আনন্দের জন্ম ১৫৯২, বৃহস্পতিবার , লাহোর I

সম্রাট আকবরের আজ আনন্দের সীমা নেই। আজ যে তাঁর নাতি হয়েছে। রাতের বেলাতেই নাতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কানে খবর পৌঁছে গেছে। অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিলেন আকবর। তাঁর ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে নাতি সাহেবকে দেখতে কিন্তু তিনি যাবেন না। তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র সেলিম যখন জন্মে ছিল তখনও তিনি যাননি। তাঁর মনে যে বড় ভয়।

নুরুদ্দীন মুহাম্মদ সেলিম (জাহাঙ্গীর)

আজ রাতে ঘুম আসছিলনা তাঁর। কত কথাই তো ভেসে আসছিল তাঁর মনে। অবশ্য এটা সেলিমের প্রথম সন্তান নয়। সেলিমের এটা তৃতীয় সন্তান। ১৫৮৬ সালে যোধপুরের রাজা উদয় সিংহের কন্যা ময়নামতি বা জগৎ গোসাঁই এর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল সেলিমের। কিছুক্ষন আগেই দূত এসে জানিয়ে গেছে ময়নামতি সুস্থ আছে। মুঘল বংশে রাজপুত রাজকন্যাদের সঙ্গে বিবাহের রীতি আকবরই প্রচলন করেছিলেন।

আকবর আজ ছত্রিশ বছর মুঘল সিংহাসনে। ১৪ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার ১৫৫৬ সালে আকবর যখন সম্রাট হয়েছিলেন রবি নদীর তীরে পাঞ্জাবের কালানৌর নামে একটি শহরে , তখন কেই বা জানত মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা আজ এত বিশাল হবে ?

জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর

আকবর মনে মনে রুকাইয়া বেগমের কথাই ভাবছিলেন। যখন তিনি রুকাইয়াকে বিয়ে করেছিলেন তখন তাঁর সাম্রাজ্য ছিল নামেই। আবার কিছুদিনের মধ্যেই সব হারাতেও হয়েছিল তাঁকে। রুকাইয়ার কোন সন্তান ছিলনা কিন্তু মা হওয়ার বাসনা ছিল প্রবল। ইদানিং যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিল রুকাইয়া। কোন কাজেই তাঁর মন নেই। যেন এক অন্য জগতেই সবসময় থাকতো। আকবর নিজেও বুঝে উঠতে পাচ্ছিল না। সমস্যা তাঁর জানা ছিল বৈকি কিন্তু সমস্যার সমাধান তো তার হাতে ছিলনা।

রুকাইয়া বেগম

একদিন গোবিন্দ কে তলব করলেন আকবর। গোবিন্দ গণৎকার। রুকাইয়ার হাত দেখল , ময়নামতিরও হাত দেখল। সব দেখে শুনে বললে কিছুদিনের মধ্যেই ময়নামতির পুত্র হবে। আর এই পুত্র মানুষ হোক রুকাইয়ার কাছে। আকবরের মনে ধরল প্রস্তাবটি। সেদিন থেকেই রুকাইয়ার যেন চোখের ঘুম উবে গেল। ময়নামতির সব দায়িত্বই নিয়ে নিল রুকাইয়া। কি খাবে , কি করবে সব দিকেই তার সজাগ নজর। আকবর মনে মনে হবু নাতির নামটাও ভেবে রেখেছেন। যে শিশু এত আনন্দ নিয়ে আসছে তার নাম তিনি খুররাম রাখবেন I ফার্সী ভাষায় খুররাম মানে যে ‘আনন্দ’।

