‘বাঙাল বাঙাল করো কেন? বাঙাল কি সাগর দিয়া ভাইস্ সা আসছে? কলকাতা থেকে বিক্রমপুর আষ্ট দিনের পথ। অমিল কই মিলই সব’।
বাংলা সাহিত্যের ভাষা বিশেষ করে বাংলা উপন্যাসের ভাষা কোনটি হবে তাই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনায় পঞ্চমুখ দুই ঘটি-বাঙালের চুলচেরা বিশ্লেষণ, ভাষাগত সংশ্লেষণ ইত্যাদীতে হৃষ্টপুষ্ট ছিল বাংলা সাহিত্যেবোদ্ধাদের বিগত শতাব্দী। অনেক কিছুর গত হয়েছে তবে বিগতের চেয়ে ভবিষ্যৎ আগতের/অনাগতের ফায়সালা কতটুকু হলো তার মনে হয় সুুরাহা এখনও হয়নি। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যাকে নিয়ে উক্ত শিরোনামে লেখা হচ্ছে তিনি অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে থাকতে পেরেছেন। অনেক অসঙ্গতিকে মনোমুগ্ধকর লেখনি দিয়ে সেটা সামাজিক সঙ্গতিতে এনে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন তাতে আর সন্দেহ কি? তবে অন্ধদের আঁকড়ে ধরা যুগের বিরুদ্ধে তো বিল্পবী ঝাণ্ডা তুলেছিলেন সেটাই বা কম কি! এবার সফলতা-বিফলতা’র পরিধি টানতে গেলে সেখানে জয়-পরাজয়ের বিষয়গুলো আসতে পারে অবশ্য সেটাও নির্ভর করে একপাক্ষিকতার আশ্রয়ের মাধ্যমে। যেমন হিন্দিতে খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য আছে ‘যো জিতা, ওহে সিকান্দার হ্যায়’! ইতিহাস লিখিত হয় বিজয়ীদের নিয়ে, পরাজিতরা সেখানে আস্থাকুঁড়ে পতিত হয় সমাজ-কালের অতল গর্ভে। আর মানুষই যেহতু সমাজের হর্তা-কর্তা-বিধাতা আর তার হকদার-রক্ষাদার -জামিনদার তাই সমাজের পূর্ববর্তী নির্মানকে খুব সহযে বিনির্মাণের ট্যাগ লাগিয়ে উল্টেপাল্টে ফেলা যায়। বেচারা প্রাণহীন-আত্মাহীন সমাজ পরবর্তীতে কতিপয় দ্বারা লাঞ্চিত-বঞ্চিত হয়। তার উত্তরসূরিদের সো-কলড্ প্রোগেসিভ চিন্তাচেতনার দ্বারা নিন্দিত হওয়াও অমূলক/অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য গালি খাওয়ার রীতি নতুন নয়, তবে তার স্টাইলটা তার ফ্যাশানটা বদলেছে তা না মানলে সত্যের অপলাপ হবে।

কবিগুরু’র হারজিত কবিতার কয়েকটি লাইন-

‘ভিমরুল মৌমাছিতে হল রেষারেষি,
দুজনে মহাতর্ক কার শক্তি বেশি?
ভিমরুল কহে আছে সহস্র প্রমাণ,
তোমার দংশন নহে আমার সমান।
মধুকর নিশ্চুপ ছলছল আখিঁ।
বনদেবি কহে তারে কানে কানে ডাকি।
কেনো বাছা নিরুত্তর?
একথা নিশ্চিত।
বিষে তুমি হার মানো মধুতে যে জিত!

কথাটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বেলায় সর্বাংশে সত্য না হলে ওনার জীবনের নানা অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত ঠিক এমনটাই নির্দেশ করে। প্রতীকি ভিমরুল আর মৌমাছিতে অতটা রেষারেষি-ঘেঁষাঘেঁষি না হলেও বাস্তব জগত তথা মানব সমাজে মানুষের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা-পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদী ঐ ‘কার শক্তি বেশি’ এই মামলার ফায়সালা/রায় দিতে হলে বা বলতে পারি ঐ পর্যন্ত পৌছাতে অবশ্যই নানা কাঠখড় পোড়াতে না হলেও বিস্তর পরিমাণ মানি’র দরকার হয়। আর যাদের অন্য-ভিন্ন, পথ-পন্থা আছে সেখানে মাসলের পাওয়ার অবশ্যই কাঙ্খিত মামলার রায় নিজ অনুকুলে নিয়ে আসতে পারে। আবার দম্ভ করে বলে এ তো আমার বা-হাতকা খ্যাল! ভাগ্যিস ডান হাতের কথা উচ্চারণ করেনি! সেটা হলে ফলাফল পৌছানোর আগেই তার সাক্ষীসাবুদ, অর্থ-বিত্ত কোনো বিশেষ ব্যক্তির দ্বারা হস্তগত-কুঙ্খিগত হয়ে আচার-বিচারের সলিলসমাধি হতে/করাতে বাধ্য।

যাইহোক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সহ আরো কয়েকজন শুটকি-ঝাল খাওয়া বাঙালির আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ পড়ল ওপার বাংলায় আয়োজিত সাহিত্যসম্মেলনে। সবাই গেল নিজ নিজ ভাবনাচিন্তা নিয়ে। দুইবাংলার সাহিত্যিকরা অনেকদিন পরে একত্রিত হয়ে পারস্পারিক বেগকে ভুলে আবেগে অভিভূত হয়ে এক মাহাল তৈরি করল। প্রাণের টান, আত্নার টান আর ভালবাসার টান এই তিনটিকে এক হতে অবশ্য এর আগে পাড় হতে হয়েছে বিশাল কাঁটাতারের বেড়া। কিংবা তারও আগে ওপার বাংলার ভিসা আর এপার বাংলার পাসপোর্টের সংস্থান করতে হয়েছে। অবশেষে নানা ঝক্কিঝামেলা সামলিয়ে সবাই একত্রিত হয়ে পূর্ববর্ণিত সম্মেলনে যোগ দিল। চলল সমান তালে কয়েকদিন।

এবার পালা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। সব বাঘা বাঘাদের অন্তরঃস্পর্শী আর অনাগত কালের ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনার মননশীল-যুক্তিশীল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পূর্বেই অনেকের কার্যত দেহরঞ্জন না করলেও মনোরঞ্জন যে করে ফেলেছে, সেখানে আখতারুজ্জামান কোনগুলোকে আর কিভাবে বললে ওনার আর যাইহোক সম্মান নয় বরং অসম্মান হবে না তা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে উপস্থিত বুদ্ধিগুণে আখতারুজ্জামান বলে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের ভাষা কোনো কৃত্রিম ভাষা হবে না। বরং যাদেরকে নিয়ে, যে অঞ্চলকে নিয়ে সাহিত্য রচিত-বিরচিত হবে সেখানকার ভাষাই হবে ঐ ঔপন্যাসিক/নাট্যকারের মান ভাষা।

আখতারুজ্জামান তো সাব-কনশাসে অনায়াসেই বলে ফেললেন। কিন্তু এর রিয়েকশন যদিও তখনকার জন্য ঐ মুহূর্তে পড়ে নি তবে তা পড়তেও বেশিক্ষণ লাগে নি। স্রেফ একটা সূর্যাস্তের ব্যাপার পর্যন্ত। রাতেই সেটা প্রকাশ পেল। আনন্দবাজার পত্রিকার নৈশভোজ/ভুরিভোজের সভায় সবার উপস্থিতি একান্ত কাম্য হলেও শুধুমাত্র আমাদের আখতারুজ্জামানকে কেউ দাওয়াত দেননি। আর বেচারা ইলিয়াসের রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে একশেষ অবস্থা আর কি! যাইহোক সংকল্প স্থির করলেন উনি যা যা বললেন তদ্রুপই করবেন। সেদিকার মতো ঘটনার রীতি অনুযায়ী ইতি হলেও আখতারুজ্জামানের মন গভীর বেদনাগস্ত হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। অথচ সেদিন রাতেই উনার অন্যসব এপার বাংলার বন্ধু-বান্ধবরা কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে, ঢেকুর তুলে সেদিনের মতো রাত্রিকাভার করলেন। কেউ ঘুণাক্ষরেও ইলিয়াসের খোঁজ নিলেন না!

