১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০ এর দশকের শুরুর দিকের কোনো এক সময়ে, অর্থাৎ আনুমানিক ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এক অজানা সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পেয়েছিলেন আমুদরিয়া নদীর পাশে।

বেশ নতুনত্ব দেখা গিয়েছিলো খুঁজে পাওয়া সেই প্রত্নবস্তুগুলোর মাঝে। আগে কখনোই এমন পুরাতত্ত্বের দেখা মেলে নি। আমুদরিয়াকে গ্রীকরা নাম দিয়েছিলেন অক্সাস নদী। বর্তমান তুর্কমেনিস্থান ও আফগানিস্তানের এই অঞ্চলটিকে এক সময় ‘ব্যাক্ট্রিয়া’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের সময়ে পার্সিয়ান আকেমেনিড সাম্রাজ্যের একটি সত্রপ ছিলো এই ব্যাক্ট্রিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৫২০ সালের ডেরিয়াসের বেহিশতুন শিলালিপিতে সর্বপ্রথম ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্যের কথা জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ১০০ সাল পর্যন্ত এটি একটি স্বাধীন গ্রীক রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়।

১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব তুর্কমেনিস্থানের মার্ভ শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে মার্জিয়ানাতে আবারও কিছু প্রত্নবস্তু পাওয়া গেলো। একই ধরনের প্রত্নবস্তু বেশ কিছুটা দূরে ইরানেও পাওয়া গেলো। সোভিয়েত প্রত্নতত্ত্ববিদ ভিক্টর সারিয়ানিদি একে ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা কমপ্লেক্স বা সংক্ষেপে বিম্যাক নামকরণ করেন। আর আমুদরিয়া বা অক্সাস নদীর আশেপাশের এলাকায় পাওয়া পুরাতত্ত্বগুলোর ভিত্তিতে বলা যায়, অক্সাস নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠা এই কমপ্লেক্স মূলত অক্সাস সভ্যতার নিদর্শন, যা ব্রোঞ্জ যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা।

অক্সাস সভ্যতাঃ ব্রোঞ্জ যুগের এক সমৃদ্ধ

প্রত্নতাত্ত্বিক ভিক্টর সারিয়ানিদির নেতৃত্বে খনন © Wikipedia

আমুদরিয়া নদী বছরে দুই বার তার তীরভূমিকে প্লাবিত করে। এই তীরভূমি প্লাবিত হবার পর উর্বর মাটিতে পরিণত হয়। নদীর স্বচ্ছ পানি ও পলি মাটি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন শুরু করেন অক্সাসের তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা। কৃষিকাজের মাধ্যমেই তারা অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। তবে শুধু কৃষিকাজের উপরই যে তারা নির্ভরশীল ছিলেন, তা কিন্তু নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেও নিজেদের বেশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা। নাতিশীতোষ্ণ এই অঞ্চলের পাহাড়ে ছিলো নানা রকম গাছ-গাছরা। হরেক রকম ফল উৎপাদিত হতো সেখানে। এসব খাবার আহরণ করে নিজেদেরকে একটি উন্নত অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছিলো অক্সাসবাসীরা।

আগেই বলা হয়েছে, আবহাওয়াটা ছিলো বেশ ধনাত্মক। আমুদরিয়ার পাশেই বন অঞ্চল। বড় বড় গাছগুলোতে উৎপাদিত প্রচুর ফল তো তারা খেতেনই, সেই সাথে বনাঞ্চলের পাখিদের মাধ্যমে তারা নিজেদের আমিষের চাহিদাও পূরণ করতেন। পুকুর ও নদীতেও ছিলো প্রচুর মাছ। এছাড়াও অঞ্চলটি ছিলো খনিজ সম্পদে ভরপুর। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবেই বা না কেনো! সব কিছু মিলিয়ে এক অসম্ভব সুন্দর পরিবেশে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠছিলো এই সভ্যতা।

