অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যে মোট ৩৬ জন সুলতানের মধ্যে সর্ববিবেচনায় সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ আল-ফতেহ (the Conquror) এবং সুলতান সুলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টকে (the Magnificient) বলা হয় গ্রেট বা সবচেয়ে মহান। মানব ইতিহাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের পদচারণা হয়েছে এ বিশ্বে, কিন্তু গুটি কয়েক ব্যক্তি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের ব্যতিক্রমী দক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে অপরিসীম প্রভাব রাখার জন্য। সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ তাদেরই একজন। আজ দেখবো সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদকে কেন বলা হয় The Conquror।
পিতা দ্বিতীয় মুরাদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মোহাম্মদ মাত্র ১৯ বছর বয়সে যখন সুলতান হলেন, তখন অটোমান সাম্রাজ্য নিমজ্জিত বিশৃংখলার মধ্যে। সুলতানকে ঘিরে থাকলো তাঁর শত্রুরা। যুবক মোহাম্মদকে তাঁর নিজের রাজ্যে অনেকেই খুব একটা গুরুত্ব দিত না। এমনকি আশপাশের রাজ্যের রাজারা মোহাম্মদকে তাচ্ছিল্যর সাথে দেখতো। অটোমান সুলতানের বিশেষ সেনাবাহিনী, জানিসারি কর্পসের (Jannisary Corps) অনেকে সুলতানকে খুব একটা পছন্দ করতো না। আর মোহাম্মদ তা’ জানতেন বলেই তাঁর বিশেষ বাহিনী জানিসারিকে পুনর্গঠন করেন সম্পূর্ণভাবে। বিদায় করে দেন তাদেরকে যারা তাঁর অনুগত ছিল না। জানিসারি কর্পসকে পুনর্বিন্যাস করেন নিজের মতো করে। সেনাবাহিনীর মধ্যে ফিরিয়ে আনেন শৃংখলা এবং দক্ষতা।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (Constantinople) ছিল অটোমানদের কাছে এক কল্পনার শহর। শহরটি তখনকার বিশ্বের কাছে ছিল সফলতার এক নিদর্শন। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকের অঞ্চলকে (Eastern Roman Empire) তখন বলা হতো বাইজেন্টাইন (Byzantine) সাম্রাজ্য, যা’র রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল, বর্তমানে তুর্কীর ইস্তাম্বুল। ঐ সময় কনস্টান্টিন একাদশ পালাইয়ালোগোস (Constantine XI Palaiologos) ছিলেন বাইজেন্টাইনদের সম্রাট সুলতান মোহাম্মদ ছিলেন অনেক উচ্চবিলাসী। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয় করা। এ স্বপ্ন যে কোন রাষ্ট্রের জন্য তখন ছিল কল্পনাতীত এবং অবাস্তবও বটে। রাত-দিন তিঁনি পড়াশুনায় মনোনিবেশ করলেন ইতিহাস, যুদ্ধ, এবং রন-কৌশল নিয়ে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, কনস্টান্টিনোপল জয় করতে হলে তাঁকে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সময় নিয়ে প্রস্তুত করলেন নিজেকে কনস্টান্টিনোপল আক্রমনে। মোহাম্মদ যুদ্ধের স্বাদ পেয়েছিলেন ১৪৪৮ সালে, তাঁর বাবার সাথে কসোভোর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ঐ যুদ্ধ তাঁকে দিয়েছিলো এক বিরল অভিজ্ঞতা। মৃত্যু এবং যুদ্ধ দেখেছেন অনেক কাছ থেকে। যখন মোহাম্মদ সিংহাসনে আহরণ করেন তখন তাঁর ঝুলিতে ইতিমধ্যে জমা হয়ে গিয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। বের করে ফেললেন আক্রমণের অনেক কৌশল।
কনস্টান্টিনোপলের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে বসবরাস প্রণালী (Bosphorus strait)। এ প্রণালীটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ, সংযোগ করেছে উত্তরের কৃষ্ণ সাগরের সাথে দক্ষিণের মারমারা সাগরের (Sea of Marmara)। বসবরাস ইউরোপ এবং এশিয়ার সংযোগস্থল। এর পূর্ব তীর থেকে শুরু হলো এশিয়া মহাদেশ, আর পশ্চিম তীর সমাপ্তি করলো ইউরোপ মহাদেশ।
