নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সবুজ ছায়াঘেরা একটি গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী নদী। সেই নদীর কাছেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটি কুটিরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন একজন প্রসূতি মা। পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় শুরু হওয়া মাত্রই চিৎকার করে কেঁদে নিজের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিলো সদ্য জন্ম নেয়া মেয়ে শিশুটি। তবে জন্মের মাত্র দুই বছর পরই দুর্ভাগা মেয়েটি বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে ফেললো। এর পর থেকে ছোট্ট শিশুটির দেখাশোনার ভার নিলেন তার মামা।
সোমেশ্বরী নদীতে সাঁতার কেটে কেটে, সবুজ মাঠ ও পাহাড়ের গায়ে খেলতে খেলতে একটু একটু করে বড় হতে লাগলো দুরন্ত সেই মেয়েটি। আর গ্রামের সরল পরিবেশে বড় হওয়া এই মেয়েটিই এক সময় একজন চরম বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। টংক আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আজীবন সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে থাকা সেই মেয়েটির নাম কুমুদিনী হাজং।
মাত্র ১১-১২ বছর বয়সে কুমুদিনীর বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সী লঙ্কেশ্বর হাজংয়ের সাথে। বাবার রেখে যাওয়া জমি লঙ্কেশ্বরকে বুঝিয়ে দিয়ে তাকে ঘরজামাই করে নেন কুমুদিনীর মামা।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চলে গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজংদের বসবাস। নিজেদের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলের হাজংরা জমিদার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
সে সময় জমিদাররা এই মানুষগুলোর উপর নানাভাবে অত্যাচার করতো। পরিশ্রমী মানুষের কষ্টকে পুঁজি করে বড় বড় শহরে বিরাট বিরাট প্রাসাদে আরাম এবং বৈভবের জীবনযাপন করেছেন তারা। শখের বশে ঝাড়বাতির নিচে নাচের আসর আর মদ নিয়ে চলেছে তাদের রাতভর আনন্দ ও হইচই। আয়েশী জীবন ও শখের পায়রা উড়াতে দুই হাতে খরচ করার জন্য এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ঘাড়ে তারা চাপিয়ে দিয়েছিলেন ঋণের বোঝা। আর ঐ দিকে খেটে খাওয়া মানুষগুলো দুই বেলা দুই মুঠো খেতে পারছে কি না, তার খবর রাখবার কেউ ছিলো না। অভাব-অনটনের কারণে তাদের বেঁচে থাকাটাই ছিলো কঠিন সংগ্রামের। এ কারণেই এক সময় তাদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠলো। এক এক করে তিনটি আন্দোলনের জন্ম হলো।
শুরু করছি হাতিখেদা আন্দোলনের গল্প নিয়ে। হাতিখেদা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো সুসং দুর্গাপুর। গারো পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ সমতলভূমি নিয়ে বিস্তৃত ছিলো সুসং দুর্গাপুর সামন্ত রাজ্যটি। পাহাড়ি অঞ্চল বলে চাষাবাদ তেমন একটা হতো না। চারিদিকে ছিলো অরণ্য ও বনজ সম্পদ। সুসং জমিদারদের আয়ের প্রধান উৎস ছিলো হাতি। তারা গারো পাহাড় থেকে হাতি ধরে এনে অন্যান্য জমিদারদের কাছে চড়া মুনাফায় বিক্রি করতেন। আর এই হাতিগুলো ধরার বা পোষ মানাবার জন্য নিয়ে আসা হতো হাজং আদিবাসীদেরকে।
হাজংরা এই কাজে অত্যন্ত সাহসী ও দক্ষ ছিলেন। তবে কাজটি খুব একটা সহজ ছিলো না। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় হাজংদের প্রাণও দিতে হতো। এই কাজের বিনিময়ে তাদেরকে পারিশ্রমিক না দিয়ে জমি চাষ করতে দেয়া হতো এবং সেই জমির উপর জমিদাররা কোনো কর নিতেন না। হাতি পালনকারীদেরকে কোনো পারিশ্রমিক দিতে হতো না বলে হাতি বিক্রির মাধ্যমে এই জমিদাররা অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ লাভবান হতে থাকলেন। তবে এই কঠিন কাজটি করতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে যে কোনো উপায়ে বাধ্য করা হতো এবং সেই সাথে তাকে অকথ্য নির্যাতনও করা হতো।
সময়ের সাথে সাথে এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের ‘গারো হিলস অ্যাক্ট’ প্রণীত হলো এবং এর ফলে জমিদারদের আয় কমে যাওয়াতে তারা হাজংদের কৃষি জমির উপরে কর দিতে বাধ্য করলেন। এই প্রস্তাবে হাজংরা অসম্মতি জানান। কারণ হাজংদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে খাজনামুক্ত জমি চাষের সুযোগ অর্জন করেছিলেন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে বেঁধে গেলো যুদ্ধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে জমিদাররাই জিতে গেলেন। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হলো টংক আন্দোলন।
ময়মনসিংহ জেলার উত্তর অঞ্চল সিলেটের সীমানা থেকে শুরু করে রংপুরের সীমান্ত পর্যন্ত গারো পাহাড়ের নিম্ন অঞ্চলগুলিকে বলা হতো শস্য ভান্ডার। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকই ছিলেন কৃষক। আর জমির মালিক ছিলেন জমিদারেরা। যদিও জমিগুলো কৃষকরাই চাষাবাদ করে ফসল ফলাতেন। জমিদাররা নিয়ম করলেন, ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট হারে খাজনা দিতেই হবে।
আবার প্রতি বছর এই নিয়মের মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসতেন চতুর জমিদাররা। যে কৃষক যতো বেশি খাজনা দিতে পারতেন, তাকেই বেশি জমি চাষ করার সুযোগ দেয়া হতো। এর নাম দেয়া হলো ‘টংক’ বা ‘ধানকাবারি’ খাজনা। টংক প্রথা উচ্ছেদ, জমির খাজনা স্বত্ব, জমির খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদসহ সমস্ত দাবি নিয়ে সুসং দুর্গাপুরের জমিদারের ভাগ্নে মণি সিংহ শুরু করলেন টংক আন্দোলন। মণি সিংহের সাথে একতাবদ্ধ হলেন কুমুদিনীর স্বামী ও তার ভাইয়েরা। এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ার জন্যই জমিদার ও ব্রিটিশদের প্রধান শত্রু হয়ে ওঠে কুমুদিনীর পরিবার।
প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ব্রিটিশরা ও জমিদাররা সকল হাজংদের উপর শুরু করলেন অমানবিক অত্যাচার। কিন্তু প্রধান শত্রু হিসেবে বেছে নিলেন লঙ্কেশ্বর ও তার ভাইদেরকেই। আক্রমণের আশঙ্কায় লঙ্কেশ্বররা তিন ভাই আগে থেকেই মণি সিংহের গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন। বাড়িতে ছিলেন শুধুমাত্র কুমুদিনী।
কুমুদিনী তখন সদ্য বিবাহিতা নববধূ। পুলিশ তার স্বামী ও দেবরদের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বোবার মত তাকিয়ে থাকলেন। কেননা তিনি তো জানেনই না তারা কোথায়। এতে পুলিশ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে কুমুদিনীকে ধরে নিয়ে বিরিশিরি সেনা ছাউনির দিকে রওনা হলেন। এই ঘটনার কথা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আশেপাশের সমস্ত নারী-পুরুষ কুমুদিনীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন। এদের মধ্যে মধ্যবয়স্ক নারী রাশিমনি হাজং, দিস্তা মনি হাজং ও বাসন্তী হাজংসহ বারো জন নারী জোর করে কুমুদিনীকে ছিনিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এতে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের উপর গুলি চালাতে শুরু করেন। সেই গুলিতে রাশিমনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ও শহীদ হন। রাশিমনিকে হত্যা করার জন্য ক্ষুব্ধ হাজং নারী-পুরুষেরা বল্লম ও রাম দা দিয়ে দুজন পুলিশকে কুপিয়ে হত্যা করেন। বাকি পুলিশেরা কোনো রকমে বেঁচে ফেরেন।
এই ঘটনার কিছু দিন পর রাশিমনির স্বামী পাঞ্জি স্ত্রীর শোকে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সেই থেকে টংক আন্দোলনে শহীদ হওয়া রাশিমনির নাম ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রইলো।
রাশিমনি শহীদ হবার পর কুমুদিনী হাজংকে গ্রামবাসীরা অজ্ঞান অবস্থায় মনি সিংহের গোপন আস্তানায় পাঠিয়ে দেন, যেখানে তার স্বামী ও দেবররা আগে থেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই টংক আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিলেন কুমুদিনী হাজং নিজেই। হাজংদের কঠোর আন্দোলনের ফলে জমিদারদের অন্যায় দাবিগুলো থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন ঐ অঞ্চলের মানুষেরা।
টংক আন্দোলন সফল হলেও কুমুদিনীদের ভাগ্য আজও পুরোপুরি পরিবর্তন হয় নি। সব কিছু হারিয়ে কুমুদিনী ও তার স্বামী লঙ্কেশ্বর বহেরাতলী গ্রামের ছোট এক কুঁড়েঘরে বসবাস শুরু করেন। তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে চলেছে কুমুদিনীর সংসার। ২০০২ সালে তার স্বামী লঙ্কেশ্বর মারা যান। এখনো বৃদ্ধ অবস্থায় রোগাক্রান্ত এক মর্মান্তিক জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন কুমুদিনী হাজং।