খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সাল। ভারতবর্ষের ছোট্ট একটি গ্রামে ক্ষেতের আইলে বসে বাঁশিতে সুর তুলেছে কিশোরী মেয়ে সায়েবা। সুরটা যেনো এখানকার মতো নয়। পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে সেই সুর শুনে চলেছে সায়েবার বন্ধু ধনু। ধনু এই গ্রামেরই ছেলে। তবে সায়েবারা এই গ্রামে এসেছে মাত্র এক বছর আগে। সায়েবাকে দেখে খুব অবাক হয় ধনু। মেয়েটার চেহারা এতো মায়াবী! প্রশস্ত কপাল, নিচের দিকে সূচালো মুখমন্ডল, চোখা নাক এবং ধবধবে গায়ের রং দেখে মুগ্ধ হয় কাজল। এমনটা তো এখানে কারোরই নেই। এমনকি মেয়েটার কথা বলার ধরন এবং মুখভঙ্গিও অন্য রকম। সায়েবা বাঁশি থামিয়ে হঠাৎ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ধনু দেখেছে, সে প্রায়ই এমন করে। তার চোখ দুটো ভীষণ বিষণ্ণ। ধনু সায়েবার কাছে জানতে চায় যে, সে কোথা থেকে এসেছে। প্রতিদিনের মতো সায়েবা একটু হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, দুপুর হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরতে হবে। হঠাৎ ধনু অনুনয় করতে শুরু করে, তাকে বলতেই হবে সে কোথা থেকে এসেছে। সায়েবা ইতস্তত করে। তার ধারণা, ধনু তার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ধনুর জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত নিজের পরিচয় বলতে বাধ্য হয় সায়েবা। ধনুকে জানায় যে, পারস্যের রাজকন্যা সে, তৃতীয় ডেরিয়াসের বংশধর। ধনুকে সে আরো জানায়, বিখ্যাত গ্রীক যোদ্ধা আলেকজান্ডার তাদের রাজ্য দখল করে নিয়েছে বলেই ভারতবর্ষে পালিয়ে এসেছে সে ও তার ভাই-বোনেরা। সায়েবা বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে দেয়, আর তার যাবার পথের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে ধনু।
সায়েবার এই গল্পটি হয়তো শুধুই গল্পমাত্র, চরিত্রগুলোও কাল্পনিক, কিন্তু সত্যিই কি এমন ঘটনার অস্তিত্ব নেই? আছে। অবশ্যই আছে। আলেকজান্ডারের পারস্য অভিযানের পর সত্যি সত্যি অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলো ভারতবর্ষে, আর এর মাঝে পারস্যের রাজকন্যা-রাজপুত্ররাও ছিলো। তারা কেউ কিন্তু আর নিজ ভূমিতে ফিরতে পারে নি, স্থায়ী হয়েছে এই ভারতবর্ষেই। আর সেই সাথে ভারতবর্ষ পেয়েছে ভিন্ন কিছু সংস্কৃতি, ভিন্ন কিছু অভ্যাস, ভিন্ন কিছু শিল্প। হ্যাঁ, ভারতবর্ষের মানুষ আনমনেই আস্তে আস্তে আত্মস্থ করেছে পারস্যের সবকিছুকে, আর সেই গ্রহণ করবার প্রভাব আজও আমরা নিজেদের মধ্যে স্পষ্ট দেখতে পাই।
ভারতবর্ষের ওপর পারস্যের প্রভাব নতুন কিছু নয়। পারস্যের প্রাচীনতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট সাইরাসের সময়েও ছিলো এই যোগাযোগ। সাইরাসের দরবারে সবসময় ভারতবর্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতো। এমনকি সাইরাসেরও আগে যখন পারস্যের শাসক ছিলো মেডেস গোত্রের ব্যক্তিরা, তখনও ভারতবর্ষের সাথে পারস্যের ছিলো গভীর যোগাযোগ। বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষ ও পারস্যের মধ্যকার যাতায়াত সহজ করবার জন্য বিদ্যমান ছিলো বিশেষ পথ। সুতরাং ভারতবর্ষ আর পারস্যের সম্পর্ক যে বেশ প্রাচীন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মৌর্য সম্রাট অশোকের সকল কর্মকান্ডের মধ্যেও স্পষ্ট রয়েছে পার্সিয়ান ছাপ। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, অশোকস্তম্ভগুলোও ছিলো পার্সিয়ান স্তম্ভগুলোর মতোই। এমনকি সেই সময়ের ভবন ও বাড়ি-ঘরগুলোও নির্মাণ করা হয়েছিলো পার্সিয়ান স্টাইলে। মৌর্য যুগে ভারতবর্ষে পার্সিয়ান স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার ছিলো এবং পরবর্তীতে ভারতবর্ষে মুদ্রার ব্যবহারটা পার্সিয়ানদের অনুকরণেই চালু হয়। তখন ভারতবর্ষে সেই মুদ্রার নাম রাখা হয়েছিলো কারসা।
ভারতবর্ষের পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদিতে উল্লেখ করা হয়েছে পারস্যের প্রাচীন পহ্লবদের কথা। তাছাড়া ভারতবর্ষের পোশাকেও রয়েছে পার্সিয়ান ছাপ। ভারতবর্ষের উন্নততর চিকিৎসা জ্ঞানও অনেকাংশে পারস্যের অবদান। শাহপুর শাসনের সময় খুজিস্তানের জনদিশপুর হাসপাতালে বহু ভারতীয় ব্যক্তি চিকিৎসাবিদ্যা রপ্ত করেছিলেন এবং এ কারণেই ভারতবর্ষের চিকিৎসাক্ষেত্রে, বিশেষ করে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে পারস্যের প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
শুধু তা-ই নয়, পারস্যের জোরোস্ট্রিয়ান ধর্ম থেকেও অনেক রীতি-নীতি চলে এসেছে ভারতবর্ষে। হিন্দুদের অগ্নিপূজার ধারণা কিন্তু এখান থেকেই এসেছে। তাছাড়া জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার আহুরা মাজদা নামের উপাস্যের ধারণাই ঋগ্বেদে অসুর মহাৎ এর রূপ লাভ করেছে। হিন্দু ধর্ম বাদেও অন্য অনেক একেশ্বরবাদী ধর্মের ভিত্তি এই জোরোস্ট্রিয়ান ধর্ম। হিন্দুদের বিয়েতে আগুনকে কেন্দ্র করে সাত পাক ঘোরার যে ব্যাপারটা, সেটাও এসেছে জোরোস্ট্রিয়ানদের কাছ থেকে।
বৌদ্ধ ধর্মে জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মের প্রভাবটা খুব বেশি লক্ষণীয়। বৌদ্ধ ধর্মের অধিকাংশ বিশ্বাস জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মেরই অনুরূপ। তাছাড়া বুদ্ধের অবয়ব তৈরীও জোরোস্ট্রিয়ান ধর্ম থেকেই অনুপ্রাণিত।
আকেমেনিড যুগে তো ভারতবর্ষের অসংখ্য অঞ্চল পারস্যের নিয়ন্ত্রণেই চলে গিয়েছিলো। সুতরাং নিঃসন্দেহে সেটি ছিলো ভারতবর্ষের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক সম্পর্ক গভীর হওয়ার স্বর্ণযুগ। সাইরাসের পরে সম্রাট ডেরিয়াসের সময়ে পারস্য সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছিলো। সত্রপ বা ক্ষত্রপের ধারণাও ভারতবর্ষে এসেছে আকেমেনিড সাম্রাজ্য থেকে। প্রাচীন সেই সময়ে প্রাদেশিক গভর্নরকে ক্ষত্রপ বলা হতো, যেটা পরবর্তীতে ভারতবর্ষেও প্রচলিত ছিলো। তৃতীয় ডেরিয়াসের সাথে আলেকজান্ডারের যুদ্ধের সময়েও ডেরিয়াসের সেনাবাহিনীতে বহু ভারতীয় সৈন্য ছিল। ভারতীয় হাতিবাহিনীও ডেরিয়াসের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলো সে সময়।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে পারস্যের লোকেরা এই ভূখন্ডে এসে স্থায়ী হয়েছিলো। কখনো আলেকজান্ডারের বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে, কিংবা কখনো পারস্যে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশকালে। তবে মজার ব্যাপার হলো, পারস্যে মুসলমান যুগ শুরু হবার পর থেকে ভারতবর্ষে পারস্যের প্রভাব আরো প্রকট হয়েছে। ভারতবর্ষের অসংখ্য স্থাপনায় পারস্যের ছাপ পড়েছে দারুণভাবে। তাজমহল থেকে শুরু করে লালবাগ কেল্লা পর্যন্ত যতো মুঘল স্থাপনা আছে, প্রত্যেকটিতে পার্সিয়ান ছাপ স্পষ্ট। কেননা মুঘল সম্রাটেরা পারস্য সংস্কৃতিতে ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। হয়তো পারস্যের সাথে তারা এতোটা জড়িয়ে না থাকলে চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো এতো চমৎকার স্থাপনাগুলো এই ভূখন্ডে কখনোই গড়ে উঠতো না। শুধু স্থাপনাই নয়, মুঘল চিত্রশিল্প, সংস্কৃতি, পোশাক, ভাষা সমস্তই পারস্যের অবদান।
ভারতীয় মরমি ধারণা থেকে পারস্যে জন্ম নেয়া সূফিবাদ আবারো ভারতবর্ষেই ফিরে এসেছে বহুগুণ জনপ্রিয়তা নিয়ে। এই সূফিবাদই ভারত ও পারস্যের সংমিশ্রণের এক অন্যতম নিদর্শন হয়ে বিরাজ করেছে বহু কাল। মুসলমান যুগে ভারতবর্ষের রাজভাষার মর্যাদা পায় ফারসি। এই ভারতবর্ষেই অসংখ্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচিত হয়েছে ফারসি ভাষায় এবং আস্তে আস্তে এই ভূখন্ডের সবাই নিজেদের অজান্তেই আপন করে নিয়েছে বহু ফারসি শব্দকে। বাংলা, হিন্দি, তামিল, গুজরাটি, উর্দু -ভারতবর্ষের এমন কোনো ভাষা নেই যার মাঝে ফারসি শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ভারতীয় খাবার ও রন্ধন প্রক্রিয়ায় পার্সিয়ান প্রভাবের কথা তো না বললেই নয়। আমাদের সবার প্রিয় মুখরোচক খাবার বিরিয়ানি কিন্তু পারস্য থেকেই ভারতবর্ষে এসেছে মুঘলদের মাধ্যমে। বিরিয়ানি ছাড়াও আরো অনেক অনেক মুখরোচক পার্সিয়ান খাবার রাতারাতি ভোজনরসিক ভারতীয়দের নিত্যদিনের খাবার তালিকায় যুক্ত হয়ে গেছে অবচেতনভাবেই।
যেমনটা পার্সিয়ানরাও রপ্ত করেছে সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পাবাসীর জীবনাচার, তেমনটা করেছে ভারতবর্ষও। ভারতবর্ষ যুগে যুগে পারস্যের সাথে হয়েছে মিলেমিশে একাকার। আর এই সংমিশ্রণ আমাদের জীবনকে পদে পদে করে চলেছে সমৃদ্ধ ও অনন্য।