বিশ্ব-সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে এসেছে অনেক শাসক। অনেকে তাঁদের কর্মকান্ডে নিজেকে করেছেন বিতর্কিত, আবার পরবর্তী সময়ে বিনা কারণে বিতর্কিতও হয়েছেন কোন কোন শাসক। অতীতের কোন শাসককে মূল্যায়ন করতে হলে, বিবেচনা করতে হবে তখনকার সময়ে ঐ দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক কাঠামো। আজকের আধুনিক সামাজিক আদর্শে, বর্তমানের আইনের মানদন্ডে এবং একাবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদেরকে মূল্যায়ন করলে, তা’ হবে অযৌক্তিক এবং অন্যায়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন এমনই একজন শাসক যা’কে করা হয়েছে বিতর্কিত। বর্তমানের সামাজিক মূল্যবোধের বাস্তবতায় তাঁর শাসন ব্যবস্থাকে করা হয়েছে অবমূল্যায়ন এবং বিকৃত। ইতিহাস বিবর্জিত কল্প-কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে কলুষিত করার বৃথা চেষ্টা করে হয়েছে বার বার, আজও চলছে সে প্রচেষ্টা। আসলে কে ছিলেন এই আলাউদ্দিন খিলজি? কেনইবা তাঁকে নিয়ে এতো বিতর্ক? এর সঠিক উত্তর মিলবে যদি ইতিহাসকে আমরা দেখি আমাদের নিরপেক্ষ চোখ মেলে এবং পরিপূর্ণ হৃদয় খুলে।
আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন বিশ্বমানের এক বিরল সামরিক প্রতিভা। সমর কৌশলে তাঁর ছিল অসাধারণ দক্ষতা। তিঁনি মূলতঃ দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের রণ কৌশলের উপর ভিত্তি করেই তাঁর সামরিক শক্তিকে সাজিয়েছিলেন। রণক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন নিজের অভাবনীয় উদ্ভাবনী সমর কৌশল। আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন একজন ভারতীয়, বহিরাগত নন। তাঁর জন্ম ১২৬৬ সালে দিল্লীতে। তিঁনি ভারতবর্ষে দিল্লী সুলতানি আমলের খিলজি রাজবংশের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক ছিলেন। আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান জালালউদ্দিনের ভাগ্নে এবং কন্যার জীবন সঙ্গিনী। মামলুকদের পরাজিত করে জালালউদ্দীন যখন দিল্লীর সুলতান হলেন, তখন আলাউদ্দিন খিলজিকে তিঁনি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের প্রধান (আমির-ই-তুজক) নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে, ১২৯১ সালে আলাউদ্দিন খিলজি কারা রাজ্যের গভর্নর এবং ১২৯৬ সালে ভিলসার সফল অভিযানের পর আওদের গভর্নরও নিযুক্ত হন। ঐ বছরেই তিঁনি দেবগিরি আক্রমণ করে সুলতান জালালউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দিল্লীর ক্ষমতা দখল করেন। আলাউদ্দিন খিলজি তাঁর মামা এবং শশুর সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করেন এবং মুলতানে থাকা জালালউদ্দিনের পুত্রদেরও দমন করেন কঠোরভাবে। এভাবেই আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লীর সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে নিজের নিকট-আত্মীয়কে হত্যা করে ক্ষমতা হস্তগত করা ছিল খুবই স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া।
আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লীর সুলতান ছিলেন ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ সাল পর্যন্ত। তিঁনি তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন চিতোর, দেবগিরি, বারাঙ্গাল (যেখান থেকে তিঁনি কোহিনুর হীরাটি সংগ্রহ করেছিলেন), গুজরাট, হইসলা এবং পাণ্ডে রাজ্যগুলো নিয়ে। তিঁনি ভারতবর্ষের এমন এক দুঃসময়ে ক্ষমতায় আসেন, যখন ভারতবর্ষের সীমান্তে শোনা যাচ্ছিলো নিষ্ঠুর মঙ্গোল সৈন্যেদের অশ্বের ভীতিকর খুরের পদধ্বনি। ভারতের সীমানায় ছিল মঙ্গোলদের ধারালো তরবারির মুহুর্মুহু ঝলকানি। মঙ্গোল আক্রমণের আশংকায় দেশটি হয়ে পড়েছিল ভীতসন্ত্রস্ত এবং অস্থির। মনে রাখতে হবে, সেই সময় মঙ্গোলরা কোন সাধারণ আক্রমনকারী ছিল না। আজকে অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই মঙ্গোলরা তখন কতটুকু নিষ্ঠুর এবং ধ্বংসাত্মক ছিল। মঙ্গোলরা অন্য দেশ জয়ের পর সে দেশের সব পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করতো। নারীদের করতো অপহরণ, লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোজ করে পুরো দেশের অতীত এবং অস্তিত্ব মাটির সাথে মিশিয়ে দিতো। মঙ্গোলরা কোন দেশ জয় করে কেবলমাত্র লুন্ঠন এবং হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকতো না, পুরো দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতো। সেখানে সভ্যতার কোন চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যেত না। মঙ্গোলরা ছিল সন্ত্রাসী এক জাতি- যুদ্ধ, লুন্ঠন এবং ধ্বংসই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কখনও অন্য দেশ জয়ের পর সে দেশ শাসন করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না তাদের।
মঙ্গোলদের আক্রমণের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছিল। তারা কোন দেশ আক্রমণ করার আগে মোটা অঙ্কের অর্থ এবং নারী দাবী করে প্রথমে হুমকীপূর্ণ বার্তা পাঠাতো। দাবী মানা না হলে, আক্রমণ করে ধ্বংস করে ফেলা হতো পুরো দেশ। খিলজির শাসনকালে মঙ্গোলরা এমনই হুমকি দিলে, আলাউদ্দিন খিলজির পিতা ও ভাই মঙ্গোলদের সাথে সমঝোতা করার পক্ষে ছিল। কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোলদের সাথে কোন আপোষ করতে প্রস্তুত ছিলেন না, যদিও মঙ্গোলদের দাবী পূরণ করা তখন তাঁর জন্য ছিল অনেক সহজ। তিঁনি সহজ পথটি ছেড়ে কঠিন পন্থাটিই বেছে নিয়েছিলেন- মঙ্গোলদেরকে সরাসরি মোকাবেলা করা। তাঁর জন্মভূমিকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অত্যন্ত সাহসিকতা এবং দৃঢ়তার সাথে। তিঁনি অঙ্গীকার করেছিলেন, ভারতবর্ষের সীমানা থেকে মঙ্গোলদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা না পর্যন্ত বিশ্রাম নিবেন না। তাঁর সেই অঙ্গীকার তিঁনি রেখেছিলেন পুরোপুরি।
আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে মঙ্গোলরা পরপর ছয় বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এবং দু’ বার ছিলো দিল্লী দখলের ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু ছয় বারই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় মঙ্গোলরা। মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিজ খানের দ্বিতীয় সন্তান চাগাতাই খানাত ভারত আক্রমণ করে কয়েকবার। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির নির্দেশে ১২৯৮ সালে তাঁর ভাই জেনারেল উলুঘ খান মঙ্গোলদের পরাজিত করেন। ১২৯৯ সালে তাঁরই আরেক জেনারেল জাফর খানের সাহসিকতায় সিন্ধু এলাকায় মঙ্গোলদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে তাদেরকে বিতাড়িত করেন ভারতের সীমানা থেকে। মঙ্গোলরা ১২৯৯ শতাব্দীতে দিল্লী আক্রমণ করলে, খিলজি নিজেই তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ১৩০৫ সালে মঙ্গোলরা আবারো ভারতবর্ষ আক্রমণ করলে, আলাউদ্দিনের সামরিক জেনারেল মালিক নায়ক তা’ প্রতিহত করে ভারতবর্ষকে রক্ষা করে মঙ্গোল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে।
১৩০৬ সালে প্রায় এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে মঙ্গোলরা ষষ্ঠবারের মতো ভারতবর্ষ আক্রমণের জন্য ইরাবতী বা রাঘি নদীর তীরে অবস্থান নেয়। মঙ্গোলদের এই সৈন্য সমাবেশ ছিল বিশাল, ভীতিকর এবং মনে হচ্ছিলো অপ্রতিরোধ্য। ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পরে মঙ্গোল-ভীতি। মনোবল ভেঙে যায় বেশিরভাগ মানুষের, এমনকি খিলজির সভাসদদেরও। খিলজির তৎকালীন সভাসদরা তখন তাঁকে মঙ্গোলদের সাথে শান্তিচুক্তির পরামর্শ দেয়। কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ঐ যুদ্ধে খিলজির নেতৃত্বে তাঁর সমর নেতা মালিক কাফুরের কাছে মঙ্গোলরা এমন নিদারুণভাবে পরাজিত হয় যে, মঙ্গোলদের মোট এক লক্ষ সৈন্যের মধ্যে মাত্র তিন-চার হাজার প্রাণ নিয়ে পালতে সক্ষম হয়। আলাউদ্দিন খিলজির কঠোরভাবে মঙ্গোল দমনে পরবর্তী দশ বছর ভারতবর্ষে আর কোন মঙ্গোল আক্রমন হয় নি।
আলাউদ্দিন খিলজি সমগ্র ভারতবর্ষকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, যা’ হয়তো অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। সেই সময় তিঁনি দৃঢ়ভাবে মঙ্গোলদের প্রতিহত না করলে, আজ হয়তো ভারতবর্ষকে দু’তিন শো বছর পেছনে পড়ে থাকতে হতো। মঙ্গোলদের দমন করার মাধ্যমে ভারতকে তিঁনি একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, ঐ সময়ে মঙ্গোলরা বিশ্বে ছিল অপ্রতিরোধ্য নজিরবিহীন বিশাল এক ধ্বংসকারী সামরিক শক্তি। ঐতিহাসিকদের মতে, বিশ্বে মঙ্গোলরা প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল। সে সময়ে অন্য যে কোন সাম্রাজ্য- সেটি রাশিয়া সাম্রাজ্য, শক্তিশালী পারস্য, অথবা বাগদাদের বিচক্ষণ খলিফা হোক- কোনভাবেই মঙ্গোলদের প্রতিরোধ করতে পারে নি। একমাত্র স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী আলাউদ্দিন খিলজিই তাঁর সুশৃঙ্খল এবং প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী দিয়ে ছয় বার মঙ্গোলদের ভারত বিজয়ের আকাঙ্খা ব্যর্থ করে দেয়।
অনেকে ভেবে থাকে, আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোলদের বার বার পরাজিত করেছেন, এটা এমন কি আর সফলতা। মঙ্গোলরা ভারতবর্ষ দখল করলে, এক শাসকের পরিবর্তে মঙ্গোলরা অন্য এক শাসক হিসেবে ভারত শাসন করতো। মঙ্গোলদের নিয়ে তাদের এমন ভ্রান্ত ধারণা অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। মঙ্গোলরা যদি তখন ভারতবর্ষ দখল করতে পারতো, দেশটির সকল উন্নতি, সমৃদ্ধি, আবহমানকালের অতিহ্য এবং সভ্যতা হতো ধ্বংস। নির্বিচারে হত্যা করা হতো প্রায় সব ভারতীয়দের। ১৯৫৮ সালে মঙ্গোলরা যখন বাগদাদ দখল করেছিল, শহরটির অধিবাসীদের রক্তে বাগদাদের নদীগুলোর পানি হয়ে গিয়েছিল রক্তিম। বাগদাদের প্রতিটা ইঞ্চি ভূমি চাপা পড়েছিল ধ্বংসের নীচে। মঙ্গোলরা ফেলে গিয়েছিলো শুধু অগ্নিদাহের ছাই। এর আগে, ১২৩৭ সালে মঙ্গোলদের হাতে রাশিয়ারও হয়েছিল একই করুন পরিণতি। মঙ্গোলদের ধ্বংস ও লুন্ঠনের কারণে দেশটির অর্থনীতি হয়ে পড়েছিল পশ্চাদপদ- ইউরোপের অন্যদের তুলনায় রাশিয়া পিছিয়ে গিয়েছিলো অন্ততঃ দু’শো বছর। আজ রাশিয়ার অর্থনীতি এবং সার্বিক উন্নয়ণ হতো ভিন্ন, যদি না মঙ্গোলরা দেশটিকে ধ্বংস করতো। ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্প-বিপ্লব ঘটেছিল নির্বাধায়, কারণ, তাদেরকে মঙ্গোল-আক্রমণের শিকার হতে হয় নি।
এই বিশাল সাফল্যের পরও, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ, অপবাদ। আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড় অপবাদটি ছিল চিতোরের কাল্পনিক এক রানীকে নিয়ে তাঁর অভিলাষ। এই অভিযোগটি মূলতঃ চৌদ্দশো শতকে সুলতান খিলজির চিতোর আক্রমণকে কেন্দ্র করে। আলাউদ্দিনের চিতোর জয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে বর্তমানে অনেকের কল্পনাপ্রসূত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাদের ধারণা, ১৩০৩ সালে খিলজি চিতোর অভিযানে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র রাজা রানা রতন সিংএর স্ত্রী রানী পদ্মাবতীকে (রানীর নাম ছিল পদ্মিনী) পাবার জন্য। আলাউদ্দিন চিতোরের যুদ্ধে রাজা রানা রতন সিংকে হত্যা করে শহরটিকে অবরোধ করে রাখলে আলাউদ্দিনের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য রানী পদ্মাবতী নাকি তার সাথে তেরো হাজার রমণীকে সাথে নিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহুতি দিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলে, ঐ সময় ভারতবর্ষের কোথাও পন্মাবতী, এমনকি পদ্মিনী নামের কোন রানীর অস্তিত্বই ছিল না।
বাস্তবে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিলো আরো দুশো বছর পর, ১৫২৪ সালে। ঐ সময় চিতোরের রাজা সংগ্রাম সিং মোগল সম্রাট বাবরের কাছে পরাজিত হলে, শত্রুর আক্রমণে ভীত হয়ে সংগ্রাম সিংএর স্ত্রী রানী কর্ণাবতী বিষপানে আত্মহত্যা করেন। আলাউদ্দিন খিলজি এবং পদ্মাবতীকে নিয়ে কাল্পনিক কাহিনীর প্রাথমিক উৎস ছিল ১৫৪০ সালে মালিক মুহাম্মদ জয়সি রচিত “পদ্মাবত” নামের একটি মহাকাব্য। ধারণা করা হয়, ষষ্টদশ শতাব্দীতে রানী কর্ণাবতীর বিষপানে আত্মহত্যায় প্রভাবিত হয়ে মালিক মুহাম্মদ জয়সি “পদ্মাবত” কাব্যটি রচনা করেন। ঐ কাব্যের সাথে আলাউদ্দিনের চিতোর অভিযানের কোন যোগসূত্র নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ ধীরে ধীরে ঐ মহাকাব্যকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতে থাকে।
২০১৮ সালে ভারতে নির্মিত “পদ্মাবত” ছায়াছবিটি ঐ মহাকাব্যেরই চিত্রায়িত রূপ, চিতোরের রানী পদ্মিনীকে নিয়ে নয়। ছায়াছবিটিতে আলাউদ্দিন খিলজিকে মালিক জয়সির মহাকাব্যনুযায়ী সম্পূর্ণ নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। সঠিক ইতিহাসের আলোকে এটি আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্র হননের এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতিহাসের স্থান দখল করে নেয় কাল্পনিক কাব্য। কাব্য হয়ে পড়ে ইতিহাস, আর ইতিহাস হয়ে যায় কল্প-কাহিনী।
কবি আমির খুসরু, যিনি তাঁর কবিতা সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন, তিঁনি চিতোরের যুদ্ধের সময় খিলজির সাথে উপস্থিত থেকেও রানী পদ্মাবতী বা পদ্মিনী নামের কোন নারীকে তাঁর রচনায় উল্লেখ করেননি। আলাউদ্দিন খিলজি এবং কাল্পনিক পদ্মাবতীকে নিয়ে কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। এমনকি খিলজির জীবন নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকের বইতেও সুলতান এবং পদ্মাবতীর কোন উল্লেখ নেই।
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে অন্য একটি অভিযোগ ছিল, তাঁর শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর করা হয়েছে অত্যাচার। বিশেষ করে, হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নতুন কর। এই অভিযোগটির পক্ষে জোরালো কোন ঐতিহাসিক প্রমান পাওয়া যায় না। আলাউদ্দিন খিলজি কৃষকদের উপর কর বৃদ্ধি করেছিলেন সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর ব্যয়ভার বহনের জন্য। নতুন কর আরোপ করা হয়েছিল শুধু হিন্দুদের উপরই নয়, সব সম্প্রদায়ের জন্য ঐ কর ছিল বাধ্যতামূলক। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেসময় বেশিরভাগ কৃষক ছিলেন হিন্দু, এবং তাদের আর্থিক সামর্থ্য ছিল অনেক সীমিত। তাই অনেকে ভুল করে থাকে যে, খিলজি কর আরোপের মাধ্যমে হিন্দুদের নিপীড়ন করেছিলেন। তাঁর সেই উদ্ভাবিত কর ব্যবস্থা আজও প্রচলতি আছে অনেক দেশে। এই কর ব্যবস্থাকে অনেকেই ভেবে থাকেন হিন্দু নিপীড়ন করার উপায়। অভিযোগকারীরা ভুলে যায় যে, তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হলে, বিশেষ করে মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিরোধ করতে আলাউদ্দিন খিলজির প্রয়োজন ছিল প্রচুর অস্ত্র ও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। এর জন্য দরকার ছিল প্রচুর অর্থের। প্রধান এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই খিলজি পুরো ভারতে নতুন কর ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন।
আলাউদ্দিন খিলজি মাত্র বিশ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তিঁনি ভারতবর্ষকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন। খিলজির শাসনামলে ভারতবর্ষে হয়েছিল অনেক অগ্রগতি। আইন ব্যবস্থাকে ঠিক রাখতে তাঁর আইন-নীতি ছিল অত্যন্ত কঠোর; তাঁর সাম্রাজ্যে সকল সম্প্রদায়ের জন্য আইন ছিল সমান এবং আইনের প্রয়োগ ছিল নিরপেক্ষ। আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে ধর্মীয় বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ মূলধারার ইতিহাস সমর্থন করে না কোনভাবেই। আলাউদ্দিন খিলজি বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। তিঁনি ভারতবর্ষে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন করেছিলেন কঠোরভাবে। বাজারের প্রতিটি পণ্যের মূল্য তাঁর সরকার নির্ধারণ করে দিতো। শুধু মূল্য নির্ধারণ করেই খিলজী ক্ষ্যান্ত ছিল না, তাঁর কর্মচারীরা বাজারে সর্বদা নজরদারী করতো যা’তে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকে এবং ব্যবসায়ীরা পণ্যের ওজন সঠিক রাখে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক দামে কোন দ্রব্য বিক্রি করলে, অথবা ওজনে কম দিলে, ব্যবসায়ীকে কঠোর শাস্তি পেতে হতো।
ঐ সময়কালের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানির বর্ণনায়, খিলজির সময় ভারতবর্ষে দুর্যোগকালে বাজারে কোন পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলে, সরকারের মজুদ-গুদাম থেকে সেই পণ্য সরবরাহ করা হতো জনগণের মাঝে। খিলজির শাসনকালে তাঁর সাম্রাজ্যে অপরাধের সংখ্যা কমে গিয়েছিলো উল্লেখযোগ্যভাবে, কারণ সব রকমের অপকর্মের জন্য শাস্তি ছিল কঠিন। তাঁর কঠোরতার কারণে আমীর-উমরাহদের ঘুষ ও দুর্নীতি করা কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। তিঁনিই সম্ভবত ভারতবর্ষে প্রথম, যিনি সৈন্যদের জন্য নিয়মিত বেতন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এর আগে সেনাবাহিনীকে নিয়মিত বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেয়া হতো।
আলাউদ্দিন খিলজী শুধুমাত্র একজন পারদর্শী সুশাসকই ছিলেন না, তিঁনি ভারতবর্ষকে দিয়েছিলেন পর্যাপ্ত সুরক্ষা। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে তাঁর জন্মভূমি ভারতকে রক্ষার সব প্রচেষ্টাই তিঁনি করেছিলেন আন্তরিকভাবে। ভারতবর্ষের সীমান্ত থেকে এককভাবে নিষ্ঠার সাথে মঙ্গোল-বিতাড়নে সফলতায় আলাউদ্দিন খিলজিকে ইতিহাস বসিয়েছে অনেক উচ্চাসনে। গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় উপস্থাপিত কল্প-কাহিনীকে বিশ্বাস করে আলাউদ্দিন খিলজীকে মূল্যায়ন করলে, তিঁনি হয়তো হবেন খলনায়ক। আর ইতিহাসের আলোকে খিলজীকে নিরপেক্ষ চোখ মেলে এবং পরিপূর্ণ হৃদয় খুলে বিচার করলে, নিঃসন্দেহে তিঁনি এক অবিস্মরণীয় নায়ক। আমাদেরকেই বেছে নিতে হবে এ দু’টোর একটি!