১৮৯৮ সালে কলকাতা জুড়ে প্লেগের আতঙ্ক। প্লেগ ব্যাকটেরিয়াজনিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। ইঁদুর থেকে মানুষের দেহে প্লেগ জীবাণু প্রবেশ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগে মৃত্যু ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ রোগ প্রায় তিন হাজার বছরের পুরাতন। এই মহামারী রোগে অনেক দেশের তুলনায় ভারতে প্রাণহানি হয় বেশি। ১৮৯৬ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে প্রায় ৯৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল । চর্তুদশ শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। মূলত: চীনের বন্দরগুলো থেকেই এই রোগের উৎপত্তি হয়েছিল।
যাইহোক, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রয়েছে এই প্লেগ রোগের এক ট্রাজেডি সম্পর্ক। আজকে সেই গল্প এখানে তুলে ধরা হলো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার দাদা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ আর কাকা ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের প্রত্যেকেই শিক্ষা, সংগীত, শিল্প-সংস্কৃতির এক একজন দিকপাল। শুধু তাই নয়, সমাজের জন্য তারা প্রত্যেকেই বহু সেবামূলক কাজও করেছেন।
উনবিংশ শতকের শেষদিকে প্লেগ রোগে ভারত ও কলকাতার চারপাশে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারলো না। কাকা রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল চালু করলেন । কিন্তু, সারাদিন প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে, কখন যে মহামারী প্লেগের ভয়ঙ্কর থাবা আছড়ে পড়ল অবনীন্দ্রনাথের নিজের বাড়িতেই, তা তিনি টেরই পেলেন না। সেই প্লেগ রোগেই তাঁর ফুলের মতো ছোট্ট মেয়ের মৃত্যু হলো। মেয়ের মৃত্যুর এই ধাক্কা সহজে তিনি মেনে নিতে পারেননি। জোড়াসাঁকোর বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল। আর বাবা অবনীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন বড় একা।
বাড়ির চারদিকেই মেয়ের মুখের স্মৃতি, তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই, চলে গেলেন চৌরঙ্গীর একটি নতুন বাসায়। কিন্তু, বুকের ক্ষত কিছুতেই জুড়োচ্ছিল না। তখন আঁকতে বসলেন ছবি। জন্ম নিল বিখ্যাত সেই বেদনা-বিধুর ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটি। যেখানে এক মৃত্যুপথযাত্রীর মোঘল সম্রাটের করুণ চাহনি ফুটে উঠেছে। অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে এই ছবি আঁকলুম।’ ছবিটি ‘প্রবাসী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথের প্রথম ছবি। চিত্রটি দিল্লি দরবারের একটি চিত্র প্রদর্শনীতে রুপোর মেডেল জিতে ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে ছবির অদ্ভুত সব সম্পক রয়েছে অবনীন্দ্রনাথের জীবন জুড়ে।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে এলো আরেকটি মৃত্যুশোক। সবচেয়ে কাছের প্রিয় কাকা রবীন্দ্রনাথ চিরতরে চলে গেলেন। এই শোকে তিনি আঁকলেন আরেকটি বিখ্যাত চিত্র ‘রবিকাকা’-র শেষযাত্রার ছবি। সেখানে চিত্রে কবির মৃতদেহ অমৃতলোকে ছুটে চলেছে -তার অনন্য দৃশ্য ফুঁটে উঠেছে। এই ছবিটিও ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথ সেসময়ের আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে চিত্রকলার ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং আঁকা শেখেন। পরে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শেখেন। ভারতীয় রীতিতে তাঁর আঁকা প্রথম চিত্র ‘কৃষ্ণলীলা’। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে তাঁর দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে শিল্পী মহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি শিল্পচিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ করে গড়ে তোলেন ‘কুটুম কাটাম’ বিশিষ্ট এক বিমূর্ত ধারা। রবীন্দ্রনাথ ভাইপোকে খুব ভালবাসতেন এবং বলতেন, “অবন একটা পাগলা।” রবি ঠাকুর নিজের গোটা বইয়ের জন্য প্রথম ছবি আঁকার ভার দিয়েছিলেন তাকেই। অবনীন্দ্রনাথ এঁকে দিলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্যের জন্য বত্রিশটি স্কেচ। এটিই রবীন্দ্রনাথের বইয়ের প্রথম ইলাস্ট্রেটর। পেলগ মহামারী ছাড়াও সামাজিক নানা উদ্যোগে কাকার সঙ্গে বারবার জড়িয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ। আর, তিনি নানা আঘাতে, মৃত্যুতে বারবার আশ্রয় খুঁজতেন ছবির কাছে। ছবি আর শোক তাঁর জীবন যেন একাকার, কিন্তু সেসব সৃষ্টিশীল চিত্রগুলি ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে ।