ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়, বীরদের দ্বারা পূর্ণ…যাদের অবদান কখনোই ভোলার নয়। ভারতীয় উপমহাদেশ হাজার বছরের বিস্তৃত ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি দেশ…..সর্বাধিক পরিচিত ইতিহাসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মুঘল সাম্রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ সম্রাট ও সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের ইতিহাস। তিনি ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক এবং পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম হওয়ায় ‘মহামতি আকবর’ নামেও পরিচিত হন। তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন….. কিন্তু এতো অল্প বয়সে দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনার পেছনে যার অবদান ছিলো তার সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানিনা! তিনি আর কেউ নন, আকবরের স্নেহময়ী মা “হামিদা বানু বেগম”। যার প্রেরণায় আকবর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট হতে পেরেছিলেন। এমনকি সম্রাটের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রেও হামিদা বানুর বিরাট অবদান রয়েছে। তিনি তার কৈশোরের অধিকাংশ সময় পার করেছেন তার রাজ্যহারা স্বামীকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, সংগ্রামী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী এক নারী … এটা বললে ভুল হবে না যে, তিনি এমন একজন মা যিনি তার বুদ্ধিমত্তা, স্বাধীনচতা মনোভাব আর অসীম অবদানের মাধ্যমেই তৈরি করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট!
হামিদা বানু বেগম ১৫২৪ সালে পার্সিয়ান শিয়া পরিবারে শেখ আলী আকবর জামির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। হামিদার মা মাহনা আফরাজ বেগম, বংশগতভাবে তারা শিয়া মুসলিম ছিলেন। হামিদার বাবা আলী আকবর–প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের ছোট ছেলে হিন্দাল মির্জার শিক্ষক ছিলেন। হিন্দাল মির্জা হুমায়ুনের সৎ ভাই এবং সৎ মা দিলদার বেগম, যিনি বাবরের স্ত্রী ও হিন্দালের মা ছিলেন । হুমায়ুন তাঁর পিতা বাবরের প্রতিষ্ঠিত ভারত রাজ্যটি কনৌজের যুদ্ধে শেরশাহ শুরির কাছে হারিয়েছিলেন। রাজ্য হারানোর পর হুমায়ুন পাড়ি জমান তাঁর সৎমা দিলদারের কাছে। সেখানে হুমায়ুনের সৎ মা দিলদার বেগম এক ভোজসভার আয়োজন করেন। যেখানে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন সুন্দরী হামিদা বানু। হামিদার বাবার সাথে হিন্দালের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। সেখানেই হুমায়ুনের সঙ্গে ১৪ বছরের মেয়ে হামিদার প্রথম দেখা হয় এবং দেখা মাত্রই তার প্রেমে পড়ে যান হুমায়ুন, যাকে বলে Love at first sight!
হুমায়ুনের ছোট বোন গুলবদন বেগম তার লেখা হুমায়ুননামা বইতে লিখেছেন, কিশোরী হামিদা বানুকে দেখামাত্রই হুমায়ুন তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যান এবং তার সৎমা দিলদার বেগমকে জিজ্ঞাসা করেন, “কে এই কিশোরী ?” হামিদার সৌন্দর্য ও প্রানবন্ততায় তিনি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রথম কথাতেই তার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মেয়েটি বিবাহিত কিনা! বিবাহিত নয়, একথা শুনেই মায়ের কাছে বিয়ের আকাঙ্খা জানান তিনি। পরে একদিন হুমায়ুনের ইচ্ছায় হামিদা বানুকে ডাকার জন্য লোক পাঠায় দিলদার বেগম। তবে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, হামিদা বেগম সেই ডাকে আসেননি…উল্টো বলেছিলেন, “তার সাথে সৌজন্যতা হিসেবে একবারতো দেখা করেছি….আবার কেনো দেখা করবো?”
হুমায়ুননামা বই থেকে আরো জানা যায়, তারা শাহ হোসেন মির্জার কাছে যান এবং তার বেগমকে পাঠাতে বলেন। মির্জা বলেছিলেন, ‘আমি বলতে পারি, কিন্তু সে যাবে না বরং আপনি নিজে গিয়ে তাকে বলুন।’ পরে সুবহান কুলী গিয়ে কথা বলেন হামিদার সাথে; হামিদা জবাব দেন এই বলে যে, ‘রাজাদের একবার দেখা আইনী হয়; দ্বিতীয় বার সেটি নিষিদ্ধ, আমি যাবো না।’ এ থেকে বোঝা যায়, তাঁর সময়ের নারীদের প্রচুর স্বাধীনতা ছিলো, তাই হামিদাও নিজের মতামত জানাতে ভয় পাননি। এর মূল কারণ ছিলো, তাদের সমাজে স্টেটাস নির্ভর করতো পরিবারের স্ত্রী-মেয়েরা কতোটা শিক্ষিত তার উপর ভিত্তি করে। ফলে ছেলেদের মতো মেয়েদেরকেও শিক্ষিত করা হতো। এছাড়াও “ইসলাম একটা মেয়েকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে, তাই বিয়ের ক্ষেত্রে সবসময় মেয়ের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অনেক ক্ষেত্রেই আজকের সমাজে সেই স্বাধীনতাটুকু দেখতে পাওয়া যায় না!” এভাবে ৪০ দিন পর্যন্ত চলে তাদের যুক্তি-তর্ক, মান- অভিমান পর্ব। ৪০ দিন চেষ্টার পর অবশেষে হুমায়ুমের মা দিলদার বেগম নিজেই হামিদাকে বলেন, “যেহেতু তুমি একদিন না একদিন বিয়ে করবেই, তবে বাদশার থেকে সুপাত্র কে হতে পারে?” জবাবে হামিদা বলেন, “আমি যাকে বিয়ে করবো, সে এমন একজন ব্যক্তি হবে যার কণ্ঠদেশ পর্যন্ত আমার হাত পৌঁছতে পারে, এমন কাউকে নয় যাকে আমি স্পর্শ করতে পারি না”। কিন্তু হুমায়ুনও ছিলো নাছোড়বান্দা, বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে শেষ পর্যন্ত হামিদাকে বিয়েতে রাজি করাতে সক্ষম হন তিনি। অবশেষে হামিদা বানু হুমায়ুনকে বিয়ে করতে রাজি হলেও, হুমায়ুনের ভাই হিন্দাল এ বিয়ের তীব্র বিরোধিতা করেন।
হিন্দাল ভেবেছিলেন রাজ্যহারা ভাই তার, হাতে হয়তো এতো পয়সা কড়ি নেই; তাই সম্রাটের মতন করে মোহরানা যদি সে তার গুরু কন্যাকে দিতে না পারে তাহলে এটা হবে তার জন্য খুবই আত্মসম্মান হানিকর। আর মোহরানা দেওয়াটা ছিলো তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা মোহরানার মাধ্যমেই একজন নারীকে স্বাধীন করার পথে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এটাকে এম্পাওয়ার্মেন্ট এর একটা অংশ হিসেবে তারা দেখেছিলেন। যদিও এখানে নানা রকম ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করা হয়েছিলো যে, হিন্দাল তাকে পছন্দ করতো বলে তার বিয়েতে রাজি হয়নি, আসলে ঘটনাটা তা নয়। এখানে তার ভাই যাতে তার বউকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে আনতে পারে এবং গুরুর কাছেও যেনো তার সম্মানটা টিকে থাকে সেটা ভেবেই হয়তো বিয়েতে বাধা দিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে হিজরি ৯৪৮ সনে হুমায়ুন ও হামিদা বানু’র বিয়ে সম্পন্ন হয়।
যদিও তিনি হুমায়ুনের সাথে অসম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাননি, কিন্তু বিয়ে যখন হুমায়ুন তাকে করেই ফেলে তখন কিন্তু স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত নিবেদিত ছিলেন। হুমায়ুন যখন রাজ্য হারিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, ঐ সময় সেই সংকটময় অবস্থায় প্রতিটা জায়গায় হামিদা বানুও স্বামীর সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন । ওই সময়টা ছিলো হুমায়ুনের জন্য খুবই কঠিন সময় এবং সেসময় হামিদা বানু প্রত্যেকটি কঠিন মুহূর্তেই তার পাশে থেকেছেন এবং তার রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্যে সে নিজেও স্বামীর সাথে কষ্ট করেছেন। বিবাহের এক বছর পর এরূপ কঠিন জীবন যাপনের মধ্যেই ১৫৪২ সালের ১৫ অক্টোবর তাদের কোলজুড়ে আসে এক ছেলে সন্তান! হুমায়ুন একদিন স্বপ্নে দেখে একজন সুফি এসে বলে তার ছেলের নাম আকবর রাখতে। পরবর্তীতে হুমায়ুনের স্বপ্ন অনুসারেই ছেলের নাম রাখা হয় “জালাউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর”। পৃথিবীর ইতিহাসে যিনি মহান শাসকদের অন্যতম “আকবর দি গ্রেট”।
১৫৪৫ সালে শের শাহ শুরি মারা যাবার পর তার উত্তরসূরী ইসলাম শাহও ১৫৫৪ সালে মারা যান। আর এভাবে শুরি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে! ১৫৫৪ সালের নভেম্বরে হুমায়ুন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং ১৫৫৫ সালে তিনি দিল্লি পুনরুদ্ধার করে তার রাজত্ব বুঝে নেন। কিন্তু ভাগ্যের বিড়াম্বনা একেই বলে! লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মারা যান তিনি। ১৫৫৬ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তার এই অকালমৃত্যু হয়। এরপর তাঁর পুত্র আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। যখন তার বয়স মাত্র তেরো। এসময় তার মা হামিদা বানু’র বুদ্ধির জোড়েই কিন্তু রাজকার্য চালিয়েছিলেন তিনি। সেসময় তেরো বছরের এই ছেলেটিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে , সঠিক পথ দেখিয়ে আকবরের মতো এক সেক্যুলার রাজা তৈরি করেছিলেন তিনি ।