১৪৫২ সালের বসন্তকালে মোহাম্মদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তাঁর জানিসারী কর্পসের বিশেষ সেনারা কনস্টান্টিনোপল থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে বসবরাস প্রণালীর পশ্চিম তীরে (ইউরোপের অংশে) একটি দুর্গ নির্মাণ শেষ করে। রুমেলি হিসারি (Rumeli hisari) নামে এটি পরিচিত। এর তুর্কী নাম Boğazkesen, অর্থ, নদী-প্রণালী বিচ্ছিন্নকারী (Strait-blocker)। এ দুর্গটি নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, অটোমানদের কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের সময় যেন বাইজেন্টাইনরা তাদের মিত্রদের কাছ থেকে কোন রকমের সাহায্য জলপথে না পেতে পারে।
এই বসবরাস প্রণালীর ঠিক ওপারে, এশিয়ার ভূখণ্ডে, আগে থেকেই নির্মাণ করা ছিল আনাদোলু হিসারি দুর্গ (Anadolu hisari)। নদীর দু’ পাড়ের এ দু’টো দুর্গ রণ-কৌশল দিক থেকে অটোমানদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গ দু’টো দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি, বসবরাসের এপার আর ওপার। রুমেলি হিসারি দুর্গটি নির্মাণের সময়, সুলতান মোহাম্মদ তাঁর প্রকৌশলী এবং কারিগরদের সাথে নিজে সম্পৃক্ত থেকে সব কিছু তদারকি করেছেন। এটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিলো সাড়ে চার মাস। দুর্গ দু’টো দিয়ে অটোমানরা কৃষ্ণ সাগর থেকে বসবরাস প্রণালীর মাধ্যমে কনস্টান্টিনোপলের সব সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেয়। মোহাম্মদ দুর্গে এনে রাখেন জানিসারির বাছাই করা সেরা সৈন্যদের।
অটোমানদের যুদ্ধের এমন প্রস্তুতিতে বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টান্টিন ভীত হয়ে পড়লেন। তিঁনি তাঁর শহরটিকে রক্ষা করার জন্য এর চারিদিকে প্রায় ১৪ মাইল বিস্তৃত পাথরের উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করলেন। কোন কোন জায়গায় দুই স্তরের প্রাচীর দেয়া হলো অটোমানদের আক্রমণ ঠেকাবার জন্য। অনেক সুউঁচু প্রাচীর অবশ্য আগে থেকেই ছিল শহরটিকে ঘিরে। সবচেয়ে উঁচু প্রাচীরটির উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট। এই প্রাচীরগুলো কনস্টান্টিনোপলকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে শত শত বছর। ঐ সময় কনস্টান্টিনোপল নগরীর জনসংখা ছিল আগের থেকে অনেক কম। দশম শতাব্দীতে কনস্টান্টিনোপলের জনসংখ্যা যেখানে ছিল প্রায় দশ লক্ষ, ১৪৫৩ সালে এর জনসংখ্যা কমে গিয়ে ছিল মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার। শহরটিতে প্রবেশ করতে রাখা হয় মাত্র একটি দ্বার। শহরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতা খুঁজে বের করতে কনস্টান্টিনোপলে মোহাম্মদ পাঠিয়ে দেন শত শত গুপ্তচর।
সুলতান মোহাম্মদ ভালভাবেই জানতেন যে, কনস্টান্টিপোল জয় করতে হলে তাঁকে নিতে হবে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত রণ-কৌশলের মিশ্রণ। ঐ সময় বাইজেন্টিনদের হয়ে কাজ করতো হাঙ্গেরী থেকে আগত এক কামান নির্মাতা, যার নাম ছিল অর্বান (Orban)। মোহাম্মদ অর্বানকে চার গুন অর্থ দিয়ে নিয়ে আসলো তাঁর কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কামান নির্মাণের জন্য। মোহাম্মদের তদারকিতে অর্বান বানিয়ে ফেললো ২৬ ফুট লম্বা বেরোলের এক বিশাল কামান। কামানটির নাম ছিল ব্যাসিলিকা (Basilica)। কামানটি হাজার পাউন্ডের গোলা এক মাইল দূরে নিক্ষেপ করতে পারতো অনায়াসে। এর গগন বিদারী শব্দ শোনা যেত দশ মাইল দূর থেকে।
সুলতান মোহাম্মদ এক লক্ষর মতো এক বিশাল সৈন্য বাহিনী (কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে এ সংখ্যা ছিল ৫০-৮০ হাজার) নিয়ে ১৪৫৩ সালের এপ্রিল মাসের ৬ তারিখ কনস্টান্টিনোপল শহরকে ঘিরে ফেলেন জলে এবং স্থলে। বাইজেন্টাইনদের ছিল মাত্র সাত থেকে নয় হাজার সৈন্য। তাদের এ সামরিক শক্তি মোহাম্মদের সেনাবাহিনীর কাছে ছিল অত্যন্ত নগন্য। তবে, বাইজেন্টাইনরা নিশ্চিত ছিল যে, অটোমানরা তাদের দু’স্তরের শহর রক্ষার প্রাচীর ভেদ করে কিছুতেই শহরে প্রবেশ করতে পারবে না।
এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ, মোহাম্মদ প্রথম হামলা করে শহরটির প্রাচীরে। বাইজেন্টাইনদের প্রতিরক্ষা ছিল সুদৃঢ়। অটোমানরা বড় বড় মই দিয়ে উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর টপকিয়ে নগরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। হেরে যায় তারা বারবার। বাইজেন্টাইনদের সৈন্যরা প্রাচীরের উপর থেকে অটোমানদের উপর উত্তপ্ত তেল ঢেলে দিয়ে নগর প্রতিরক্ষা করতে থাকে। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। এদিকে মোহাম্মদের নৌবাহিনীর কামান সজ্জিত ১৫০টি যুদ্ধ জাহাজ বসবরাস প্রণালী দিয়ে এগিয়ে চললো নগরীর দিকে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, কনস্টান্টিনোপলের তিন দিকে জল। বসবরাস প্রনালী শহরটির উত্তর দিক থেকে কৃষ্ণ সাগর হতে কনস্টান্টিনোপলের পূর্ব দিক ঘেঁষে মারমারা সাগরে এসে মিশেছে। সরু একটি জলপথ বসবরাস প্রণালী থেকে বেরিয়ে গালাতা (Galata) এবং কনস্টান্টিনোপলের মাঝ দিয়ে শহরটির উত্তর-পশ্চিম পাশ দিয়ে গিয়ে থেমেছে। এই ছোট্র জল পথকে বলা হয় গোল্ডেন হর্ন (Golden Horn)। কনস্টান্টিনোপলের চারিদিক ছিল প্রাচীরে ঘেরা। মোহাম্মদের গুপ্তচরেরা সংবাদ পাঠালো যে, নগরীর উত্তর দিক, অর্থাৎ গোল্ডেন হর্নের দিকে মুখ করা কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল। বাইজেন্টাইনরাও তাদের প্রতিরক্ষার এ দুর্বলতা জানতো। তাই তারা বসবরাস প্রণালী থেকে গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ পথ বড় বড় লোহার শিকল দিয়ে বন্ধ করে দেয়।
মোহাম্মদ যখন জানতে পারলো যে বাইজেন্টাইনরা গোল্ডেন হর্নের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে বড় বড় লোহার শিকল দিয়ে, তিঁনি তখন তাদের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলার কোন চেষ্টাই করলেন না। পরিবর্তে, গোল্ডেন হর্ণে তাঁর নৌবাহিনীর জাহাজ প্রবেশের এক অকল্পনীয় পরিকল্পনা করলেন মোহাম্মদ। এক অসম্ভবকে সম্ভব করলেন তিঁনি, যা’ আগে কেউ কখনো করার দুঃসাহস করে নি। মনে রাখতে হবে, তাঁর বয়স তখন মাত্র ২১। নির্দেশ দিলেন তাঁর বাহিনীকে, রাতের অন্ধকারে কামান-সজ্জিত ৮০টি জাহাজকে বসবরাস জল-প্রণালী থেকে টেনে ডাঙায় তুলতে। যেমন নির্দেশ, তেমনি কাজ। সারা-রাত মশাল জ্বালিয়ে চললো এ কঠিন কর্মযজ্ঞ। উঠানো হলো ৮০টি বড় বড় জাহাজ বসবরাসের পশ্চিম তীরে, ইউরোপের ভূমিতে। কামান এবং গোলা-বারুদসহ একেকটি জাহাজের ওজন ছিল কয়েক টন। এখানেই শেষ নয়। এবার মোহাম্মদের আদেশ দিলেন, জমিনের উপর বড় বড় কাঠের টুকরো ফেলে সবগুলো জাহাজকে দশ মাইল টেনে প্রতিবন্ধকতার অপর প্রান্তে গোল্ডেন হর্ণের জলে নামাতে।
গ্রিজ দিয়ে কাঠগুলোকে করা হলো পিচ্ছিল। এ কাজে নিয়োগ করা হলো ৬০ টি শক্তিশালী ষাঁড়। হাজার হাজার সৈন্য প্রতিটি জাহাজকে উঁচু-নীচু ভূমির উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নামালো দশ মাইল দূরের গোল্ডেন হর্ণের পানিতে। এগুলো সরাসরি তদারকী করলেন সুলতান নিজে। বাইজেন্টাইন সৈন্যরা তাদের প্রাচীরের উপর থেকে শুধু দেখলো রাতের অন্ধকারে মশালের ছুটোছুটি, টের পেলো না কি ভয়ঙ্কর বিপদই না অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এক সকালে অবাক বিস্ময়ে বাইজেন্টাইনরা দেখলো গোল্ডেন হর্ণে অটোমানদের নৌবাহিনীর কামান-সজ্জিত ৮০টি জাহাজের উপস্থিতি।
জাহাজগুলো থেকে ১৪টি গোলন্দাজ ব্যাটারী কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরের তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে দিন-রাত চললো অবিরাম গোলা বর্ষণ। বড় কামান বাসিলিকা মাত্র তিন বার গোলাবর্ষণ করতে পারতো প্রতিদিন। কারণ, একবার গোলা ছোড়ার পর কামানটি হয়ে যেত অসম্ভব গরম, অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেত এটির তাপমাত্রা। সাত সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে জলে এবং স্থলে এ আক্রমন বিরতিহীনভাবে চলার পর, ২৯শে মে ১৪৫৩ সাল, মোহাম্মদ নির্দেশ দিলেন তাঁর বাছাই করা অপেক্ষমান ৫ হাজার জানিসারি সৈন্যকে চূড়ান্ত আক্রমণের। তিঁনি কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন তাঁর সৈন্যদের যে, কোন দুর্বল মানুষ, নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের হত্যা করা যাবে না এ আক্রমণে।
জানিসারিরা ঢুকে পড়লো শহরে। কনস্টান্টিনোপলের অভ্যন্তরে জানিসারিরা সৃষ্টি করলো ত্রাস। ভয়ে পালিয়ে গেলো বাইজেন্টাইন সৈন্যরা। বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টান্টিন একাদশ (Constantine XI) বুঝতে পারলো হাজার বছরের উপর একচ্ছত্র আধিপত্যকারী রোম সাম্রাজ্যের পতন আসন্ন। সম্রাট নিজে নেমে গেলেন সম্মুখ লড়াইয়ে, নিহত হলেন অটোমানদের হাতে। হেরে গেলো বাইজেন্টাইনরা অটোমানদের কাছে। রোমান সম্রাজ্যের এ ছিল এক অকল্পনীয় পরাজয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করলে, এ বিজয় ছিল এশিয়ান জনগোষ্ঠীর ইউরোপ জয়।
কনস্টান্টিনোপল জয় দ্বিতীয় মোহাম্মদকে এনে দিল বিশ্বখ্যাতি এবং প্রতিপত্তি। মোহাম্মদ অজেয় কনস্টান্টিনোপল জয় করে বিশ্বকে লাগিয়ে দেয় তাক। অটোমানদের এই বিজয় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে দিলো এক ভয়াবহ ধাক্কা। বাজিয়ে দেন রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ঘন্টা। তিঁনি এ বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন বিশ্ব-রাজনীতির মঞ্চে তাঁর স্থান এবং গুরুত্ব। কনস্টান্টিপোলের বিজয় বিশ্বে তাঁকে এনে দেয় “বিজয়ী” (the Conquror) খেতাব। এ বিজয় বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথকে করে দেয় আমূল পরিবর্তন। সুলতান মোহাম্মদ বাইজান্টাইনদের পাঠিয়ে দেন ধুলোয় আবৃত ইতিহাসের পেছনের পাতায়। অটোমানদের ঝলমলে সাফল্য দৃঢ়তার সাথে তিঁনি লেখেন ইতিহাসের ঝকঝকে পাতায়।
এর আগে কনস্টান্টিনোপল জয় করতে চেয়েছিল অনেকেই, ব্যর্থ হয় সবাই। মাত্র ২১ বছর বয়সে দ্বিতীয় মোহাম্মদ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য জয় করে বিশ্বকে দেন তাঁর সামরিক শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার বার্তা। এই বিজয়ের মাধ্যমেই মোহাম্মদ অটোমানদের দেখিয়ে দিয়ে যান ইউরোপে প্রবেশের স্বপ্ন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই অটোমানরা কয়েক শতাব্দী ধরে তিনটি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত করে তাদের সাম্রাজ্য। এ সন্ধিক্ষণ থেকেই আরম্ভ হয় অটোমানদের স্বর্ণযুগের।
