গৌতম বুদ্ধ

যথাযথ সচেতনতা ও আইনগত দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব কিছু প্রযুক্তি বা খাবারের পেটেণ্ট ভারতের কাছে চলে যাচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের তৈরী দুই ধরণের জামদানির পেটেণ্ট ভারতীয়রা নিয়ে নিলো। একইভাবে আমাদের ফজলি আমের পেটেন্ট তাদের কাছে চলে গেছে। এরপরে তারা আমাদের রক্তের সাথে মিশে থাকা হাজার বছরের ঐতিহ্যে ভরা এই নকশি কথা নিজেদের নামে পেটেণ্ট করার দাবি করেছে। সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে আমরা ইলিশ মাছের পেটেণ্ট বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু অন্যান্য গুলির ক্ষেত্রে যদি পদক্ষেপ না নেয়া হয় তবে ট্রিপ্স চুক্তি কার্যকরী হলে, আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত জিনিসের জন্যে অন্য দেশকে রয়েলটি দিতে হবে।

চাঁপাই নবাবগঞ্জ

কাঁটাতারে সীমান্ত পেরিয়ে এবার তারা হাত বাড়িয়েছে আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জের ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আমের দিকে। ওরা খুব তৎপর হয়েছে এগুলোকে নিজেদের নামে করার জন্য। ঘটনাটার সূত্রপাত আসলে দেশ বিভাগ। এর আগে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও ভারতের মালদা পাশাপাশিই ছিল। দেশ ভাগের কারণে দুটি ভিন্ন ভূমি জন্ম নিলেও গাছগুলোর জন্ম কিন্তু একই মাটিতে। রেটক্লিফ মশাইকে তার এই কুকর্মের জন্যে অভিশাপ দেয়া ছাড়া আমাদের আর করার কিছুই নেই। তাই সময় থাকতে সঠিক প্রমাণাদি দেখিয়ে ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আমের পেটেণ্ট নিজেদের নাম করে নিতে হবে।

সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাট আকবর, এবং সম্রাট শাহজাহান

ভারতীয় উপমহাদেশ এবং আম এই দুইয়ের সাথে সম্পর্কটা অনেক দিনের। আম শব্দটি মালায়াম শব্দ ‘ম্যাঙ্গা’ থেকে আমাদের দেশে এসেছে। আর এই মিষ্টি উপাদেয় আমকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে পর্তুগিজরা। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘Mangifera Indiaca’। এই নাম থেকে আমরা বুঝতে পারি আম আমাদের এই উপমহাদেশেরই ফল। মেঘালয় থেকে আমরা ৬০ মিলিয়ন পুরোনো একটি আমের ফসিল পাওয়া গিয়েছে। এটি প্রমান করে আমের আদি নিবাস আমাদের এই উপমহাদেশ। আর এই আমাদের বাড়ির পাশেই। যেখানে ফসিলটি পাওয়া গিয়েছিল সেই জায়গাটা ছিল বনে জঙ্গলে ভরা এবং এর প্রজাতিও ছিল জংলী।। ভারতীয় গ্রন্থ উপনিষদেও ৫০০ খিস্টপূর্বে আমকে ‘আমড়া’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। নানা গল্প কথায় আছে, গৌতম বুদ্ধ আমগাছের নিচে বসে ধ্যান করেছিলেন। সেখানে একবার অলৌকিকভাবে বাতাসে তিনি নাকি সাদা আম গাছ তৈরী করেছিলেন, যা সকলকে তাজ্জব করে দেয়। তার মতে, আম হচ্ছে জ্ঞানের আধার, শান্তির প্রতীক।

দেবী অম্বিকার হাতে আমের গুচ্ছ

জৈন ধর্মের দেবী অম্বিকার হাতে এক গুচ্ছ আম দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মতে, আম হচ্ছে উন্নতি ও সম্পদের প্রতীক। দেবীর হাতে যে আমের গুচ্ছ পাওয়া গিয়েছিলো, তা ছিল উর্বরতার প্রতীক। রাজা – রাজড়াদের পসন্দের ফল যে আম ছিল, ইতিহাসের পাতা থেকে তা আমরা জানতে পেরেছি। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় সম্রাট অশোকের যে পিলার রয়েছে, সেখানে খুব গুরুত্বের সাথে সম্রাট অশোক আমের মহত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। ভারতবর্ষের আম যে এতো জনপ্রিয় ছিল , ১৪ শতকে ইবনে বতুতার লেখা ভারতবর্ষের বিবরণীতে তা উল্ল্যেখ করেছেন। আমের তৈরী আচার যে কতটা জনপ্রিয় তার বিবরণীর লাইনে লাইনে তা লিখে গেছেন।

রেডক্লিফ

যুগ যুগ ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্য তালিকায় আম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মোঘলদের কাছেও যে আম অতি প্রিয় ফল তা বারবার উল্ল্যেখ করা হয়েছে। বাবরনামা, আইনে আকবরী, তুজুখে জাহাঙ্গীরে আমকে বেহেস্তের ফলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আমের প্রতি এই ভালোবাসার কারণেই বিহারের আশেপাশে সম্রাট আকবর প্রায় আড়াই হাজার আম গাছ রোপণ করেছিলেন। হতে পারে আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জের আমগাছগুলোর মধ্যে আকবরের রোপিত গাছের উত্তরসূরি রয়েছে।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাট শাহজাহান – এর সামনে তাদের খানসামার যখন আমের তৈরী একটি বিশেষ খাবার ‘আম পান্না’ পরিবেশন করতো, সম্রাটরা খুশি হয়ে খানসামাদের দামি দামি পুরস্কার দিতেন। আম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তো আমরা এই ইতিহাস থেকেই জানতে পারলাম। তাই আমরা আশাবাদী যে, আমাদের ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আমের পেটেন্ট যেন আমাদের কাছেই থাকে।

বাবরনামায় আমের বর্ণনা

তথ্যসূত্র: Leora Pezarkar, Live History India.