সন্তানহীনতার যন্ত্রনা যে কি তা আকবরের থেকে আর কে ভাল বোঝে ? সেলিমের জন্মের কথা তাঁর সব মনে পরে যাচ্ছিল। ফতিমা নামে এক ফুটফুটে মেয়ে হয়েছিল আকবরের। না, সে বাঁচেনি। তারপর হাসান ও হোসেন নামে দুই যমজ সন্তান। তারাও বাঁচেনি। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল আকবর। সিক্রীতে সেলিম চিস্তীর দরগা। প্রায় নব্বই বছরের এই সুফী সন্ত তাকে আস্বস্ত করেছিলেন। তার রাজপুত স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হতেই আকবর আর ‘অপয়া ‘ আগ্রাতে তাঁকে রাখতে সাহস পাননি। সেই প্রতীক্ষার দিনগুলো যে তার কিভাবে কেটেছে তা সে নিজেই জানে । অবশেষে ৩০শে আগস্ট বুধবার ১৫৬৯ সালে সেলিমের জন্ম। চোখের জল সেদিন আর ধরে রাখা যায়নি। আকবর অবশ্য সেলিমকে কোনদিন সেলিম বলে ডাকেননি। ডাকতেন সেখুবাবা বলে। অপয়া আগ্রা ছেড়ে সিক্রি গ্রামেই তৈরী করেছিলেন এক আস্ত শহর। রোদ্দুরের মধ্যে মজদুরদের সঙ্গে লাল পাথরও বয়েছিলেন।

আজ রাতে আকবরের আর ঘুম আসবে না। না, তিনি নাতি সাহেবকে দেখতে যাবেননা এখুনি। কেন জানিনা এক অজানা ভয় তার বুকে যে আজও বাসা বেঁধে আছে। ছয়দিন অপেক্ষা করে থাকতে হবে। ছদিন পর এই শিশুর নামকরণ হবে। সেখুবাবা এই নামকরণের দায়িত্ব তাকেই দিয়েছেন। সেদিনই হবে নাতি দর্শন। রুকাইয়া বোধহয় এতক্ষনে আনন্দে পাগল হয়ে গেছে।

(আমাদের গল্পের প্রয়োজনে একটু ইতিহাস দেখে নেওয়া যাক। মুঘল বংশের প্রথম পাঁচ সম্রাট যথাক্রমে -বাবর , হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহ জাহান। বাবর ই এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৫২৬ সালে ২১শে এপ্রিল শনিবার বাবর দিল্লির উত্তরের পানিপথের ময়দানে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করেন। এটাই ছিল প্রথম পানিপথের যুদ্ধ। বাবরের চার পুত্র -হুমায়ুন , কামরান,আসকারী ও হিন্দোল । বাবরের কনিষ্ঠ পুত্র হিন্দোল। বাবরের তিন প্রধানা স্ত্রী-মহাম বেগম, গুলরুখ বেগম ও দিলদার বেগম। এর মধ্যে মহাম বেগম জন্ম দিয়েছিলেন হুমায়ুনকে , গুলরুখ বেগম কামরান আর আসকারীকে আর দিলদার বেগম হিন্দোলকে। এই দিলদার বেগম পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন -গুলরঙ্গ ,গুলচেহেরা, হিন্দোল , গুলবদন ও আলওয়ার। গুলবদন বেগম ছিলেন এক অসামান্য কবি ও হুমায়ূননামা গ্রন্থের রচয়িতা।

আকবর নিজে হুমায়ূন ও হামিদা বানুর পুত্র। ১৫৪১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে হামিদাকে বিয়ে করেন হুমায়ূন। যখন হামিদাকে বিয়ে করেছিলেন তখন তিনি গদিচ্যুত এক সম্রাট। আকবরের জন্ম ১৫ই অক্টোবর , রবিবার ১৫৪২ সালে। রুকাইয়া বেগম তাঁর প্রথম পত্নী। ১৫৫৬ সালে যখন দুজনের বিয়ে হয় তখন দুজনের বয়েসই চোদ্দ বছর। আকবরের কাকা হিন্দোল মির্জা ও সুলতানাম বেগমের মেয়ে ছিল রুকাইয়া। রুকাইয়া জাহাঙ্গীরের তৃতীয় সন্তান খুররাম কে নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করতে থাকেন। চোদ্দ বছর বয়স অবধি তিনি খুররাম কে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেন। পরে জাহাঙ্গীর তুজুক -ই -জাহাঙ্গীরি নামক আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন ,” খুররাম আমার ছেলে হতে পারে কিন্তু রুকাইয়া বেগম ওকে আমার চেয়ে হাজারগুনে ভালবাসত “। এই খুররাম বড় হয়ে ইতিহাসে শাহ জাহান নামে পরিচিত হবেন।)