জয়ের পরপরই মোহাম্মদ কনস্টান্টিনোপলকে ঘোষণা করেন অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। কালক্ষেপণ না করে, এবার নেমে পড়লেন শহরটিকে পুনর্নির্মাণে। তিঁনি তাঁর নতুন রাজধানীতে বাস করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে। খ্রিষ্টান এবং ইহুদীদেরকে দেয়া হলো বিশেষ সুরক্ষার অঙ্গীকার এবং পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল না নগরটিকে শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা, বরং চেয়েছিলেন এটিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে, যেখানে থাকবে এক সুশিক্ষিত, দক্ষ, সুশৃংখল জনগোষ্ঠী। করেছিলেনও তাই। দক্ষ কারিগর আসতে থাকলো বুর্সা থেকে, তাঁতিরা এলো এশিয়া থেকে, স্বর্ণকার আসলো ভারতবর্ষ থেকে।
১৪৬৫ সালে ৩৩ বছর বয়সে মোহাম্মদ ১৭৩ একর জায়গা নিয়ে ইস্তানবুলের কেন্দ্রে নির্মাণ করেন টোপকাপি রাজপ্রাসাদ (Topkapi Palace)। শহরটিতে গড়ে তুলেন দু’টো বড় হাসপাতাল, দশটি মসজিদ, পাঁচটি উন্নত মানের বিদ্যালয়, ২২টি মার্বেলের ঝর্ণা। নগরীতে গড়ে তুললেন গ্র্যান্ড বাজার (Grand Bazar), যা’ ইস্তানবুলে আজো আকর্ষণ করে সবাইকে। প্রতিদিন শহরের ৫০০০ মানুষকে দেয়া হতো বিনামূল্যে খাবার। তিনি ছিলেন একজন খুবই প্রগতিশীল সৈনিক এবং শাসক। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল অনেকটা নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো।
এরপর সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ জয় করেন ইউরোপের রুমানিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, মরিয়া, ট্রাবজোন, গ্রীসের উত্তরের ছোট ছোট রাজ্য এবং তুর্কীর উত্তরাঞ্চলগুলো। ১৪৮০ সালে জয় করেন ইতালীর ওটরান্টো (Otranto) প্রদেশ। লক্ষ্য ছিল রোম দখল করার, কিন্তু দুর্ভাগ্য, ৪৯ বছর বয়সে মোহাম্মদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় ১৪৮১ সালে। তাঁর সময়ে অটোমান সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়ে দাঁড়ায় ২২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারে।
যদিও মোহাম্মদকে স্মরণ করা হয় মূলত তাঁর চমকপ্রদ উদ্ভাবনী রণ-কৌশল এবং সামরিক সফলতার জন্য, আসলে তিনি ছিলেন একজন অসম্ভব বিচক্ষণ, বিজ্ঞ এবং জ্ঞানী মানুষও। পড়াশুনার প্রতি তিঁনি ছিলেন অসম্ভব অনুরক্ত। মোহাম্মদ ফার্সি, আরবী, গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষা জানতেন ভালো করে। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে ছিল জ্যামিতি, ধর্ম, কারিগরি, গণিত, ভূগোল এবং দর্শন নিয়ে অনেক বই। চিত্র শিল্পের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ আকর্ষণ। বলা হয়, সুলতান মোহাম্মদ তখনকার ইতালিয়ান রেনেসাঁ চিত্রকর জেন্টাইল বেলিনীকে (Gentile Bellini) দিয়ে অনেক চিত্রকর্ম করিয়ে নেন। ১৪৭৯ সালে মোহাম্মদের অনুরোধে ভেনেটিয়ান সরকার চিত্রকর বেলিনীকে অটোমান রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে পাঠান। তাঁর লাইব্রেরীর সংগ্রহে আরো ছিল হোমারের ইলিয়াড, ক্লডিয়াস টলেমিয়াসের প্রাচীন বিশ্বের মানচিত্র, এবং আরো অনেক দুর্লভ গ্রন্থ। মনে করা হয়, মোহাম্মদের সামরিক উচ্চাশা অনেকটা আলেকজান্ডারের জীবনী দিয়ে অনুপ্রাণিত। এ বিজয়ী শাসক ইতিহাসের পাতায় রেখে যেতে পেরেছেন তাঁর অবিস্মরণীয় পদচিহ্ন।