো রাজা পদ্মনাভকে পরীক্ষা করছিল, সংসারে আবদ্ধ হয়ে সে আগের মতোই প্রজাদরদী আছে কিনা। রাজা পদ্মনাভ অপরিসীম কষ্টে যন্ত্রণায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালেন প্রজাদের সব দুঃখ যেন তাকে দেওয়া হয়। তাও যেন প্রজারা প্রাণে বাঁচে।
 
 
ঈশ্বর তার প্রার্থনায় খুশি হলেন। দৈববাণীতে দীঘি খননের আদেশ দিলেন তিনি এবং বললেন এতেই প্রজাদের দুঃখ কমবে। রাজ্যের প্রধান দীঘি খননকারী গন্ডমালিকে ডেকে রাজা আদেশ দিলেন দীঘি খননের । এই সুযোগটি নিলো কেউকা। গন্ডমালিকে নানা ভয় দেখিয়ে রাজি করালো রানি কমলাবতীর নামে দিঘিতে প্রথম কোপ দিতে। প্রচলিত ছিল, যার নামে দিঘিতে প্রথম কোপ দেওয়া হয়, তার আত্মবিসর্জন ছাড়া দীঘি পূর্ণ হয় না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় দীঘি তো এমনিতেই পূর্ণ হত। কিন্তু মাঝখান থেকে কেউকা কমলাবতীর প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে এ কাজটি করল। ফলে যা হবার তা হল, দীঘি খনন হয়, জল তো ওঠে না। রাজা ভাবলেন তবে কি মিথ্যে দৈববাণী? তখন গন্ডমালি এসে তাকে সব কথা খুলে বলল। রানি কমলাবতীও শুনল সে কথা। প্রজাদের দুঃখ লাঘব করার জন্য রানী কমলাবতী স্বতঃস্ফুর্তভাবে দীঘিতে আত্মবিসর্জন দিল। দীঘি কানায় কানায় পূর্ণ হল। প্রজাদের দীর্ঘদিনের কষ্ট দূর হল। সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে উঠে আসা কমলাবতী সেই সাধারণমানুষের জন্যই তার প্রাণ বিসর্জন দিল।
এই গল্পগুলো পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। বিসর্জনের জন্যে নারীকেই সবসময় বেছে নেয়া হয়। নারীদের দেবীর আসনে বসিয়ে তাদের ইচ্ছা – অনিচ্ছার প্রতি তোয়াক্কা না করে যুগ যুগ ধরে তাদেরকে সতী বানাবার ইচ্ছায় সমাজ তাদেরকে ব্যবহার করছে। নারীর এই আত্মত্যাগ সতীদাহ প্রথা থেকে শুরু করে দীঘিতে পানি উঠানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। ধর্মে দেখা যায়, স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্যে স্ত্রীকেই উপবাস করতে হয়। তবে স্ত্রীর দীর্ঘায়ুর জন্যে কে উপবাস করবে? নারীরা আজও জ্বলছে। আগে সতী হওয়ার মাধ্যমে জ্বলেছে, এখন যৌতুকের জন্যে জ্বলছে। সমাজের এই সমস্ত কুসংস্কার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নারীদেরকে তাদের যোগ্য সম্মান দিতে হবে। সমাজে ও পরিবারে তাদের আত্মত্যাগকেও সম্মান করতে হবে। বিশ্ব নারী দিবসে এটাই স্টে কিউরিয়াস সিস্ ও সিদ্দিকী’স পরিবারের কামনা।