হামিদা কেবল তার স্বামীর বিশ্বস্ত সহকর্মীই ছিলেন না, তিনি ছোট আকবরকে লালন-পালন করে দুর্দান্ত নেতা হিসেবে গড়ে তুলে রাজনৈতিক বুদ্ধিমাত্তারও পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন বিশ্বস্ত কাউন্সিলর, যিনি আকবরের শাসনকে শক্তিশালী করতে এবং অবস্থানকে দৃঢ় করতে রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যে তার অবদান কেবল তার স্বামী এবং পুত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যবসায়ীও ছিলেন, তার নিজস্ব জাহাজের ব্যবসা ছিলো এবং আরো অনেক ধরনের ব্যবসা তিনি চালাতেন। এমনকি তার আলোচনার দক্ষতা রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও চলে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে তিনি তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং বিভিন্ন পান্ডুলিপি সংকলন ও অনুবাদের কাজ করেন। তার লাইব্রেরি ছিলো বিশাল বইয়ের সজ্জিত। তিনি অসংখ্য পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন, তার মধ্যে রামায়ণ তার সবচেয়ে প্রিয় বই ছিলো। জানা যায়, তিনি যখন মারা যাচ্ছিলেন মারা যাবার আগে রাম–সিতার গল্প পড়ে শোনাতে বলেছিলেন। আজ আমরা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রাজা রামপুর গ্রন্থাগারে তার সিলমারা সেইসব বইয়ের কপি দেখতে পাই।
তিনি যেমন হুমায়ুনের চমৎকার স্ত্রী ছিলেন তেমনি আকবরের স্নেহময়ী ও ভালবাসার মা ছিলেন। আকবর তার মা’র অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। ইংরেজ পর্যটক থমাস করিয়েটের বর্ণনা মতে, আকবর হামিদাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার লাহোর থেকে আগ্রা যাবার পথে আকবর নিজে তার পালকি কাঁধে তুলে নদী পার করেছিলেন। যুবরাজ জাহাঙ্গীর যখন পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, হামিদা তখন তার বুদ্ধিমত্তা দিয়েই বিষয়টি সামলে নেন। জাহাঙ্গীর তার পিতা আকবরের প্রিয় মন্ত্রী আবুল ফজলকে মেরে ফেলার পরেও পিতা–পুত্রে পুনর্মিলন সাধিত হয় শুধুমাত্র হামিদার অনুরোধ ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা । আকবর সমগ্র জীবনে কেবল দুইবার চুলদাঁড়ি ফেলেছেন- ১. পালক মা জিজি আনগার মৃত্যুতে আর ২. গর্ভধারিণী মা হামিদার মৃত্যুতে।
হামিদা বানু ১৬০৪ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যবরণ করেন। হুমায়ুনের মৃত্যুর পরে তিনি পঞ্চাশ বছর বেঁচে ছিলেন। তাকে দিল্লীতে সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধতে কবর দেয়া হয়। তাঁর জীবনের বিবরণ হুমায়ুননামা, আকবরনামা এবং আইন-ই-আকবরীতে রয়েছে। বিশদ বিবরণ রয়েছে গুলবাদন বেগমের লেখা হুমায়ুননামাতে। মুলত তিনি ছিলেন একজন আগত কুইন, যিনি সচেতনভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচার করেছিলেন, যা পরবর্তীতে তার ছেলের সাম্রাজ্যকে সুসংহত করতে সহায়তা করেছিলো। তিনি একজন সহায়ক স্ত্রী, স্নেহময়ী মা এবং দুর্দান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। এমনকি একজন নারী একটি সাম্রাজ্য তৈরীর ক্ষেত্রে কতোটা ভূমিকা পালন করতে পারে সেটা আমারা হামিদা বানুর মাধ্যমেই বুঝতে পারি। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে মুসলিম মেয়েদের যে কি পরিমান স্বাধীনতা ছিলো, তার উদাহরণ হামিদা বানু বেগম নিজেই।
এসকল ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে বহু গবেষণা করা হয়েছে, বড় বড় সিনেমা তৈরি করা হয়েছে….. কিন্তু এসবের মাধ্যমেও আমরা তাদের চরিত্রগুলোকে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি, এদের চরিত্রে যে বহুমাত্রিক গুণ রয়েছে তা আমরা হাইলাইট করতে পারিনি। যুগ যুগ ধরেই কিন্তু আমরা অনেক হিরো পেয়েছি অথচ অর্থের অভাবে, বহু বছর ধরে আমাদের ওপর গোলামী চালানো ইত্যাদি…. এসকল কিছু মিলিয়ে আমরা হয়তো সময়-সুযোগ করে উঠতে পারিনি তাদের উপস্থাপন করার। কিন্তু এখন সময় এসেছে তাদের চরিত্রগুলোকে সবার মাঝে তুলে ধরার। তাই আমাদের সবার উচিত আমাদের এ হিরোদের বাঁচিয়ে রাখা, তাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং অন্যের সাথে শেয়ার করা!