খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালের ২০ জানুয়ারি। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। পূর্ব দিক থেকে পার্সিয়ান গেইটের কাছে ধেয়ে আসছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের এক ভাগ সৈন্য। জাগ্রোস পর্বতমালার মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান কুয়াশায় ঘেরা বিপজ্জনক এই রুটে স্বয়ং আলেকজান্ডার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার সেনাবাহিনীকে। অপরিচিত জায়গায় বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্ভাবনা থাকায় সেনাবাহিনীর আরেক অংশকে তিনি পাঠিয়েছেন জেনারেল পার্মেনিয়নের নেতৃত্বে রয়্যাল রোড ধরে অগ্রসর হতে। এই পর্যন্ত আসতে তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন তাদেরকে হতে হয় নি বললেই চলে। বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় মানুষেরা বরং নিজেরাই মেসিডোনিয়ান সেনাবাহিনীর আতঙ্কে পথ থেকে সরে গিয়েছে। তাই পার্সিয়ান গেইটের এতো কাছাকাছি এসে কোনো বাধার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনার কথা মাথায়ও আসে নি আলেকজান্ডারের। কিন্তু হঠাৎ-ই সদ্য তৈরী একটি দেয়ালে বাধাপ্রাপ্ত হলো আলেকজান্ডারের সামনের অংশে থাকা সৈন্যরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ওপর শুরু হলো পাথরবর্ষণ। ক্রমাগত গুলতি, মিসাইল ও পাথর নিক্ষেপের মুখে মেসিডোনিয়ান সেনাবাহিনী অসহায় হয়ে পড়লো। পিচ্ছিল পথে মারা পড়তে লাগলো আলেকজান্ডারের অগণিত সৈন্য। আলেকজান্ডার পিছু হটতে বাধ্য হলেন। দিগ্বীজয়ী বীর আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে এমন শক্তিশালী প্রতিরোধ যিনি গড়ে তুলেছিলেন, তার নাম অ্যারিওবার্জেন্স।

অ্যারিওবার্জেন্স পার্সিসের একজন প্রাদেশিক গভর্নর ছিলেন। কিন্তু তার যোগ্যতা ও মেধায় আপ্লুত হয়ে পারস্যের সম্রাট তৃতীয় ডেরিয়াস তাকে পার্সিয়ান সেনাবাহিনীর কমান্ডার পদে নিযুক্ত করেন।

অ্যারিওবার্জেন্স: ইতিহাসের অনুল্লিখিত

পারস্য গেট, © Wikimedia

আলেকজান্ডার পারস্যকে আক্রমণ করেছিলেন এবং তৃতীয় ডেরিয়াসকে পরাজিত করে পারস্য অধিকার করেছিলেন –ইতিহাসের এতোটুকু চর্চাতেই আমাদেরকে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। কিন্তু পারস্য কতোটা সাহসিকতা ও শক্তির সাথে আলেকজান্ডারের বাহিনীর সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলেকজান্ডারকেও যে নাজেহাল হতে হয়েছিলো, সে সম্পর্কে আমরা ক’জন জানি?

অ্যারিওবার্জেন্স ছিলেন সে সব বীরেরই একজন, যিনি আলেকজান্ডারকে পার্সিয়ান গেইট অতিক্রমের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিহত করেই ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকেও পরাজিত হতে হয়েছিলো, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ও বীরত্বে কোনো কমতি ছিলো না।

অ্যারিওবার্জেন্স: ইতিহাসের অনুল্লিখিত

চেসমেহ চেনার, © livius.org

পার্সিয়ান গেইটের প্রতিকূল পথ আলেকজান্ডার ও তার বাহিনীর কাছে ছিলো একদমই নতুন, কিন্তু অ্যারিওবার্জেন্সের সবগুলো সম্ভাব্য পথ সম্পর্কেই ধারণা ছিলো। তিনি আগে থেকে এ-ও খবর পেয়েছিলেন যে, মেসিডোনিয়ান সেনা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে এবং স্বয়ং আলেকজান্ডার পার্সিয়ান গেইটের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা সাজিয়ে ‘চেসমেহ চেনার’ নামের একটি ছোট্ট গ্রামে ওত পেঁতে পার্সিয়ান সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অ্যারিওবার্জেন্স এবং সূর্যোদয়ের সময় মেসিডোনিয়ান বাহিনী যখন ঠিকমতো চোখ মেলে তাকাতেও পারছিলো না, ঠিক তখন সংকেত পাবার সাথে সাথেই তাদেরকে নাজেহাল করে ফেলেছিলেন তিনি।

