খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ২০০ বছর আগের কথা। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছেন এক ব্যক্তি। কোথায় যাচ্ছেন কিছুই জানেন না তিনি, অবশ্য আপাতত জানবার প্রয়োজনও অনুভব করছেন না। এই মুহূর্তে এখান থেকে যতো দূরে যাওয়া যায় ততোই তিনি বিপদমুক্ত। অনেক দিন বন্দী অবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছে তাকে। আজ সুযোগ বুঝে পালিয়ে এসেছেন। তাই প্রাণপণে দৌড়ে চলেছেন যতো দূর যাওয়া যায়। ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একটি জায়গায় এসে থামলেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য। সামনে তার ধূ ধূ মরুভূমি। একটু আশাহত হলেন তিনি। ভাবলেন হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছেন, কারণ আসার সময় তো এই পথ দিয়ে তিনি আসেন নি। বিশ্রাম তার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এই অবস্থায় মরুভূমি পাড়ি দিতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি মরুভূমি পাড়ি দেয়ার বদলে পাহাড়ের গা ঘেঁষে হেঁটে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর দূর থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ভেসে আসলো কানে। একই সাথে ভয় ও আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। ঐ তো, দুজন লোককে দেখা যাচ্ছে, দুটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এ পথ দিয়েই যাচ্ছেন। তাকে দেখে থেমে গেলেন ঘোড়সওয়াররা। ঘোড়া দুটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি। এমন সুন্দর ও সুঠাম ঘোড়া তিনি আগে কখনো দেখেন নি। এবার ঘোড়সওয়ার দুজনের দিকে তাকালেন। তাদের চেহারার গঠন, দেহাবয়ব, ভাষা সমস্তই অচেনা তার কাছে। তার অবস্থা দেখে ঘোড়সওয়ার দুজন তাকে নিজেদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলে তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। তাদের সাথে তিনি একটি লোকালয়ে পৌঁছালেন। সেখানকার মানুষদের জীবনধারা ও দক্ষতা তাকে মুগ্ধ করলো। এরপর নিজের ভূমিতে ফেরার পথে মধ্য এশিয়ার আরও অনেক জায়গা ঘুরলেন তিনি। অনেক নতুন নতুন জাতি ও তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় হলো তার। সেই সাথে এ-ও বুঝতে পারলেন, এই জায়গাগুলোতে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা। শুরুটা খারাপ হলেও অবশেষে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো চীনের হান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিবিদ ঝাং-কিয়ানের যাত্রা।
প্রান্তে ভাঁজযুক্ত ছোট চোখ ও চ্যাপ্টা নাকবিশিষ্ট মঙ্গোলীয় যাযাবরদের পূর্বপুরুষ ‘জিওংনু’ উপজাতিরা যখন চীনের পশ্চিম অংশের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ করেই যাচ্ছে, তখন তাদের সাথে আপোস করবার জন্য ঝাং-কিয়ানকে পাঠিয়েছিলেন হান সম্রাট য়ূ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তারা ঝাং-কিয়ানের সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে রাজি তো হয়-ই নি, বরং তাকে বন্দী বানিয়ে রাখা হয় দীর্ঘদিন। একদিন কোনোভাবে ঝাং-কিয়ান জিওংনুদের আস্তানা থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ জায়গা ঘুরে অবশেষে চীনে ফিরে যান। তবে চীনে ফেরার পথে তিনি এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতির দেখা পেয়েছেন ও এতো কিছু শিখেছেন যে, সেগুলোকে তিনি নিজের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখতেন। প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের জীবনযাত্রাকে সহজ করবার জন্য মানুষ নদীর তীরে বসতি গড়ে তুলেছে। এমন অনেক জাতিগোষ্ঠীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ঝাং-কিয়ান। তাদের সংস্কৃতিচর্চা, জীবনধারণকৌশলও আয়ত্ত করেছেন তিনি। তিনি যেসব পথ আবিষ্কার করেছেন সেগুলো যে ব্যবসার জন্য কতোটা উপযোগী, তা কোনো প্রশ্নের দাবী রাখে না। পর্যাপ্ত পানি, খাবার, কৌতুহলী ক্রেতা সবই পেয়েছেন তিনি সেখানে। দেখেছেন সিথিয়ান ও ব্যাক্ট্রিয়ান জনগোষ্ঠীর সুগঠিত ঘোড়াসহ আরও বহু অদেখা পণ্যের সমাহার। পরসংস্কৃতিকে জানার ও ধারণ করার ইচ্ছা তখন প্রায় প্রতিটা জাতির মাঝেই কম-বেশি ছিলো। গল্পে শোনা আতঙ্কের জগৎ থেকে সামান্য সাহস সঞ্চয় করে আর কৌতুহলকে পুঁজি করে যে-ই বাইরে বেরিয়েছে, সে-ই আবিষ্কার করেছে নতুনত্বকে। ঝাং-কিয়ানের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প শুনে হান সম্রাট অভিভূত হয়েছিলেন। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সম্রাট, বাণিজ্য করবেন তিনি এই পথেই।
ঝাং-কিয়ানের আবিষ্কৃত এই বাণিজ্য পথটিকে ১৮৭৭ সালে জার্মান ভূতত্ত্ববিদ ফার্ডিন্যান্ড ভন রিথোফেন ‘সিল্ক রুট’ নাম দিয়েছিলেন, যেটি ‘সিল্ক রোড’ নামেও পরিচিত। নাম শুনে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে যে, জায়গাটির সাথে ‘সিল্ক’ বা ‘রেশম’ এর কোনো একটি যোগসূত্র রয়েছে। আসলে সিল্ক রোডের যাত্রা তো শুরু হয় আরো অনেক প্রাচীনকাল থেকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন তৃতীয় পারস্য সম্রাট প্রথম দারিয়ুস। তার হাত ধরেই গড়ে উঠেছিলো বিখ্যাত বাণিজ্য পথ ‘রয়্যাল রোড’, যা ছিলো ইরান থেকে শুরু করে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি ‘সিল্ক রোড’ বিকশিত হওয়ারও প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। মূলত এই ‘রয়্যাল রোড’-ই ছিলো ‘সিল্ক রোড’ এর প্রধান সংযোগ। এক পর্যায়ে ‘রয়্যাল রোড’ তার সাথে আরও অসংখ্য ছোট ছোট বাণিজ্য পথকে যুক্ত করে। পরবর্তীতে আলেকজান্ডারও মেসিডোনিয়া থেকে পারস্য জয় করে এই পথ ধরেই এগোতে এগোতে এক সময় ভারতবর্ষের হিন্দুকুশে এসে পৌঁছান। ফলে তার এই দিগ্বীজয় ‘রয়্যাল রোড’-কে আরো প্রশস্ত করে তোলে। অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ সালে হান সাম্রাজ্যের উদ্যোগে নতুন আঙ্গিকে শুরু হয় ‘সিল্ক রোড’ এর যাত্রা। তখন ‘সিল্ক’ বা ‘রেশম’ ছিলো চীনের একটি গোপনীয় সিগনেচার পণ্য। চীন রেশমের প্রস্তুত প্রণালী গোপন রাখার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকতো। একে তো এটি ছিলো ভীষণ আকর্ষণীয় এবং আরামদায়ক, তার উপর চীন বাদে কেউই এই পণ্যের উৎপাদনে সক্ষম ছিলো না। এ জন্য চীন তখন শুধুমাত্র এই ‘সিল্ক’ এর মাধ্যমেই একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করে গেছে। ইউরোপীয় ও মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীরা সোনা, আইভরি, পশম, কাঁচ, ঘোড়া ইত্যাদির বিনিময়ে চীন থেকে সিল্ক বা রেশম কিনে নিয়ে যেতো। সিথিয়ান ও ব্যাক্ট্রিয়ানদের সুঠাম, তেজী ঘোড়াগুলোকে আক্রমণকারী উপজাতি দস্যুদের বিরুদ্ধে চীন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। সেই ঘোড়াগুলোকে বলা হতো ‘ফেরঘানা ঘোড়া’। ফেরঘানা ঘোড়া এতোটাই আকর্ষণীয় ছিলো যে সেগুলোকে অনেকে ‘স্বর্গীয় ঘোড়া’ বলে থাকতো। সিল্ক বা রেশমের রমরমা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই মূলত ঝাং-কিয়ানের আবিষ্কৃত এই বাণিজ্য পথ নতুন এক মাত্রা পেয়েছিলো। আর তাই এই পথের নামকরণে ‘সিল্ক’ শব্দটির ব্যবহার এড়াতে পারেন নি রিথোফেন।
রেশমের প্রস্তুত প্রণালী দীর্ঘদিন গোপন রেখে চীন সফলভাবে লাভজনক ব্যবসা করে যাচ্ছিলো ঠিকই। কিন্তু বেশি দিন তা সম্ভব হয় নি। রেশমের অত্যাধিক দাম নিয়ে চীনের সাথে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের মনোমালিন্য তৈরী হয় এবং এরই ফলশ্রুতিতে ৫৫১ সালে দুজন খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক কৌশলে চীনে গিয়ে দেখে আসেন কিভাবে রেশম পোকা থেকে সিল্ক তৈরী হয়। এটি ছিলো বাইরের বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়। কারণ রোমানসহ অনেকেরই ধারণা ছিলো যে, সিল্ক কোনো ফল থেকে উৎপাদিত হয়। নাম না জানা সেই দুজন ধর্মযাজক বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানকে এই খবর জানালে সম্রাট তাদেরকে গোপনে রেশম পোকার লার্ভা নিয়ে আসার আদেশ দেন। তাই তারা আবারো চীনে যান এবং গোপনে বেতের লাঠির ভেতর রেশম পোকার লার্ভা নিয়ে কন্সট্যান্টিনোপোলে ফিরে আসেন। সেই থেকে চীনের বাইরেও রেশম পোকার চাষ শুরু হয়। সিল্ক রোডের ব্যবহারের মাধ্যমে চীনের বাণিজ্যকে দমিয়ে রাখা তবুও সহজ ছিলো না। এর কারণ চীনের কাগজ আর বারুদ। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিও চীনই প্রথম শুরু করেছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে কাগজ আবিষ্কার করেছিলো চীন এবং ৭০০ সালের দিকে সিল্ক রোডের মাধ্যমে প্রথম এটি চীন থেকে সমরকান্দে এসে পৌঁছায়। কাগজের পাশাপাশি বারুদও সিল্ক রোডের মাধ্যমেই পৌঁছে যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে, যার ব্যবহার যে কোনো মুহূর্তে বদলে দিতে পারতো যুদ্ধের ফলাফলকে। এক সময় এই কাগজ আর বারুদের ব্যবহার পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে বদলে যায় পৃথিবীর সম্পূর্ণ ব্যবস্থা।
সিল্ক রোডের ইতিহাস থেকে এটা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে যে, এটি কোনো একক পথ ছিলো না। অসংখ্য শিরা-উপশিরা নিয়ে বিস্তৃত হয়েছে এই সিল্ক রোড। আমরা বর্তমানে খুব সহজেই পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যোগাযোগ করতে পারছি। এই নেটওয়ার্কিং কিন্তু এক দিনে গড়ে ওঠে নি, এর ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং নেটওয়ার্কিং এর প্রাচীন ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে গেলে সিল্ক রোডকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থানে রাখতেই হবে। চীন, মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও ইউরোপীয় বাণিজ্যিক স্থলপথের সমষ্টি হলো এই সিল্ক রোড। সিল্ক রোডের কারণেই পরবর্তীতে চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরান, হর্ন অফ আফ্রিকা ও ইউরোপীয় সভ্যতার মধ্যে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হয়েছিলো।
এশিয়ার অন্যতম সুন্দর ও সবচেয়ে বড় মরুভূমি ‘গোবি’ এই সিল্ক রোডেই পড়েছিলো, যার পাথুরে রাস্তা ছিলো ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সহজ ও দ্রুততর যাত্রাপথ। মরুভূমি অঞ্চলের এক বিশাল অংশ এই সিল্ক রোডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাণিজ্য পরিচালনা করায় ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য জরুরী ভিত্তিতে এক দিন দূরত্বের ব্যবধানে অনেকগুলো সরাইখানা বসানো হয়েছিলো। এই সরাইখানাগুলোতে ছিলো খাদ্য, পানি এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা। সেই সাথে জায়গায় জায়গায় থাকতো ঘোড়ার আস্তাবল, যেনো চলার পথে ক্লান্ত ঘোড়াটাকে জমা দিয়ে একটি সবল ঘোড়া নিয়ে বণিক রওয়ানা হতে পারে। তবে সরাইখানা এবং আস্তাবল স্থাপন করে খাদ্য, পানীয় ও বাহনের অভাব পূরণ করা গেলেও ডাকাতদলের কবলে পড়ার সম্ভাবনা এড়ানো ছিলো ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ এই সিল্ক রোড লাভজনক ও রোমাঞ্চকর হওয়ার সাথে সাথে ছিলো ভীষণ বিপজ্জনকও। একবার কোনো ব্যবসায়ী এই পথে ডাকাতদলের খপ্পরে পড়লে সর্বস্ব হারাতে হতো তাকে, এমনকি অনেক সময় প্রাণও হারাতে হতো অনেককে। তাই এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য জায়গায় জায়গায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিলো। আর এরই মাধ্যমে সিল্ক রোডে বাণিজ্য বিনিময় ছাড়াও শুরু হয় সৈন্য বিনিময়। ফলে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও দক্ষতার বিস্তার আরও সহজে গড়ে ওঠে।
স্থলপথ ছাড়াও সিল্ক রোডের ছিলো একটি সমুদ্রপথ, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত ও আরবীয় উপদ্বীপ হয়ে চীনকে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করেছিলো। তবে স্থলপথের চেয়েও তখন এই পথ ছিলো বেশি বিপজ্জনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামুদ্রিক ঝড়ের সম্ভাবনা তো ছিলোই, তার সাথে ছিলো জলদস্যুদের ভয়। আর এ জন্যই একটু বেশি সময় লাগলেও বণিকরা স্থলপথ ব্যবহারের চেষ্টাই বেশি করতো। আস্তে আস্তে এই সিল্ক রোডের প্রধান বাণিজ্যিক নগরগুলোতে কলোনী তৈরী করা হলো, ওপেন এয়ার মার্কেট তৈরী হলো, ভোজনালয় বানানো হলো এবং স্থাপিত হলো ঘোড়া ও উটের আস্তাবল।
ফল, সবজি, শস্য, মসলাপাতি থেকে শুরু করে চামড়া, যন্ত্রপাতি, ধর্মীয় সরঞ্জাম, মূল্যবান পাথর, ধাতু, শিল্পকর্ম –এমন কিছু নেই যা সিল্ক রোডের মাধ্যমে আমদানি কিংবা রপ্তানি হতো না। চীন থেকে সিল্ক, চা; গ্রীস ও রোম থেকে সোনা, কাঁচ; মধ্যপ্রাচ্য থেকে পারফিউম; ভারতবর্ষ থেকে হাতির দাঁত, মসলা, চন্দনকাঠ, সুতি কাপড়, গন্ধক প্রভৃতির আমদানি ছিলো নজর কাড়ার মতো। সেই সাথে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ভাষা, প্রযুক্তি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নানাবিধ আবিষ্কারের বিনিময় তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বহুদেবতায় বিশ্বাসী রোমান ও গ্রীকদের ধর্মীয় উপাসনায় গন্ধকের ব্যবহারের অনুকরণেই হয়তো অন্যান্য ধর্মে ধূপ, আগরবাতি ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়েছিলো। বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মগুলো- খ্রিস্টান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, মণিবাদ, ইসলাম ধর্ম ইত্যাদি কিন্তু এই পথেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ৭ম শতকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলাম ধর্মের জ্ঞান দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লো ভারতবর্ষের এদিক-ওদিক। বিখ্যাত ব্যবসায়ী মার্কো পোলোও ইতালির ভেনিস থেকে এই পথ ধরেই চীনে এসে পৌঁছেছিলেন। দুর্ধর্ষ মঙ্গোলীয়রা অস্থির ও আক্রমণাত্মক হলেও পরবর্তীতে কিন্তু তারাও এই সিল্ক রোডের বাণিজ্যের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলো।
তবে শেষ পর্যন্ত বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদানের বাইরেও একটি ভয়ানক মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিলো এই সিল্ক রোডের মাধ্যমেই। ৫৪২ সালের ঘটনা এটি। এই মহামারীর নাম ছিলো ‘প্লেগ’। আস্তে আস্তে এই মহামারী কন্সট্যান্টিনোপোলে প্রবেশ করে এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেয়। অবশেষে ১৪৫৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্য এই সিল্ক রোডকে বন্ধ করে দেয়। আর এভাবেই শেষ হয় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এর মর্যাদাপ্রাপ্ত রুদ্ধশ্বাস বাণিজ্যপথ সিল্ক রোডের যাত্রা।
১৯৯০ সালে ‘দ্য ইউরেশিয়ান ল্যান্ড ব্রীজ’ নামে একটি রেল রোডের কাজ শেষ হয়েছে, যেটি চীন, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়াকে যুক্ত করে। এরপর থেকে ২০০৮ সালে, ২০১১ সালে ও ২০১৭ সালে ধাপে ধাপে এই রেল রোডের পরিধি বিস্তৃত হয় এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যের পথও প্রশস্ত হয়। এ কারণে একে ‘নিউ সিল্ক রোড’ বলতেই পছন্দ করেন অনেকে। ২০১৩ সালে মূল সিল্ক রোডকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ইউরোপের সাথে যুক্ত করে বুলেট ট্রেন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রস্তাব করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি-জিনপিং। এটিকে নাম দেয়া হয়েছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’। এ ছাড়াও ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ নামে একটি সামুদ্রিক বাণিজ্যপথেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে উত্তর আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্ত করে। এমনকি উত্তর মেরুকেও এই ইকোনমিক বেল্টের সাথে যুক্ত করার জন্য ইতিমধ্যেই বরফের তৈরী একটি সিল্ক রোডেরও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চীন।
এই সমস্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বর্তমানের শক্তিশালী নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে, সিল্ক রোড প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে এবং এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। ভাবতেও অবাক লাগে যে, কতো অভিনব উপায়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু প্রাচীন পথের সমষ্টি পরোক্ষভাবে পুরো বিশ্বের মানচিত্র তৈরীতে নিরন্তর অবদান রেখে চলেছে।