নেফারতিতির আবক্ষমূর্তি হোক, কিংবা ক্লিওপেট্রার সম্ভাব্য চিত্র, প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের সুন্দরী রমণীদের চেহারার নান্দনিক গঠন এবং মায়াচ্ছন্ন চাহনিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তারা সবাই-ই প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। সৌন্দর্যচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর প্রচলন ছিলো প্রাচীন মিশরে। তবে এই সৌন্দর্যচর্চা ও প্রসাধনীর ব্যবহার শুধুমাত্র নিজেদের বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রকাশের জন্য ছিলো না, এটি ছিলো তাদের ধর্মচর্চারও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিশরীয় দেবতাদের মূর্তিতে ব্যবহৃত প্রসাধনী এটাই প্রমাণ করে যে, সাজগোজ ছিলো তাদের পবিত্রতা লাভেরও মাধ্যম।
শুধু প্রসাধনীর ব্যবহারে নিজেকে অনন্য রূপ প্রদানই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো না, সাজগোজের পাশাপাশি শরীরের যত্ন ও স্বাস্থ্যবিধি পালন ছিলো অপরিহার্য। মিশরীয়রা নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যত্ন নেয়ার মাধ্যমে এক আধ্যাত্মিক দায়িত্ব পালন করতো বলে বিশ্বাস করা হয়। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও সমাধিস্থলে পাওয়া বস্তুগুলো এরই ইঙ্গিত দেয়।
প্রথম দিকে প্রসাধনীর ব্যবহারে মিশরীয় পুরোহিতদের একচেটিয়া অধিকার ছিলো। তবে পরবর্তীতে সৌন্দর্যচর্চা সাধারণ জনগণেরও নিত্য দিনের কাজ হয়ে পড়ে। অবশ্য ধনী ও অভিজাত এবং দরিদ্রদের ব্যবহৃত প্রসাধনীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ছিলো।
প্রাচীন মিশরে সৌন্দর্যের গুরুত্ব এতো বেশি ছিলো যে, পুরুষ ও নারী উভয়ই নিজেদেরকে সেরা দেখানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রায়ই মেকআপের পরিমাণ ও ধরনের মাধ্যমে বিচার করা হতো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যকে নম্রতার চিহ্ন হিসেবেও বিবেচনা করা হতো।
স্বাস্থ্যবিধি পালন
প্রাচীন মিশরের সৌন্দর্যশৈলীর ভিত্তি ছিলো মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা। মিশরীয়রা নিজেদের দেহকে একটি পবিত্র স্থান বলে মানতো। তাদের কাছে মানুষের দেহ ছিলো ‘অমর আত্মার বাড়ি’ এবং তারা পরকালের জীবন ও সৌন্দর্যের ধারাবাহিকতায় ভীষণভাবে বিশ্বাস করতো। মিশরীয় জলবায়ুর শুষ্ক তাপে সৃষ্ট ঘাম ও বালিকে ধুয়ে ফেলার জন্য বেশিরভাগ মিশরীয়রা নীলনদে গোসল করতো। বেশ কিছু প্রাচীন বাথটাবও আবিষ্কৃত হয়েছে মিশরীয় প্রত্নস্থলগুলোতে। টেবতুনিস শহরের খননে আবিষ্কৃত বাথহাউজ বা গোসলখানায় পাথরের বেসিন, ঝরনা, এমনকি পানি গরম করার জন্য একটি চুলাও পাওয়া গিয়েছে।
ঘামাচি দূর করার কার্যকরী উপকরণ হিসেবে মিশরীয়দের মাঝে বালুর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় ছিলো। সেই সাথে সাবানের ব্যবহারও ছিলো খুবই সাধারণ। অলিভ অয়েলের সাথে মিশ্রিত কাদামাটি বা ছাই দিয়ে তৈরী একটি পেস্ট ব্যবহৃত হতো শরীরকে পরিষ্কার ও ত্বককে পুষ্ট করার জন্য। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের ‘এবার্স মেডিকেল প্যাপিরাস’ এর বর্ণনা অনুযায়ী, ক্ষারীয় লবণের সাথে প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ তেলের মিশ্রণটি শুধুমাত্র ত্বক পরিষ্কারের জন্যই নয়, ত্বকের বিভিন্ন অবস্থার চিকিৎসার জন্যও ব্যবহৃত হতো।
অয়েন্টমেন্ট বা মলম
প্লিনির লেখা থেকে জানা যায়, মিশর ছিলো অয়েন্টমেন্ট বা মলমের বৃহত্তম উৎপাদনস্থল। এই অয়েন্টমেন্ট তৈরীর সবচেয়ে পরিশ্রুত পদার্থগুলো আসতো নীল নদের বদ্বীপ থেকে। অ্যালাবাস্টার বা সাদা জিপসাম তৈলস্ফটিক, সিরামিক বা কাচ এবং পাথরের টুকরো দিয়ে সজ্জিত জ্যামিতিক গঠনের খুব সুন্দর সুন্দর বয়ামে রাখা হতো এগুলোকে।
পারফিউম বা সুগন্ধি
শরীর থেকে পরিষ্কার সুঘ্রাণ আনয়নের লক্ষ্যে প্রাচীন মিশরীয়রা সুগন্ধি গাছ, ফুল ও বীজ থেকে আহরিত অসংখ্য পারফিউম ব্যবহার করতো। নির্যাসগুলোকে ছেঁকে তরল পারফিউম তৈরীর জন্য এতে যোগ করা হতো তেল। আর ক্রীমজাতীয় সুগন্ধি তৈরীর জন্য মিশ্রিত করা হতো চর্বি বা মোম।
প্রাচীন মিশরে ব্যবহৃত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল সুগন্ধিগুলো পূর্ব আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত কিছু সেরা ধূপজাতীয় উপাদান থেকে উদ্ভূত হয়েছিলো। লোবান ও গন্ধরসের মতো সুগন্ধিগুলো মিশরীয় দেবতা এবং সমাজের ধনী ও অভিজাত সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত ছিলো।
জাদুকরী সুগন্ধযুক্ত মূল্যবান সুগন্ধি টেরেবিন্থের ব্যবহার মিশরীয়রা ফিনিশীয়দের কাছ থেকে শিখেছিলো। প্রাচীন প্রেমের কবিতাগুলোতেও টেরেবিন্থের সুঘ্রাণের প্রগাঢ়তার কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও সর্বাধিক ব্যবহৃত সুগন্ধি ছিল কাইফি, যা ষোলোটি বন্য গাছপালা থেকে নিষ্কাশিত শান্ত ও শিথিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি পারফিউম।
দুগ্ধস্নান
সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাচীন মিশরীয় সৌন্দর্য রহস্যগুলোর মধ্যে একটি হলো দুধ দিয়ে গোসল, যা ত্বকের যত্নের একটি উপযোগী চিকিৎসা বলে মানা হতো। ধারণা করা হয় যে, ক্লিওপেট্রা নিজে গাধার টক দুধ দিয়ে গোসল করেছিলেন, কারণ দুধের ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের অপ্রয়োজনীয় স্তর তুলতে এবং ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম। অশুদ্ধতা অপসারণের জন্য গোসলের পানিতে মৃত সাগরের লবণ যোগ করারও রীতি প্রচলিত ছিলো।
চুল বা লোম অপসারণের ক্ষেত্রে শ্যুগারিং পদ্ধতির প্রয়োগ
চিনি, লেবু ও পানির মিশ্রণ দিয়ে অবাঞ্ছিত লোম অপসারণ করা প্রাচীন মিশরের একটি জনপ্রিয় কৌশল ছিলো, যা এখনও সাধারণভাবে অনুশীলন করা হয়ে থাকে। একে শ্যুগারিং বলে। এই পদ্ধতিতে লোম অপসারণ ত্বককে মসৃণ রাখতে সহায়তা করে।
বয়সের বলিরেখা অপসারণ
ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে দুধ ও মধুর মিশ্রণ প্রয়োগ করতো মিশরীয়রা। ত্বক নরম, মসৃণ ও বলিরেখা-মুক্ত রাখার জন্য সারা শরীরে বাদাম, সজিনা এবং ক্যাস্টর অয়েলের মিশ্রণ ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়াও ন্যাট্রন, অ্যালাবাস্টার, মধু ও সামুদ্রিক লবণের মিশ্রণে তৈরী ক্রীমও ব্যবহার করতো মিশরীয়রা।
মেকআপের প্রসাধনী
চোখের মেকআপের জন্য দুটি রং ব্যবহৃত হতো- ম্যালাকাইট থেকে প্রাপ্ত সবুজ রং এবং গ্যালেনা থেকে প্রাপ্ত কালো রং। নান্দনিক ও জীবাণু প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন এই রংগুলো প্রধানত নারী ও শিশুরা ব্যবহার করতো।
সীসা সালফাইডের একটি নীল-ধূসর রঙের প্রাকৃতিক খনিজ গ্যালেনার সাথে মিশিয়ে কাজল তৈরী করা হতো। একটি ছোট কাঠি ব্যবহার করে উপরের ও নিচের চোখের পাতায় প্রয়োগ করা হতো এই কাজল, ঠিক যেমনটি নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তিটিতে দেখা যায়।
কোহল বা কাজলের ব্যবহার সম্ভবত প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সাধারণ সৌন্দর্য রহস্যগুলোর মধ্যে একটি। কেবল আবেদনময়ী চাহনি সৃষ্টিতেই নয়, এই কাজল সূর্যের বিরুদ্ধে চোখকে রক্ষা ও চোখের সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদানেও উপযোগী ছিলো। যদিও কোহলে উপস্থিত সীসা লবণের উচ্চ ঘনত্ব সাধারণত বিষাক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, তাই মিশরীয়রা ব্যবহারের আগে ত্রিশ দিন পর্যন্ত উপকরণগুলো প্রক্রিয়াজাত এবং ফিল্টার করে থাকতো। সুতরাং চূড়ান্ত প্রয়োগে ব্যবহৃত কাজলে শুধুমাত্র নিম্ন স্তরের সীসা অবশিষ্ট থাকতো, যা চোখের জন্য নিরাপদ এবং যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল।
মিশরীয়রা তাদের ভ্রুকে গাঢ় করার জন্য পোড়া বাদাম ব্যবহার করতো। ম্যালাকাইট পাথর থেকে তৈরী চোখের সবুজ মেকআপকে তারা জাদুকরী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো, এই সবুজ মেকআপ হোরাসের চোখকে উদ্দীপিত করবে এবং ব্যবহারকারী মানুষদেরকে বিভিন্ন অসুস্থতা থেকে রক্ষা করবে।
নিজেদের ঠোঁট এবং গালকে রাঙানোর জন্য তারা ব্যবহার করতো গল থেকে তৈরী লাল রঞ্জক। এ ছাড়াও শরীর, নখ এবং ঠোঁটকে তারা চর্বিযুক্ত লাল ওচার ব্যবহার করেও রাঙাতো।
কসমেটিক প্যালেট
প্রসাধনী পাত্র বা প্যালেটগুলো মিশরের প্রাচীনতম প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম। গ্রানাইট, ব্যাসাল্ট, অ্যালাবাস্টার এবং হাতির দাঁত দিয়ে তৈরী কিছু জার পাওয়া গেছে সাক্কারায়। আর হিয়েরোকোনপোলিসে আবিষ্কৃত হয়েছে কসমেটিক চামচ ও নার্মার প্যালেট। অনেক প্রসাধনী প্যালেট মাছের আকৃতিতেও তৈরী করা হতো। কেননা প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মাছ উর্বরতা, পুনরুত্থান এবং নতুন সূচনার প্রতীক। বিভিন্ন প্রসাধনী প্যালেট ও পাত্রগুলোকে পুনঃর্জীবনের সাথে যুক্ত প্রতীক এবং চিত্র দিয়ে সজ্জিত করা হতো।
চুলের যত্ন
মাছের হাড় থেকে তৈরী চিরুনি পাওয়া গিয়েছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে, যেগুলো সম্ভবত চুল জুড়ে সমানভাবে তেল প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন সমাধিতে আবিষ্কৃত মানুষের চুলের স্ক্র্যাপ থেকে বোঝা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয়দের উইগ পরার প্রবণতা ছিলো। পুঁতি, ফুল, ফিতা বা গয়না দিয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে সজ্জিত করতো তারা নিজেদের চুল। মেহেদি পাতা থেকে প্রাপ্ত রং হেয়ার-ডাই হিসেবে ব্যবহার করতো তারা।
সমাধিতে সৌন্দর্যের গুরুত্ব
প্রসাধনী ও সৌন্দর্যের অর্থপূর্ণ ভূমিকা মৃতের সমাধিতেও প্রয়োগ করার রেওয়াজ ছিলো মিশরীয়দের মধ্যে। পরকালের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের জন্য সৌন্দর্য সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত রাখা হতো মৃতের কবর। প্রসাধনী, চিরুনি, গহনা, সুগন্ধি, মলম –সবই পাওয়া গেছে পুরুষ, নারী ও শিশুদের কবরে।
মমি এবং মৃতের মুখোশের উপর ব্যবহৃত মেকআপ প্রাচীন মিশরের সৌন্দর্যের রহস্যগুলোকে প্রকাশ করে। এগুলোকে তারুণ্যময় ত্বক এবং কালো কাজলযুক্ত চোখ দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে।
মমিকরণ প্রক্রিয়াতেও বেশ কয়েকটি সৌন্দর্যের রীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকতো। ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায়ই তার ত্বককে নরম রাখার ব্যবস্থা নেয়া হতো; জীবিত থেকে মৃত অবস্থায় অভিষেকের জন্য এটি এক আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করতো।
রেফারেন্সঃ