সে সময় সম্ভবত স্থানীয় কেউ আলেকজান্ডারকে সহায়তা করেছিলো অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে সেই পথ থেকে ফিরে যেতে, তা না হলে সে যাত্রায় আলেকজান্ডারের পরাজয় প্রতিরোধ করা মুশকিল ছিলো।

পর দিন ভোরে আলেকজান্ডার আবারো নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অ্যারিওবার্জেন্সের ক্যাম্পে আক্রমণ করে বসেন। উত্তর দিক থেকে ফিলোটাস, পশ্চিম থেকে ক্র্যাটারাস এবং পূর্ব থেকে আলেকজান্ডার সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পার্সিয়ান সেনাদের ওপর। একই সাথে তিন দিকের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না অ্যারিওবার্জেন্স। নিজের ক্যাম্পেই মেসিডোনিয়ান বাহিনীর হাতে নিহত হন এই পার্সিয়ান বীর।

সাহসিকতা, আনুগত্য এবং ধূর্ততার প্রতীক প্রাচীন পারস্যের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব অ্যারিওবার্জেন্সের জন্ম একটি অভিজাত ও শক্তিশালী পরিবারে। অল্প বয়স থেকেই সামরিক কৌশল ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসাধারণ প্রতিভাধর ছিলেন অ্যারিওবার্জেন্স।

তরুণ অ্যারিওবার্জেন্স পার্সিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন এবং এক পর্যায়ে জেনারেল পদের মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন এবং একজন বিশেষ সেনা হিসেবে সবার নজর কেড়েছিলেন। নিজের সাহসিকতা ও পারদর্শিতার জন্য সহকর্মী সৈন্য ও উর্ধ্বতনদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন খুব অল্প সময়ে। বিপদের মুখে অসম সাহস, সামরিক অভিযান পরিকল্পনার ক্ষেত্রে চতুরতা ও যুদ্ধে বিজয় প্রাপ্তির জন্য সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করার অসাধারণ ক্ষমতা তাকে সবার মাঝে বিশেষ করে তুলেছিলো।

আলেকজান্ডারের জাগ্রোস অভিযানের মানচিত্র

কাউকে প্ররোচিত করার শিল্পেও বেশ দক্ষ ছিলেন অ্যারিওবার্জেন্স। তিনি নিজের ক্যারিজমেটিক বুদ্ধি ও বাগ্মীতা দিয়ে তিক্ত থেকে তিক্ততর শত্রুদেরকেও জয় করে নিতে সক্ষম ছিলেন। আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে পার্সিয়ান গেইটের অভিযান পরিচালনায় তিনি স্থানীয়দের সাহায্য সবচেয়ে বেশি লাভ করেছিলেন, কারণ তিনি তাদেরকে বুঝিয়েছিলেন যে এই আক্রমণ প্রতিহত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিবার ও ঘর-বাড়িকেই রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।

সামরিক বাহিনীতে এতো সাফল্য সত্ত্বেও অ্যারিওবার্জেন্স নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন দর্শন, ইতিহাস ও শিল্পকলা অধ্যয়নে। শিল্পের পৃষ্ঠপোষক এই ব্যক্তি বহু কবি, সঙ্গীতজ্ঞ ও চিত্রশিল্পীদের প্রতিনিয়তই সমর্থন করে গিয়েছেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ ও কবি।

সারা জীবন অ্যারিওবার্জেন্স তার পরিবার এবং জাতির প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। মাতৃভূমির জন্য তিনি অনেক যুদ্ধ লড়েছেন। জনগণকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবনকেও ঝুঁকিতে রাখতে সদা প্রস্তুত ছিলেন তিনি। কর্তব্যের প্রতি তার নিষ্ঠা তাকে পার্সিয়ানদের কাছে একজন বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিদেশী আক্রমণকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করে গিয়েছেন অ্যারিওবার্জেন্স এবং একজন বীরের মৃত্যুই বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি। আজ তাকে প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সেরা নেতা ও চিন্তাবিদ হিসেবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, কেননা তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যার সাহস, প্রজ্ঞা ও শৈল্পিক প্রতিভা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। ইয়াসুজে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা ঘোড়সওয়ার এই বীরের ভাস্কর্য আজও আমাদেরকে তার অবদানের কথা জানান দেয়।

রেফারেন্স: