ইরাকের প্রাচীনতম শহর ব্যবিলনে শত্রুসেনারা হামলে পড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ব্যবিলনকে লুন্ঠন ও দখল করে নেয়া। পুরো শহর আতঙ্কে স্থবির হয়ে পড়েছে। ঠিক এমন সময় বিশাল পাখা ঝাপটে উড়ে এলো এক অদ্ভূত-দর্শন জীব, যার চেহারা অবিকল মানুষের মতো, আর শরীর ষাঁড়ের মতো। যেনো দেবী ইশতারের মন্দিরের প্রধান ফটকের ভাস্কর্যটিই জীবিত হয়ে উঠেছে! নিজের শক্তিশালী ডানা ঝাপটে ঝড়ের মতো বাতাস তৈরী করলো সেটি, আর সেই প্রচন্ড বাতাসের আঘাতে শত্রুসেনার দল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। শক্তিশালী থাবার আক্রমণে তাদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো জীবটি। যেনো স্বয়ং দেবতা ধরণীতে নেমে এসেছেন নিজের মানুষগুলোকে রক্ষা করবার জন্য! শুধু ফটকের পাহারাদার হিসেবে নয়, অদ্ভূত সেই জীবটি আবির্ভূত হলো সম্পূর্ণ শহরের পাহারাদার হিসেবে। তখন থেকে ব্যবিলনীয়রা দেবী ইশতারের পাশাপাশি তাকেও পূজা করতে লাগলো। পরম শ্রদ্ধায় তার নাম দেয়া হলো ‘লামাসু’, যার অর্থ ‘প্রতিরক্ষার দূত’।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে লামাসু © Wikimedia

মেসোপোটেমিয়াকে সভ্যতার আতুরঘর বলা হয়। অনেক প্রথমের জন্ম দিয়েছে এই সভ্যতা। প্রথম কৃষিকাজ, প্রথম লেখনী, প্রথম প্রাসাদ, প্রথম নগর রাষ্ট্র ইত্যাদি সব প্রথমেরই কৃতিত্ব তাদের।

উত্তর ইরাকের খোর্সাবাদ নগরী, যেটি ‘দুর-শাররুক্বীন’ নামে অ্যাসিরীয় সম্রাট দ্বিতীয় সারগনের নগর দুর্গ ছিলো। নগরীর প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে লাইমস্টোনের দুটো মূর্তি। মূর্তি দুটি লামাসু। তার বিশাল শরীরটি সিংহের মতো দেখতে। নিখুঁতভাবে কাজ করা দুটি ঈগলের পাখা বাঁকা হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মাথার অংশটিতে মানুষের মতো কোঁকড়ানো দাড়ি ও মোছ। পাগড়িটিতে কাপড়ের ভাঁজ স্পষ্ট দৃশ্যমান। কোঁকড়ানো চুল, জোড়া ভ্রু, কানে নকশা করা অলংকার মুহূর্তের জন্য নিয়ে যায় এক কল্পনার জগতে! তাদের মাথার মুকুটের ধরনে রয়েছে দেবত্বের পরিচয়। নিশ্চয়ই বিশাল পরাক্রমশালী কোনো দেবতা এবং এক অদ্ভূত অতিপ্রাকৃতিক শক্তির পরিচায়ক এই মূর্তিগুলো। বিশ্বাস অনুযায়ী, অবশ্যই তাদের শক্তি ষাঁড়ের মতো অসীম, দুটো পাখা দিয়ে পাখির মতো উড়ে যাবার ক্ষমতা ছিলো তাদের এবং মানুষের মতো মাথা হবার কারণে তারা ছিলো অসীম বুদ্ধির অধিকারী।

দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবার দৃঢ় সংকল্প দেখা যায় তাদের অপলক চাহনিতে। আলাবাস্টার বা তৈলস্ফটিক নামের স্বচ্ছ এক ধরনের খনিজ পদার্থে তৈরী প্রায় ১০ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বিশাল এই মূর্তিগুলো দেখলে যে কারো চোখ ছানাবড়া হতে বাধ্য। এই বিশাল মুর্তিগুলোকেই যখন প্রাসাদের প্রাচীরের কাছে রাখা হতো, তখন তাদের আকার হয়ে যেতো ছোট লিলিপুটের মতো, যা থেকে মেসোপটেমিয়ার রাজপ্রাসাদগুলোর প্রাচীরের বিশাল উচ্চতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা লাভ করা যায়।

লামাসু: এক জাদুকরী জীবের ভাস্কর্য

বাগদাদের ইরাক মিউজিয়ামে লামাসু © Wikimedia

মেসোপোটেমিয়া একটি শুষ্ক দেশ। এখানে কাঠ ও পাথর পাওয়া ছিলো দুষ্কর। তাই এর প্রতিকার হিসেবে স্থাপত্যের নকশার কাজে খিলান ব্যবহার করতেন মেসোপটেমীয়রা। প্রাচীরবেষ্টিত শহরে প্রবেশের দরজা তৈরীর জন্য মোটাসোটা চারকোণা পিলার বানিয়ে সেটিতে দরজা লাগিয়ে দেয়া হতো। আর বিশাল সেই খিলানের ভার ধরে রাখার জন্য মনোলিথিক পাথরে তৈরী লামাসুদেরকে রেখে দেয়া হতো।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সমস্ত অপশক্তি বা অশুভ শক্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে প্রাসাদ ও সিংহাসনকে বিপদমুক্ত রাখবার জন্য সদা জাগ্রত থাকেন লামাসুরা। গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে আজও অভিভাবক হিসেবে অটল ও অবিচল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন সেনাবাহিনীর শক্তি, অনুপ্রেরণা ও সাহস প্রদানকারী লামাসু মূর্তিগুলো।

শুধু রাজপ্রাঙ্গণেই নয়, মেসোপটেমিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনেও স্বর্গীয় দেবতার মর্যাদা পেতেন লামাসুরা। নিজেদের জীবনে লামাসুর উপস্থিতিকে নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করতেন তারা। নিরাপত্তা লাভের জন্য লামাসুর চিত্র খোদাই করা মাটির ট্যাবলেট বাড়ির চৌকাঠের নিচে পুঁতে রাখা হতো। বলাই বাহুল্য, মেসোপটেমীয় সংস্কৃতিতে লামাসু ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাচীন ইহুদিরা লামাসুকে চমৎকার এক সত্তা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। খ্রিস্টানদের গসপেলেও এই পৌরাণিক চরিত্রকে বেশ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গিলগামেশের মহাকাব্যেও প্রতিরক্ষার দেবতা হিসেবে এর উপস্থিতি রয়েছে।

১৮৪৩ সালের শুরুতে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ পল এমিল বোত্তা কিছুসংখ্যক লামাসু মূর্তিকে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেন। বিশাল আকৃতির পৌরাণিক প্রাণীটিকে প্রথমবার দেখে একেবারে হতবিহ্বল হয়ে যান ফ্রেঞ্চ জনগণ। বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ জাদুঘর, নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট এবং শিকাগোর ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটেও রাখা হয়েছে লামাসু মূর্তিগুলো।

সমগ্র মেসোপোটেমিয়ায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২০টি লামাসু ভাস্কর্য মিলেছে। বর্তমান সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য অঙ্গনেও এই মূর্তি বেশ জনপ্রিয়। ‘দ্য ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া’ এবং ডিজনী চলচ্চিত্র ‘আলাদিন’ -এও এই পৌরাণিক চরিত্রটির দেখা মিলেছে।

লামাসু: এক জাদুকরী জীবের ভাস্কর্য

পার্সেপোলিসে লামাসু © Wikimedia

দ্বিতীয় অসুরনাসিরপালের সময়ে তৈরী সর্বপ্রাচীন লামাসুটি সিংহের আকৃতিতে তৈরী হলেও দ্বিতীয় সারগনের প্রাসাদের লামাসুটি ষাঁড়ের দেহসম্বলিত। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় সারগনের প্রাসাদ রক্ষাকারী লামাসুরা মুখে হাসির ঝলক নিয়ে রাজ্য পাহারায় রত।

ইরাকের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা লামাসুদেরকে তো জ্ঞানী-গুণীজনেরা সরিয়ে পাশ্চাত্যের জাদুঘরগুলোতে পাঠিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এই অপসারণের পর ইরাকের এমন দুর্দশা কেনো হলো? তবে কি সত্যিই কোনো জাদুকরী শক্তিবলে মূর্তিগুলো যুগের পর যুগ রক্ষা করে গেছে ইরাক তথা সমগ্র মেসোপটেমিয়াকে? পাশ্চাত্যের মিউজিয়ামের পাহারায় তারা নিযুক্ত হয়েছে বলেই কি তবে ইরাক আজ আক্রান্ত?

 

 

রেফারেন্স: