১৯৭৪ সাল। চীনের জি’আন শহরের জিইয়াং অঞ্চলের একটি ক্ষেত। কৃষিকাজের জন্য কয়েকজন কৃষক পানি উত্তোলনের চেষ্টা করছেন। হঠাৎ করেই তারা আবিষ্কার করলেন, একটি নির্দিষ্ট জায়গা শক্ত মাটির আবরণে আবৃত। কৌতুহলবশত জায়গাটি কিছুটা খুঁড়ে তারা যা পেলেন, তা দেখে তো তাদের চক্ষু চড়কগাছ! অনেকগুলো মাটির তৈরী হাত-পা এবং ব্রোঞ্জের তৈরী তীরের ফলা। বিস্ময়ে একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগলেন জিইয়াং এর সেই কৃষকেরা।
পরবর্তীতে এই ঘটনাকে অনুসরণ করে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল সেই জায়গায় খননের কাজ শুরু করেন। খননের ফলে যা আবিষ্কার হয়, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। প্রায় আট হাজার মাটির তৈরী সৈন্যবাহিনী, শতাধিক মালগাড়ি, ১৩০টি রথ, ৬৭০টি ঘোড়া, টেরাকোটার তৈরী মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি, ব্রোঞ্জের তৈরী অজস্র অস্ত্র, প্রচুর স্বর্ণ এবং মূল্যবান পাথর সম্বলিত ৫৬ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এক বিশাল সমাধিস্থল। শুধু তা-ই নয়, সমাধিটির বিপুল সেনাবাহিনীর প্রতিটা মূর্তির চেহারা ভিন্ন এবং নির্দিষ্ট পদমর্যাদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পোশাক পরিধেয়। পুরো সমাধিটির মধ্যমণি হয়ে শুয়ে আছেন একজন সম্রাট, চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াংদি।
কিন শি হুয়াংদি ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। তিনি একই সাথে ইতিহাসের একজন নায়ক এবং একজন খলনায়ক হিসেবে পরিচিত। ধারণা করা হয়, তিনি মূলত লুই বুয়েই নামের একজন ব্যবসায়ীর সন্তান। প্রাচীন কিন রাজ্যের একজন রাজকুমারের সঙ্গে লুই বুয়েই এর বন্ধুত্ব হয় এবং তিনি নিজের সদ্য গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে রাজকুমারের বিয়ে দেন। পরবর্তীতে লুই বুয়েই এর স্ত্রী খ্রিস্টপূর্ব ২৫৯ সালে সন্তান জন্ম দেন এবং তার নাম রাখা হয় ইয়িং ঝেং। রাজকুমার বিশ্বাস করতেন, ইয়িং ঝেং তারই সন্তান। তাই একজন রাজবংশীয়ের মতোই লালিত-পালিত হতে থাকলেন শিশুটি।
খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে কিন রাজ্যের রাজা হন ইয়িং ঝেং। এই সময় পর্যন্ত ‘চীন’ নামের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। শুধু ছিলো ‘কিন’ সহ পরস্পরের সাথে যুদ্ধরত মোট সাতটি রাজ্য- ‘হান’, ‘ঝাও’, ‘ওয়েই’, ‘ইয়ান’, ‘চু’ এবং ‘কি’। সেটি ছিলো এক তিক্ত রক্তাক্ত সামরিক শত্রুতার যুগ, যা প্রায় দুই শতাব্দীরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিলো। সবগুলো রাজ্যের মধ্যে ‘কিন’-কেই মূলত সবচেয়ে নিকৃষ্ট রাজ্য মনে করা হতো। এর কারণ হলো কিনের কঠোরতম আইন ব্যবস্থা।
কিন রাজ্যে সামান্যতম অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান ছিলো। এমনকি কেউ কোনো অপরাধ সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও যদি তা সময়মতো রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হতো, তাহলে তাকে কোমর থেকে দুই ভাগ করে ফেলা হতো। তাই কিনের জনগণ আশ্চর্যজনকভাবে আইন-কানুন মেনে চলতেন।
রাজা ইয়িং ঝেং যখন শত্রু রাজ্যগুলো আক্রমণ করলেন, তখন কিনের নিয়ম-কানুনের তীব্রতা ও নৃশংসতার সামনে অন্য রাজ্যগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। খুব সহজেই ইয়িং ঝেং সবগুলো রাজ্য দখল করে ফেললেন এবং প্রথম বারের মতো বিশাল একটি একীভূত সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন তিনি। রাজা ইয়িং ঝেং থেকে তিনি হয়ে উঠলেন সম্রাট কিন শি হুয়াংদি। বর্তমান চীন তারই অবদান। শুধু তা-ই নয়, যাযাবর জিওংনু উপজাতির হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি নির্মাণ করেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর সৃষ্টি, চীনের মহাপ্রাচীর।
কিন শি হুয়াংদি একজন নিষ্ঠুর সম্রাট হিসেবেই পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। নতুন সাম্রাজ্যে তার প্রণীত কঠোর আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ৪৬০ জনেরও বেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে তিনি জীবিত কবর দিয়েছিলেন।
নিজের জন্য নির্মিত কিন শি হুয়াংদির বিশাল সমাধিস্থলের কথা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুর পরও তিনি জীবিতকালের মতো জীবনযাপন করতে আশাবাদী ছিলেন। তাই প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা করেই তিনি তৈরী করেছিলেন নিজের অভিনব সমাধিটি। বিশাল সংখ্যার বিভিন্ন পদস্থ মাটির তৈরী সেনাবাহিনী মূলত সম্রাট নিজের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই বানিয়েছিলেন, যা সে সময়ের শিল্পীদের চমৎকার মেধা সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করে।
মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য এতো অভিনব প্রস্তুতি থাকলেও সম্রাট কিন শি হুয়াংদির আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আর সেটি হলো, তার অমরত্ব লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অমরত্ব লাভের জন্য তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই চীনের ধনী পরিবারে পারদের পানীয় পানের প্রচলন ছিলো। কারণ পারদের বিষাক্ততা সম্পর্কে তখন তারা অবগত ছিলেন না। যে কোনো আচার-অনুষ্ঠানে, এমনকি কোনো উপলক্ষ ছাড়াও মাত্রাবিহীনভাবে পারদ পান করতেন চীনারা। আর এটিই ছিলো তাদের অতি অল্প বয়সে মারা যাওয়ার একমাত্র কারণ। সম্রাট কিন শি হুয়াংদিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। অমরত্ব লাভের জন্য অমৃত পানীয় হিসেবে তার আলকেমিস্টদের দেয়া পারদের তৈরী সব রকম পানীয় গ্রহণ করেছেন তিনি। দীর্ঘ দিন পারদের বড়িও খেয়েছেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, চিরজীবন লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় নিজের অজান্তেই বিষ পান করছেন তিনি। তাই এতো প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন চীনের প্রথম সম্রাট।
অমরত্বের জন্য বেপরোয়া সম্রাট কিন শি হুয়াংদির নিষ্ঠুরতার নমুনা নজিরবিহীন হলেও চীনের ইতিহাসে তার অবদান অপরিসীম। তার উত্তরাধিকারীদের জন্য ‘চীন’ নামের একটি শত্রুমুক্ত সুসংগঠিত রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন তিনি। পরস্পর যুদ্ধরত এতোগুলো অঞ্চলকে একতাবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল ‘এক’ জাতিতে পরিণত করবার মতো অসাধ্য সাধন করে গেছেন কিন শি হুয়াংদি, যা পৃথিবীর যে কোনো ভবিষ্যৎ শাসকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।
রেফারেন্স:
- Qin Shi Huangdi: The Man Who Gave His Name to China – The Collector
- ছিন শি হুয়াং – Wikipedia
- টেরাকোটা আর্মি: চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি’র কবরে – Roar Mediaদুই হাজার বছরের পুরনো সাম্রাজ্য
- কিন শি হুয়াং: চিরঞ্জীব থাকতে পারদের ‘অমৃত’ পানে মৃত্যুবরণকারী চীনের প্রথম সম্রাট – Ridmik News
- কিয়িন শিয়া হুয়াং এর জীবনী: চীনের প্রথম সম্রাট – Eferrit
- প্রাচীন চিনের সম্রাট শি হুয়াং তি – Some Where in Blog
- অমরত্ব লাভে আজব কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন চীনের প্রথম সম্রাট – Zoom Bangla