অক্সাসবাসীর সমৃদ্ধি তাদেরকে আশেপাশের মানুষের সাথে যোগাযোগ তৈরীতে ভীষণভাবে সহায়তা করেছিলো। সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক এই সভ্যতার প্রতি অন্যরাও কম আকর্ষিত হয় নি। হরপ্পা, মেসোপটেমিয়া, অ্যানাটোলিয়া ও লেভান্টের সাথে তাদের শক্তিশালী যোগাযোগ গড়ে উঠলো। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যকার সময়ে শহরকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে শুরু করে। যোগাযোগের সমতাও হয় বিরাজমান। তাই এই সময়টিকে স্বর্ণ যুগ বলা যেতে পারে। এই সময়েই অক্সাসবাসীদের প্রাচীর ঘেরা কম্পাউন্ড ও ছোট প্রাসাদগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করে।

অসংখ্য অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অক্সাসের নিদর্শনগুলো তাদের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ককেই জানান দেয়। সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আনাউ ছাড়াও অক্সাসের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য সাইট হলো গনুর টেপে।

অক্সাস সভ্যতাঃ ব্রোঞ্জ যুগ

ব্যাক্ট্রিয়ান শিল্পকর্ম © Wikipedia

ভিক্টর সারিয়ানিদির মতে, সুদূর পশ্চিম থেকে আগুনের পবিত্রতা ও জরাথ্রুস্টবাদের আদর্শ নিয়ে আসা এক দল লোকেরই রাজধানী ছিলো গনুর। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, শহরটির সর্বোচ্চ বিকাশের সময় এখানে প্রায় হাজারখানেক মানুষের সমাগম ছিলো। বর্তমানকালের প্রত্নতত্ত্ববিদরা দক্ষিণ তুর্কমেনিস্থানের এই অঞ্চলটিকে ‘গনুর টেপে’ নামকরণ করেছেন।

গনুরে নানা রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ বাড়িঘর দেখা যায়। এটি ছিলো একটি ব্যক্তিগত আবাসস্থল, জনসাধারণের স্থান। প্রাসাদের মতো একটি স্থাপনাও গনুর টেপেতে পাওয়া গিয়েছে। এখানে একটি সিংহাসন ঘর বা প্রাসাদ সভাস্থলেরও দেখা মিলেছে। এ ছাড়াও আশেপাশে আরো কতগুলো ছোট ছোট ঘর ছিলো।

প্রাসাদের পাশে একটি পুকুরের মতো জলাধারও ছিলো। সেখানে আবার পাইপের মাধ্যমে মাটির নিচ দিয়ে প্রাসাদের সম্মুখভাগে পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিলো। অনেকেই মনে করেন, প্রাসাদে প্রবেশের পূর্বে নিজেদের পরিষ্কার করার জন্যই এমন জলাধারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলা। প্রাসাদটি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আবাসস্থল ছিলো, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

অক্সাস সভ্যতাঃ ব্রোঞ্জ যুগের এক

ব্যাক্ট্রিয়ান রাজকুমারী © Wikipedia

আরো বেশ কিছু স্থাপনা পাওয়া গিয়েছে ঐ অঞ্চলে। তবে কোনটিই এই প্রাসাদের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। গনুর টেপেতে প্রাত্যহিক জীবনের বিলাসি দ্রব্য তৈরীর কারখানাও পাওয়া গিয়েছে। অক্সাস সভ্যতার কোন লিখিত ভাষা ছিলো না। তাই এই সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে প্রত্নবস্তুগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রত্নবস্তুগুলো সামান্য খেয়াল করে দেখলেই তাদের পোশাক-পরিচ্ছদসহ সমস্ত কিছুর একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সহজেই বোঝা যায়, সেই সময়কার উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জীবনধারা কেমন ছিলো। কিছু মূর্তির পরনের কাপড়গুলো ছিলো একদিকে জড়ানো। কাপড়ের ধরন আর চেহারার ভাবই বলে দেয় যে, তারা অত্যন্ত বিত্তবান ছিলো।

