এক অনুভূতিশুন্য ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে বালুময় পথটিতে বসে আছেন লিডিয়ার রাজা পিথিয়াস। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন এই পথ দিয়েই ক্ষণিক আগে অতিক্রম করে যাওয়া দূরের পারস্য বাহিনীর দিকে। তার চোখ দুটো একই সাথে অনুভূতিহীন এবং রক্তলাল। তার চাহনি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, কি ভর করেছে সেই চোখ দুটোতে –হতাশা, দুঃখ, নাকি ক্রোধ! তিনি যেখানে বসে আছেন, ঠিক তার দুই পাশে তার বড় সন্তানের লাশ দু টুকরো করে দাফন করা হয়েছে। তার তো আজ হারাবার কিছুই নেই। বুকভরা আজ শুধু তার ঘৃণা, ঘৃণা নিজের সন্তান হত্যাকারীর প্রতি। তার নীরব নিথর হৃদয়ের শুধু এখন একটি মাত্রই চাওয়া, তার সন্তান হত্যাকারীর ধ্বংস। লিডিয়ার প্রাক্তন রাজার বড় ছেলের এই নির্মম হত্যাকারী আর কেউ নন, স্বয়ং পারস্যের রাজা শাহেন শাহ খাসাইয়ারসান। হ্যাঁ, আজ সেই নিষ্ঠুর, একরোখা ও উগ্র রাজার গল্পই বলতে যাচ্ছি, যাকে গ্রীকরা চেনে জারোক্সিস বা জার্জেস নামে।
খাসাইয়ারসান বা জার্জেস ছিলেন আকেমেনিড সাম্রাজ্যের চতুর্থ শাসক। ডেরিয়াস দ্য গ্রেট এবং আতোসার ছেলে ছিলেন তিনি। আতোসা ছিলেন মহামতি সাইরাস দ্য গ্রেট এর মেয়ে, যে কারণে ডেরিয়াসের বড় ছেলে থাকা সত্ত্বেও পারস্যের সিংহাসনে বসেছিলেন জার্জেস, কেননা তার শরীরে রাজরক্ত প্রবহমান। জার্জেস খ্রিস্টপূর্ব ৫১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৫ সাল পর্যন্ত পারস্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
আকেমেনিড সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্রবাদী ও নিষ্ঠুর রাজা হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন জার্জেস, অন্তত গ্রীক লেখাগুলো থেকে আমরা এমনটাই জেনেছি। পারস্য ও গ্রীস বহু প্রাচীনকাল থেকেই শত্রু ভূখণ্ড। তাই গ্রীসকে ধ্বংস করাই ছিলো জার্জেসের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য।
বদমেজাজি ও অত্যাচারী জার্জেস গ্রীকদের সাথে যুদ্ধ জয়ের জন্য যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। এমনকি সাইরাস দ্য গ্রেট থেকে শুরু করে ডেরিয়াস দ্য গ্রেট পর্যন্ত পারস্যের গড়ে ওঠা সব বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকেও তিনি জোরপূর্বক পারস্যের অধীনস্থ করেছিলেন, যেনো গ্রীকদের বিরুদ্ধে তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা বিশাল আকার ধারণ করে। তবে এতে হিতে বিপরীত হয়েছিলো।
হঠাৎ করেই বন্ধুরাষ্ট্র ব্যাবিলনকে জার্জেস পারস্যের অধীনস্থ বলে ঘোষণা করেন। এতে ব্যাবিলনে বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিদ্রোহ দমনের জন্য আরো কঠোর হন জার্জেস। তিনি ব্যাবিলনের প্রধান দেবতা মারদুকের স্বর্ণমূর্তি ধ্বংস করে দেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ব্যাবিলনের বিদ্রোহকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। তবে এই চরম বিদ্রোহও কঠোর জার্জেসকে এক বিন্দু দমাতে পারে নি। নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে জার্জেস অবশেষে এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সাথেও তিনি একই পন্থা অবলম্বন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলেন। দীর্ঘ দুই বছর যাবত সংঘটিত মিশরের বিদ্রোহও খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ সালে কঠোর হাতে দমন করেন জর্জেস।
ঠিক একই ভাবে লিডিয়ার বিখ্যাত রাজা ক্রোসাসের নাতি পিথিয়াসের পাঁচ জন ছেলেকেও জোরপূর্বক পারস্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করানো হয় জার্জেসের নির্দেশে। অথচ পিথিয়াস ঠিকই জানতেন যে, এই যুদ্ধে জার্জেস জয়ী হতে পারবেন না। সে সময় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিবেচনা করে প্রদানকৃত পুরোহিতদের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভীষণভাবে বিশ্বাস করা হতো। আর পুরোহিতরাও সে সময়কে পারস্যের যুদ্ধ জয়ের পক্ষে উপযুক্ত মনে করেন নি। তাই পিথিয়াস মরিয়া হয়ে জার্জেসের কাছে নিজের সন্তানদের জীবন ভিক্ষা চাইলে জার্জেস ক্রুদ্ধ হয়ে পিথিয়াসের বড় ছেলেকে কেটে দুই টুকরা করে পথের দুই ধারে দাফন করেন এবং সেই পথের মধ্য দিয়েই পারস্যের সেনাবাহিনী যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে গ্রীকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়।
প্রায় চার হাজার যুদ্ধজাহাজ এবং বিশ লক্ষ সৈন্য নিয়ে জার্জেস গ্রীকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রওয়ানা হন। সেনাবাহিনীর এই বিশাল সংখ্যা জার্জেসের নিজের ওপর প্রবল আত্মবিশ্বাস তৈরী করে। তা ছাড়া উগ্র স্বভাবের কারণে জার্জেস কখনোই স্থিরভাবে কিছু চিন্তা করতে পারতেন না। যে করেই হোক গ্রীসকে পদানত করবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-দাফন করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন।
মূলত গ্রীকদের বিরুদ্ধে তিনটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনার জন্যই পারস্যের রাজা জার্জেস ইতিহাসে সুপরিচিত হয়েছেন -থার্মোপাইলির যুদ্ধ, সালামির যুদ্ধ এবং প্লাতিয়ার যুদ্ধ। আর্তেমিসিয়াম ও থার্মোপাইলির খন্ডযুদ্ধ দুটোতে পারস্য বাহিনী বিশাল জয় লাভ করেছিলো, যার ফলে তারা এথেন্সে প্রবেশের সুযোগ পায়। জার্জেস এথেন্সের সব স্থাপনা ও বাসস্থান ধ্বংস করে দেন। এমন পরাজয়ে গ্রীকরা প্রথমে মুষড়ে পড়েছিলো। কিন্তু পারস্য বাহিনীতে একজন গ্রীক সেনাপতি ছিলেন, যার নাম দেমারাতাস। তিনি স্বজাতির এমন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ সইতে না পেরে একটি টেবিলে জার্জেসের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিষয়ে বিস্তারিত লিখে তা মোমের আবরণে আবৃত করে গ্রীক শিবিরে পাঠান। গ্রীক রাজা লিওনাইডাস এবং তার স্ত্রী গোগো এই গুপ্তপত্রের মর্মার্থ উদ্ধার করেন এবং গ্রীকরা আবারো নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। তারা নতুনভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা করে পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রস্তুত হতে থাকে।
লিওনাইডাসের নেতৃত্বে সালামির যুদ্ধে গ্রীক সেনারা এক দিক দিয়ে ইচ্ছে করে পিছু হটে পারস্য সেনাবাহিনীকে প্রতারিত করে এবং অন্য দিকে ভূমধ্যসাগরে নোঙর ফেলে রাখা হাজার হাজার পারস্য যুদ্ধজাহাজকে কোণঠাসা করে ফেলে। সালামির এই যুদ্ধে গ্রীকরা জয়লাভ করে এবং মাত্র কয়েক হাজার পার্সিয়ান সৈন্য প্রাণে বেঁচে যায়।
এমন শোচনীয় পরাজয় জার্জেস মানতে পারেন না। চাচাতো ভাই মারদোনিয়াসকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি পারস্যে ফিরে যান এবং পারস্য রাজের অনুপস্থিতিতে সংঘটিত প্লাতিয়ার শেষ যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসের অভাবেই শেষ পর্যন্ত পারস্য সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।
পরাজিত, হতাশ ও উন্মত্ত রাজার উদাসীনতা পারস্যের শাসন ব্যবস্থাকে উলোট-পালট করে দেয়। পারস্যের কেউই আর জার্জেসকে সিংহাসনে দেখতে চায় না। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী আর্তাবানুস জার্জেসকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করেন এবং তার ছেলে আর্তাজার্জেসকে পারস্যের সিংহাসনে বসান। এই ঘটনার মাধ্যমে পার্সিয়ান ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
রেফারেন্সঃ
- Xerxes I
- Xerxes The Great: The Powerful Persian King Whose Death Destroyed an Empire
- রাজা জারক্সিস: গ্রিক অভিসারে উন্মাদ এক রাজার ইতিকথা