গল্প আর উপন্যাস এই দুইক্ষেত্রেই মূলত আখতারুজ্জামানের প্রতিভার ভাস্বরতার স্বাক্ষর মিলে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা। বাংলা সাহিত্যের অসামান্য দুটি কর্ম বলা যায়। আর গল্পগ্রন্থের মধ্যে দুধভাতে উৎপাত, দোজকের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, খোয়ারি আর অন্যঘরে অন্যস্বর অন্যতম।

সাহিত্য বিশেষকরে যে দুটি উপন্যাস তিনি রচনা করেছেন চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা’র প্রতিটির আলাদা আলাদা ঘটনা, চরিত্রের চরিত্রায়ন, ভাষাগত বৈচিত্র্যের সম্মীলন, বিশেষ কোনো দিকের প্রতি ইঙ্গিত, চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে ভারসাম্য যেমন আছে তেমনিভাবে কোনো কোনো চরিত্রের বাস্তব উপস্থিতিও চোখের সামনে ভেসে উঠার মতো মনে হয়। দুটি উপন্যাসই ঐতিহাসিক বা ইতিহাস আশ্রিত। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পূর্বে সংগঠিত ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ঘটনার আলোকে রচিত হয় ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আর ‘খোয়াবনামা’ তৎকালিন বিট্রিশ কোম্পানির শাসনের প্রাক্ষালে অনুষ্ঠিত ফকির-সন্যাসীদের বিদ্রোহের মূল বিষয়বস্তু থেকে শুরু হয়ে, বিট্রিশ রাজের ভারত বিভাগ অবধি, পাকিস্তান আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদী ঘটনা পর্যন্ত উপন্যাসের বিস্তৃতি হয়েছে। দুটি উপন্যাসের ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক এটা মামুলি মন্তব্য। তবে উপন্যাসে প্রধান যে দিকটি বড় হয়ে দেখা দেয় সেটা হলো ঐসব চরিত্রের ভাষাগত দৃষ্টিভঙ্গি। বা বলা যেতে পারে ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে এবং তাদের মুখনিঃসৃত ভাষাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কোনো কৃত্রিমতার ছড়াছড়ি নেই, কোনো জটিলতার আশ্রয় নেই অন্তত ভাষার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য বা বলা গেলেও চরিত্রগুলোর সার্থকতাকে বিচার করতে গেলে সেটা অপ্রযোজ্য হয়েই দাঁড়ায়। তাহলে বলা যেতে পারে আখতারুজ্জামান তার পূর্বসংকল্প স্বীয় উপন্যাসে বজায় রেখেছেন। ভাষাকে ঐ সমাজ তথা ঐসব মানুষদের মুখেরই প্রতিনিধিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কোনো চাপিয়ে দেয়া সুশীলদের ভাষাভিত্তিকে মানা হয় নি বলেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অনেকের চেয়ে অন্যতম বা ভিন্নতম।

‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস যেহেতু ইতিহাসকেন্দ্রিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তাই কতিপয় ইতিহাস আশ্রিত চরিত্রেরও সমাবেশ হয়েছে। ফকির-সন্যাসীদের বিদ্রোহ কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে যার নেতৃমূলে ছিলেন ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, ফকির চেরাগ আলি প্রমুখ। ইলিয়াস তাদেরকে সরাসরি নিয়ে আসেননি যদিও অন্যসব চরিত্রের দ্বারা পূর্বতনের বিভিন্ন কাহিনির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের অর্জন, শৌর্য-বীর্যের প্রতাপ, শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সবশেষে ভারত বিভক্তি তথা পাকিস্তান আন্দোলন আর কৃষকের তেভাগা আন্দোলনের ক্ষাণিক উপস্থিতি দারুণভাবে আন্দোলিত করে পাঠককে। অবশ্য সমালোচনাও কম নয়। প্রথানুযায়ী উপন্যাসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা তথা ব্রহ্মপুত্র-যমুনার তীরাঞ্চলের মানুষদের নিয়ে। তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নিয়ে, তাদের ভাষাগত বৈচিত্র্য নিয়ে যা সচরাচর অন্যসবার সাথে খাপ খায় না/মিশে না, আর একারণেই এর স্বাতন্ত্র্যতা আছে। আবার সমালোচনার দিক দিয়ে ইলিয়াস অন্যদিকে নির্দেশ করেছেন। আমি যদি বলতে চাই তাহলে বলব উপন্যাসের চরিত্রেগুলো, তাদের নিজ নিজ নামের যে উপস্থিতি সেটা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তমিজের বাপ যে কি না নায়ক তমিজের বাবা তার নাম লেখক বলে যান নি। পুরো ঘটনা জুড়ে তাকে এই নামেই অভিহিত করা হয়েছে। তমিজের বাপ রহিম হতে পারত, করিম হতে পারত বা মফিজ হওয়াও অমূলক নয়। কিন্তু ঔপন্যাসিক তাকে স্বনামে নামাঙ্কিত না করে বেনামে অথার্ৎ তাকে তার ছেলের নামে চালিয়ে দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তমিজের বাপ তমিজকে জন্ম দিয়েছেন, তমিজ তার বাপকে নয়। যাইহোক আরো নানা অসঙ্গিতে ঠাসা উপন্যাসের কতিপয় চরিত্রগুলো। উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র তথা নায়ক হল তমিজ নিজেই। তবে নায়কোচিত ব্যবহারের যেরকম উপস্থিতি থাকার কথা ছিল তা তেমন আকর্ষণ তৈরি করে নি না প্রথমে না শেষে। তবে মন্ডলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার নেতৃত্ব দেওয়ায় পরিপেক্ষিতেই তাকে সে দোষ হতে মুক্ত হতে দেখা যায়। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যসব যুবা পুরুষ যেরকম ভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল তাকে সেরকমটা দেখা যায় নি। সে বরং জাতে উঠার লড়াইয়ে ব্যস্ত। মাঝির ব্যাটা থেকে চাষীর ব্যাটা হতে প্রাণান্তকর চেষ্টা অবশেষে সফলও হওয়া, ফুলজানের সাথে প্রণয়সূত্রে গ্রথিত হওয়া, শেষে খুনের আসামী হিসেবে ফেরার হয়ে ঘুরে কোথাকার কোন কৃষক আন্দোলনের জড়িত হয়ে একেবারে উপন্যাস থেকে ভেনিশ হয়ে যাওয়া কিছু বিতর্কের জন্ম দিলেও তর্কের খাতিরে তাকেই নায়ক হিসেবে বেঁছে নিতে কষ্ট হয় না। তাই সে-ই নায়ক। আর আর চরিত্রের মধ্যে সামন্তবাদী মন্ডল আর নব্য-সামন্তবাদী কালাম মাঝি’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একই মাপের। নব্য-ধনী কালাম মাঝি তমিজের নেতৃত্বে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল শরাফত মন্ডলের বিরুদ্ধে সেখানে ইচ্ছা করলে সে তা আরো জোরদার করতে পারত। তবে সে তা করেনি। কারণ সেও তো উঠতি সামন্তবাদী চরিত্র! তাই আজ যদি বর্তমান সামন্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে দুদিন পরে  সে যখন সামন্ত হবে তখন যে তার বিরুদ্ধে কেউ বিপ্লব করবে না, তার গ্যারান্টি কি! এরচেয়ে বরং আগেভাগে সটকে পরা ই বিবেচ্য। তাই বলা যায়-কালাম মাঝি বিপ্লবের আগুনে ঘি না ঢেলে, আগুনকে যথোপযুক্ত ভাবে না চেতিয়ে, সেখানে পানি ঢেলে একেবারে নিভিয়ে দিয়েছে। কার্ল মার্কসের মতে এরাই ফরিয়া, এরাই মধ্যসত্ত্বভোগী। উপন্যাসের নাম নিয়েও অনেক কনফিউশন তৈরি হয় পাঠকের মনে। খোয়াব যদি নেহাতই কল্পনা হয় তাহলে সে কল্পনাকে বাস্তবতার সাথে রঙে-চঙে চড়িয়ে জাহির করার মানে কি? ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে দেখা যায় চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি কুলসুম যে আবার আমাদের নায়ক তমিজের সৎমা বা তমিজের বাপের দ্বিতীয় বউ। তার সাথে একটি বই আর সেই বইয়ের নামও ‘খোয়াবনামা’ যেখানে খোয়াব তথা স্বপ্নের নানা বর্ণনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া আছে। কেউ যদি কারো স্বপ্নের বিত্তান্ত জানতে চায় তখন সে ঐবই ঘেটে তার অর্থ বুঝিয়ে দেয়। এটাই প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসের নামের সার্থকতা বহন করে? তা মনে হয় না। আরো অনেক কিছু না বলা কথা লেখক বলেছেন স্বীয় উপন্যাসে। তবে সেটা বোঝার-জানার দায়িত্ব আমরা যারা উত্তরসূরি আছি তাদের উপরেই বর্তানো হোক।

’চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাস নিয়ে বলার কিছু না থাকলেও ক্ষাণিকটা সমালোচনা না করলে অন্যায় আর একপেশে হবে। উপন্যাসের নায়ক কার্যত ওসমান যার ডাকনাম রঞ্জু। বিভিন্ন ঘটনার আলোকে তার সার্থকতা লেখক ফুটিয়ে তুলতে চাইলেও তার আর শেষ রক্ষা হয়নি। সেক্ষেত্রে নায়ক হিসেবে আমার কাছে হাড্ডি খিজিরের উপস্থিতিই দারুণ লেগেছে। তাই লেখক কর্তৃক ওসমান নয়, আমি হাড্ডি খিজিরকে নায়ক হিসেবে মানতে চাই। তৎকালিন ঢাকা তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিই ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, ভালোবাসার গাঁট বেধে যাদের সাথে একই ভূখণ্ডে থাকব বলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, সেখানেই আর তাদেরই জাতভাইদের দ্বারা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থা তখনই আমরাবোধ কাজ করা শুরু করল আমাদের মধ্যে। শুরু হয়ে গেল গণঅভ্যুত্থান। বিদায় নিতে হল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে। আর এই বিদায়ের বিভিন্ন ঘটনার আলোকেই রচিত হয় ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাস। এখানেও নামের সার্থকতাকে বিচার করতে গেলে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। চিলেকোঠার নিবাসী ওসমানের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা দেখা যায় না উপন্যাসে, যেখানে হাড্ডি খিজির নেহাতই মূর্খ-অশিক্ষিত হয়েও রাজনৈতিক সচেতনতা তথা দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং শেষে শাহাদত বরণ করে। অথচ ওসমানকে সেখানে মানুষিক বৈকল্যগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। যাইহোক, সেটারও সফলতা-বিফলতা প্রমাণ-যুক্তির পথ আমাদের জন্যই না-হয় তোলা থাক।

ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিখ্যাত কয়েকটি ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম হল অন্য ঘরে অন্য স্বর, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, দোজখের ওম, দুধভাতে উৎপাত আর খোয়ারি। প্রতিটা গল্পের মৌলিকতা তেমন না থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে লেখক গল্পগুলোকে সাজিয়ে তুলেছেন। দেশভাগ, বাংলাদেশের জন্ম, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িকতা, অর্থনৈতিক অসাম্যতা আর সর্বপরী অতিত স্মৃতির রোমন্থন দারুণ ভাবে আকর্ষিত করে। গল্পগুলো তে শেক্সপিয়ারের রচনার মতো কতিপয় ভৌতিক চরিত্র বা ঘটনার সম্মীলন এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। আমার কাছে অন্য ঘরে অন্য স্বর গল্পটি যতটা না সহজসাধ্য-সহজবোধ্য লেগেছে তারচেয়েও বরং দুর্বোধ্যতার মাত্রাটা বেশি লেগেছে। যাইহোক আরো নানা সাহিত্যকর্ম কলমের আঁখরে আর মনের তুলির আচঁড়ে অনবরত লিখে গেছেন। আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন নিজ স্বতন্ত্রতা আর স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার তাগিদ দিয়ে গেছেন।

তাই বলা যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অনেকের মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্মরিত-বরিত হয়ে থাকবেন সমগ্র বাংলাভাষী মানুষের অন্তরে। সেই যে কলকাতা থেকে শপথ নিয়ে এসেছিলেন সাহিত্যের ভাষা করবেন স্থানীয় মানুষরা যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষাকে, আর তিনি সেটা তার সাহিত্যকর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেনও! যদিও নিন্দুকেরা নন্দিত এই লেখকের কর্ম-ধর্মকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে বা তার নামে-বেনামে বিভিন্ন কুৎসা রটাতে সর্বদাই ব্যস্ত ছিল তারপরেও লেখকের অদম্য ইচ্ছার কাছে তাদের পরাজিত হতে হয়েছে একবার নয়, বারবার! অনেক বছর আগে যেই আনন্দবাজার পত্রিকা তাকে দাওয়াত না দিয়ে অপমান করেছিল খোয়াবনামা লিখে, তার স্বীয় বর্ণিত ভাষার ব্যবহার দেখে, সেই পত্রিকা তার পূর্ব ভুল বুজতে পেরে, মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে, এক অসামান্য আর্থিক পুরস্কার দিয়েছিল ইলিয়াসের ক্যান্সার জীবনের সায়াহ্নে। প্রথমে একটু গোয়ার্তমি থাকলেও পরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেটা গ্রহণ করেছিলেন। কেননা কলকাতায় অন্যকোনো সুহৃদ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে নি। তাই শেষ সম্বল হিসেবে ঐ টাকাই চিকিৎসার জন্য ব্যয়িত হয়। যদিও পৃথিবীর আলো-বাতাস মহান এই লেখকের পরমায়ুতে অল্পই এসে ঠেকেছিল। দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন ক্ষণজন্মা এই বাঙালি লেখক, বাংলা ভাষার লেখক।

পরিশেষে বলা যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবর্তিত এই পথ সত্যিই সাহিত্যের ক্ষেত্রে আলোড়ন তৈরি করেছিল। কৃষকের মুখ দিয়ে সো-কলড্ আধুনিক বাক্যের উচ্চারণ ব্যবহার করতে লেখক চাননি। কেননা সেটা নেহাতই কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হবে। আবার অঞ্চলভেদে ভাষাগত, ধ্বন্নিগত পরিবর্তনেরও যে বৈচিত্র্যতা আছে সেটাকে জোর করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলে হয়ত লেখার কলেবর বাড়ানো যায়, কতিপয় সুশীলের বাহবা পাওয়া যায় কিন্তু যাদের নিয়ে লেখা হল তাদেরকে রঙ মেখে শঙ সাজিয়ে রঙ্গমঞ্চে তুলে দিয়ে মানবতার নির্যাতন করা যায় খুব সহযে।

বি.দ্র.  পুরোটাই ব্যক্তিগত মন্তব্য-উপলব্ধি। তাই সমালোচনা একান্ত কাম্য।