চাকাওয়ালা গাড়ির ছবি চিত্রিত করা একটি কাপ পাওয়া গিয়েছিলো অক্সাসের পুরাতত্ত্বগুলোর মাঝে। চিত্রের গাড়িটি একজন ব্যক্তি একটি মহিষ দিয়ে চালাচ্ছেন এবং তার হাতে একটি ছুড়িও ছিলো। এমনি আরো বহু আকর্ষণীয় নিদর্শনই আমাদেরকে অক্সাসের জীবনশৈলী সম্পর্কে ধারণা দেয়।

গনুর টেপের মানুষগুলো এতো অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে এতো সুন্দর শহর গড়ে তুলেছিলো, তা আজও এক বিস্ময় হয়ে আছে সবার কাছে। প্রত্নবস্তুগুলোকে বিশ্লেষণ করে এটা স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে দক্ষিণের সিন্ধু উপত্যকা, ইরানের জিরফট, ইলাম ও পার্সিয়ার সাথে তাদের যোগাযোগ ছিলো।

গনুর টেপেতে ভারতীয় সমুদ্রসীমা থেকে আনা একটি ঝিনুকের উপর কাজ করা প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে, যেখানে আক্কাদীয় ভাষা খোদাই করে কিছু একটা লেখা ছিলো। একটি স্ট্যাম্প সীলের মতো অংশও দেখা গিয়েছে, যেটি দেখতে হরপ্পার সীলের মতো। অক্সাস সভ্যতার অন্যতম একটি সাইট থেকে ইলাম অঞ্চলের মতো চিত্র পাওয়া গিয়েছে। ইরানের জিরফট অঞ্চলেও কিছু প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়, যেখানে অক্সাসের চরিত্রগুলো দৃশ্যমান। লিখিত কোনো প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা না গেলেও অনেকে মনে করেন যে, হরপ্পা অঞ্চলের সাথে অক্সাসের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো।

অক্সাস সভ্যতাঃ ব্রোঞ্জ যুগের এক

গনুর দেপে ঘোড়ার কবর © Wikipedia

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে অক্সাসে। বৃহৎ সমাজগুলো ভেঙে ছোট ছোট অঞ্চল তৈরী হয়। জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটতে শুরু করে। যে ব্যবসা-বাণিজ্য তারা গড়ে তুলেছিলেন, তাও ধীরে ধীরে কমে যায়। বিভিন্ন সমাধির মধ্যে মেলা অস্ত্রগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, সেই সময়টায় তারা যুদ্ধবিগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। কেনো এমন হয়েছিলো, তা আজও জানা যায় নি। মনে করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন, খরা প্রভৃতি কারণে তাদের পরিবেশে প্রতিকূলতা বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে আস্তে আস্তে তারা বিলীন হয়ে যায়। আরেকটি প্রচলিত ধারণা হলো, এই অঞ্চলের ওপর উত্তরাঞ্চলের শক্তির আগ্রাসী আক্রমণের সম্ভাবনা। আমুদরিয়া অঞ্চলে প্রথম থেকেই কোনো ঘোড়া ছিলো না। কিন্তু আব্বাসীয় সমাজের অত্যন্ত বিত্তশালী একজন ব্যক্তির কবর থেকে চ্যারিয়টসহ ঘোড়ার কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। অবশ্যই এটি কোনো ব্যবসায়িক বিনিময়ের মাধ্যমেই হয়েছিলো। হয়তো ঘোড়সওয়ার জাতির আগমনই এই সভ্যতাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। কিংবা হয়তো নিজেদের অন্তঃর্দ্বন্দ্বই ছিলো এর মূল কারণ।

অক্সাসের পতন নিয়ে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলেও একটি বিষয় নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই সভ্যতা ব্রোঞ্জ যুগের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ নিদর্শন। অক্সাসের সম্পদের প্রাচুর্যই তাকে সে সময়ের বিশেষ সভ্যতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলো।

রেফারেন্স: