১০ আগস্ট ১৯৪৭। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভা বসে বন্দরনগরী করাচিতে। সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী। জনবিরল ছিমছাম এক শহর। বাংলা থেকে গেছেন কিরণশংকর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, একে ফজলুল হকের মতো সব রাজনীতিবিদ। চার দিন পরেই ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। জন্ম হতে যাচ্ছে নতুন একটি দেশের।
প্রতি ১০ লাখে একটি আসন ধরে গণপরিষদে মোট আসন ৬৯টি। এর মধ্যে ৫০টি মুসলমান, ১৭টি হিন্দু আর ২টি শিখ আসন। প্রথম অধিবেশনে অস্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত করা হয় পূর্ব বাংলার দু’জন সদস্যকে। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আর নমশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। প্রথম সভায় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সভাপতিত্ব করেন। এতে অনেকেই অবাক হয়ে যান। কারণ যোগেন মণ্ডলের অল ইন্ডিয়া শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন বাংলায় ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র একটিতে জিতেছিল। কংগ্রসে থেকে চারজন এমএলএ ভাগিয়ে আনতে না পারলে তার গণপরিষদে আসাই হতো না। এক বছরের মধ্যে মাত্র একটি আসন নিয়ে প্রথমে প্রাদেশিক, পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন। এখন একলাফে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি!
সে অধিবেশনে গণপরিষদের আসন সংখ্যা ৭৯ করা হয়। পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হওয়া ৫টি প্রিন্সলি স্টেট আর উদ্বাস্তুদের জন্য ১০টি নতুন আসন করা হয়।
যোগেন সেদিন কৃতজ্ঞচিত্তে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ’র প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ’। সেদিনের অধিবেশনে পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতি নির্বাচন করা হয় কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে।
যোগেনের সভাপতি হওয়াতে যেমন সবাই বিস্মিত হয়েছিল, তেমনি আশাবাদীও। কারণ সেক্যুলার জিন্নাহ যেভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে একটা রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছিলেন, সেই রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শ নিয়ে সবার কৌতূহল ছিল। রাষ্ট্রটি সৃষ্টির অন্তত চারদিন আগে তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন কী হতে যাচ্ছে।
পরের দিন কায়েদে আজম তাঁর সভাপতির ভাষণে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রটির নীতি এবং আদর্শ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। উর্দুতে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, In course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the State. অর্থাৎ ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তানে হিন্দুর হিন্দু হওয়া আর মুসলমানের মুসলমান হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ধর্ম হবে একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস। সবাই নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তিনি বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, You may belong to any religion or caste or creed – that has nothing to do with the business of the state. অর্থাৎ একজন নাগরিক কোন ধর্ম বর্ণ কিংবা সম্প্রদায়ের- সেটা দেখা রাষ্ট্রের বিষয় নয়। তিনি আরো বলেন, You are free to go to your temples, mosques or any other place of worship…
তিনি কোন সময় এই কথাগুলো বলেছেন একটু বিবেচনায় নিতে হবে। তখন পাঞ্জাব সিন্ধু উত্তর পশ্চিম প্রদেশ কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পরে জানা যায় এই দাঙ্গায় ন্যূনতম ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে। সেসময় তিনি বলছেন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে কাউকে বিবেচনা করা হবে না। বিবেচনা করা হবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে।
কট্টরপন্থী মুসলীম লীগ সদস্যরা জিন্নাহ’র এই উদারনৈতিক কথা শুনে ভড়কে যায়। তারা তখন বক্তৃতাটি কাটছাট করে পত্রিকায় দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা, যা মুসলীম লীগের মুখপত্র হিসেবে বিবেচিত হতো সেই ‘দ্য ডন’-এর সম্পাদক ছিলেন একজন বাঙালি। সিলেটের আলতাফ হুসাইন। তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পুরো ভাষণটিই ছেপে দেন। ফলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা বিফল হয়। এ তথ্যগুলো জানা যায় পাকিস্তানি লেখক খালিদ আহমেদের Pakistan Behind the Ideological Mask থেকে।
আরেক লেখক জামির নিয়াজি জানান, আলতাফের সহকারী হিসেবে তখন কাজ করতেন জে এ জুবায়েরি। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান আর্মির জনসংযোগ কর্মকর্তা নাকি আলতাফ হুসাইনকে ফোন করে সেদিন জিন্নাহ’র ভাষণের কিছু অংশ না ছাপাতে বলেছিল। আলতাফ ‘ডন’ সম্পাদনার পাশাপাশি জিন্নাহ’র উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। আর্মির ফোন কল পেয়ে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে তিনি নিশ্চিত হন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তাঁর ভাষণ প্রকাশের ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনা দেননি। তিনি নিশ্চিন্ত মনে পুরো ভাষণটি পরের দিনের পত্রিকায় ছেপে দেন। আলামত গায়েবের চেষ্টা বিফলে যায়। নিয়াজি আরো জানান জিন্নাহ’র সামনেই নাকি পাকিস্তান আর্মি অফিসাররা আলতাফকে পুরো ভাষণ ছাপানোর কারণে হুমকি দেয়।
এ থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তান আর্মি পাকিস্তান সৃষ্টির অন্তত তিনদিন আগে থেকেই দুরভিসন্ধি নিয়ে এগুচ্ছিল। কিন্তু তারপরও তারা দমে যায়নি। জিন্নাহ’র ভাষণের সেক্যুলার অংশগুলো কেটে রেডিওতে শোনানো হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই ভাষণ দেওয়ার ঠিক তেরো মাসের মাথায় এই করাচিতেই জিন্নাহ মারা যান। লোক দেখানো গভর্নর জেনারেল হন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন। আড়ালে সব ক্ষমতা চলে যায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের হাতে। তিনি ছিলেন যুক্ত (উত্তর) প্রদেশ থেকে যাওয়া উদ্বাস্তু। যুক্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুরা মুসলীম লীগ ও সেনাবাহিনীতে একটা কট্টরপন্থী ধারা সৃষ্টিতে ব্যস্ত ছিল। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে তখন পাঞ্জাবীদের একচ্ছত্র আধিপত্য।
তারা বিশ্বাস করত, সর্বস্তরে ধর্মীয় অনুশাসন প্রয়োগ করা না গেলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঐক্য সার্বভৌম ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ দেড় হাজার মাইল দূরত্বের দুটি ভূখণ্ড যার একমাত্র ঐক্যের সূত্র হচ্ছে ধর্ম। এই ধর্মীয় কট্টরতা বজায় না থাকলে একসময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ মিশে যেতে পারে। আর পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা পাকিস্তানের অপর অংশ থেকে বেশি। দুই অংশের সংখ্যা-সাম্য প্রতিষ্ঠার সহজ উপায় পূর্ববঙ্গ থেকে দেড় কোটি সংখ্যালঘু সরিয়ে দেওয়া।
১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৌলিক প্রস্তাবনা (অবজেক্টিভ রেজুলেশন) উপস্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তান একটি ইসলামিক রিপাবলিক হতে যাচ্ছে। প্রস্তাবনার শুরুতেই বলা হয়, Sovereignty over the entire universe belongs to Allah Almighty alone and the authority which He has delegated to the state of Pakistan, through its people for being exercised within the limits prescribed by Him is a sacred trust.
বাংলা থেকে যাওয়া গণপরিষদ সদস্য শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মকে টেনে আনার কোনো সুযোগ নেই। যোগেন মণ্ডলও এর বিরোধিতা করেন। ততদিনে সদস্যদের দেশত্যাগের কারণে পাকিস্তান গণ-পরিষদের সদস্যসংখ্যা ৭৫-এ দাঁড়িয়েছে। ২১ জন সংখ্যালঘু সদস্যের বিরোধিতার মুখে ১২ মার্চ প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের একটিও সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় না।
এই বিলটি পাস হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান দ্রুত জিন্নাহ’র সেক্যুলার ভাবাপন্ন রাষ্ট্র থেকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে থাকে। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে এর চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে পাওয়া যায়। পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করা হয়।
অবজেটিভ রেজুলেশনের বিরোধিতা করেছিলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর কিছুদিন পরই মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সেক্যুলার ভাবধারার রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে কংগ্রেস ছাড়া পূর্ব বাংলার কোনো দলে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। তাদের জন্য একটা সাধারণ উন্মুক্ত প্লাটফরম তৈরি হয়। সংখ্যালঘুরা ধীরে ধীরে এই দলটির ছায়াতলে সংগঠিত হতে থাকে। কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমে আসতে থাকে।
এখন সেই ভাষণের কথায় আসি। সেই ভাষণটি খণ্ডিতভাবে বিভিন্ন সময় পাকিস্তানের রেডিও টেলিভিশনে শোনানো বা দেখানো হতো। তবে এ ব্যাপারে আইয়ুব খান বেশ উদার ছিলেন। তার সময় পাঠ্যপুস্তকেও জিন্নাহ’র এ ভাষণ স্থান পায়। কিন্তু ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হক ক্ষমতায় আসার পর পাঠ্যপুস্তক থেকে সেই ভাষণ মুছে ফেলা হয়। রেডিও টিভির সংগ্রহশালায় সেই ভাষণের যে কপি ছিল তাও নষ্ট করা হয়।
২০০৮ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ক্ষমতায় এলে মুর্তুজা সোলাঙ্গি রেডিও মন্ত্রি হোন। তিনি সেই রেকর্ডের অনুসন্ধানে নামেন। তিনি জানতে পারেন রেকর্ডটির বেশির ভাগ অংশ জিয়াউল হকের আমলে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
মুর্তুজা খবর নিয়ে জানতে পারেন, সে সময় করাচিতে রেকর্ডের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দিল্লি থেকে লোক এসে সেই ভাষণ রেকর্ড করেছিল। ২০১১ সালে তিনি দিল্লি গিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র প্রধানের কাছে সেই ভাষণের রেকর্ড চান। তিনি তাকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করার অনুরোধ করেন।
দুই বছরেও ভারত সরকারের কাছে থেকে সাড়া না পেয়ে তিনি বিবিসি’র শরণাপন্ন হন। তারা জানায় তাদের কাছে ১১ আগস্টের ভাষণের কোনো রেকর্ড নেই। ২০১৩ সালে তিনি বাধ্য হয়ে ভারত সরকারের কাছে লিখিত অনুরোধ পাঠান। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার কিছু রেকর্ড পাঠায়। কিন্তু সে রেকর্ডগুলোর মধ্যে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্টের ভাষণটি ছিল না। এভাবেই স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্নের কথা হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতা থেকে। পাকিস্তান পেল পাঞ্জাবী চক্রের উদগ্র বাসনায় একটি বিকৃত রূপ।
সূত্র: দ্য ডন, বিবিসি, jinnah-institute.org এবং উল্লিখিত বই