অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় ওয়ালরগুস্ নামে এক বিত্তশালী চাষী পরিবারের বাস ছিল। তারা বার্বাডোস অঞ্চলের ক্রাইষ্ট চার্চে পাথর কেটে একটি সমাধিস্থল তৈরী করেছিলেন। এই সমাধিটির দরজা একটি বিরাটাকার মার্বেল পাথর দিয়ে সিলমোহর করে দিয়েছিলেন। সমাধির চেয়ে এটাকে রীতিমত একটি ছোটখাটো দূর্গ বলে মনে হত।

১৮০৭ খৃষ্টাব্দে টমাসিনা গার্ডেন নামে পরিবারের একজন মহিলার মৃত্যু হয় এবং তাকে ঐ পাথরের প্রকোষ্ঠে সমাহিত করা হয়। ওয়ালরগুস্ পরিবারের এই একটি মাত্র মহিলাকেই এখানে সমাহিত করা হয়। তার পরেই সমাধিস্থলটি হস্তান্তরিত হয়ে যায়। এক বৎসর পর এই সমাধিটির মালিক হন চেইজ পরিবার। এরাও ছিলেন বিত্তশালী ভূমি অধিকারী। এদের অনেক ক্রীতদাস ছিল। এই পরিবারের দুটি কন্যার পরপর মৃত্যু ঘটে। কন্যা দুটির মৃতদেহ সমাহিত করতে তারা এই সমাধিস্থলটি ব্যবহার করেন। ১৮০৮ খৃষ্টাব্দে একটি কন্যার মৃত্যু হলে তারা তাকে ঐ স্থানে সমাহিত করেন। ১৮১২ খৃষ্টাব্দে অপর কন্যার মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বারের মত ঐ সমাধিস্থলটি ব্যবহৃত হয়।

১৮১২ খৃষ্টাব্দেই ঐ কন্যাদ্বয়ের পিতা টমাস চেইজের মৃত্যু হলে মৃতদেহ কফিনে করে ঐ সমাধিতে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সমাধিস্থলে গিয়ে দেখা গেল সীসা নির্মিত যে কফিন গুলিতে মেয়েদের মৃতদেহ রক্ষিত ছিল সেগুলো স্থানচ্যুত হয়ে উল্টে পড়ে আছে। সকলে রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেলো। সবার মনে সেই এক প্রশ্ন- কিভাবে এটা সম্ভব হল? সমাধির প্রবেশ পথের মার্বেল পাথরটি তো এর মধ্যে কখনও খোলা হয়নি। আর তা খোলারওতো কোন রকম চিহ্ন পাওয়া গেল না।

১৯১৬ খৃষ্টাব্দে চেইজ পরিবারের অন্য একজন পুরুষ আত্মীয়ের মৃত্যু হলে কবরটি আবার খোলা হল। আর- কি আশ্চর্য! চেইজ পরিবারের কফিনগুলি এবারো এলোমেলো ভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। টমাসের কফিনটি ছিল খুব বড় এবং বেশী ভারী। ঐ কফিনটি বয়ে নিয়ে যেতে আটজন লোকের প্রয়োজন হয়েছিল। মাটির নীচের খিলান যুক্ত ঘরের দেওয়ালের এক পাশে কফিনটিকে খাড়া অবস্থায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে সকলেই লক্ষ্য করলেন যে কফিনটিকে কে বা কারা স্থানচ্যুত করে নিচের দিকটা উপরে দিয়ে একবারে উল্টিয়ে রেখে দিয়েছে।এই কবরখানার অবাক করা ঘটনার কথা ইতিমধ্যে লোকের মুখে মুখে এ কান থেকে ও কান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। লোকের মনে অদম্য অনুসন্ধিৎসা।

কি করে এটা হল? কি করে?

আট সপ্তাহ অতীত হবার পরই চেইজ পরিবারে মৃত্যু এসে আবার তার হিম শীতল স্পর্শ বুলিয়ে গেল। পরিবারের আরও একজনের মৃত্যু হলো। এবারও মৃতদেহ কফিনে ভরে মাটির নিচের ঐ প্রকোষ্ঠে রাখা হবে। এবার লোকজন ভেঙে পড়লো ঘটনাটি নিজ চোখে দেখার জন্য। উৎসুক জনতাকে কিন্ত হতাশ হতে হয়নি। বাইরে থেকে সমাধিস্থলটি রীতিমত সিলমোহরযুক্ত থাকা সত্বেও ভিতরে চেইজ পরিবারের কফিনগুলো পাওয়া গেল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। সিলমোহরযুক্ত সমাধি মন্দিরে কফিনগুলো স্থানচ্যুত হলো কিভাবে?

কে-কে-এই দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে?

এরপর বারবাডোসের গভর্ণর লর্ড ক্যাম্বারমেয়ার নিজে এগিয়ে এলেন। সেটা ছিল ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কফিনগুলোকে শৃঙ্খলার সাথে সারিবদ্ধভাবে গুছিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলেন। কফিনে শায়িত লোকগুলোকে শান্তিতে ঘুমাতে দিয়ে তারা বেরিয়ে এলেন। মার্বেল পাথরের ভারী আচ্ছাদনটি প্রকোষ্ঠের মুখে জুড়ে দিয়ে আবার তারা সেটি সিলমোহর করে দিলেন।দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। পরের বছর গভর্ণরের কাছে সংবাদ এলো ঐ সমাধি স্থলটিতে নানা রকম গোলমালের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে চলে গেলেন। তারপর লোকজন নিয়ে সিলমোহর ভেঙে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। ভিতরে ঢুকে যা দেখলেন তাতে উপস্থিত সকলের চক্ষু চড়কগাছ। চেইজ পরিবারের সীসার তৈরী কফিনগুলো এলো মেলো হয়ে উল্টো-পাল্টা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আর মিসেস টমাসিনা গডার্ডের কাঠের কফিনটি তার নিজস্ব স্থানে ঘরের এক কোণে যেন পরম শান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে।

এই ঘটনার কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা কেই খুঁজে বের করতে পারলেন না। নিগ্রো ক্রীতদাসদের পক্ষেও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এগুলো সরানো সম্ভবপর নয়। এগুলো যদি তাদের কীর্তি হত তবে অবশ্যই কোন না কোন ভাবে কোন চিহ্ন বা সঙ্কেত পাওয়া যেত। বন্যার পানি উঠে কফিনগুলোকে স্থান ভ্রষ্ট করতে পারতো। কিন্তু বিগত কয়েক বৎসর ধরে এখানে বন্যার কোনরূপ চিহ্নই পরিলক্ষিত হয়নি। তবে কি ভূমিকম্প? ভূমিকম্পেই যদি হবে তবে পাথরের প্রকোষ্ট কিংবা গডার্ডের কফিনের, অথবা আশপাশের বাড়ী ঘরের এতটুকুও ক্ষতি করলো না, করলো কেবল চেইজ পরিবারের কফিনগুলোর ?

শার্লক হোমস এর স্রষ্ঠা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল অভিমত প্রকাশ করলেন যে নিশ্চয় অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবে এ সব অস্বাভাবিক ঘটনাগুলা ঘটে চলেছে। সীসার কফিনের মৃতদেহে পচন ধরতে দেরী হয়, হয়ত বিদেহী আত্মারা তাতে কষ্ট পায় এবং সীসার কফিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করতে তারা কফিনগুলো এভাবে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত করে রাখে। কোনান ডয়েল আরো ধারণা করেন যে যেহেতু টমাস চেইজ ও তার একটি মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন সে জন্যে হয়তো তাদের আত্মার মুক্তি পেতে বেশা কষ্ট হচ্ছে।কারণ যাইহোক না কেন, এই সমাধির প্রকোষ্ঠে কফিনের নড়াচড়া সকলকে বেশ ঘাবরিয়ে দিল। মানুষের মনে, বিশেষ করে-স্থানীয় লোকের মনে এই অতিপ্রাকৃত ঘটনা রীতিমত আতঙ্কের সঞ্চার করলো। স্থানীয় স্বজনরা অনতি বিলম্বে কফিনগুলো সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র সমাহিত করার ব্যবস্থা করলেন। আর এত যত্নের তৈরী পাথারের সমাধিটি শূণ্য অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইলো।

আজও এই সমাধিটি শূণ্যই পড়ে আছে। মাঝে মাঝে বাতাসে নানা রকম বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র উড়িয়ে নিয়ে ঐ দরজায় ফেলে-দরজার ফাঁক ফোকর দিয়ে উড়িয়ে নেওয়া জিনিসগুলো বায়ু তাড়িত হয়ে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে। বিক্ষিপ্ত জিনিস আর হু হু বাতাসের এখানে অবাধ গতি। এত যত্নের তৈরী সমাধিটি আজ অন্য সবার কাছে একেবারেই উপেক্ষিত!