ঘুরে আসা যাক খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকে। গ্রীক দূত মেগাস্থিনিস মেহমান হয়েছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দরবারে। পরবর্তীতে ভারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে পুরো একটি বই-ই লিখে ফেললেন, নাম ‘ইন্ডিকা’।

‘ইন্ডিকা’ থেকেই জানতে পারলাম, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত যখন শিকারে যেতেন, তখন তাকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রাখার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো এক দল সশস্ত্র সৈন্যকে। বিশেষ ঐ সেনাবাহিনীর প্রত্যেকেই ছিলেন নারী। চাণক্য বলেন, এ সব নারী সৈন্যদের দায়িত্বই ছিলো সম্রাটের শয্যাকক্ষ পাহারা দেয়া।

সিথিয়ান নারীরাও তো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। এই তথ্য আমাদের সবারই জানা। তবে ভারতবর্ষেও যে নারী যোদ্ধার অস্তিত্ব ছিলো, তা আমরা অধিকাংশই জানি না। ভারতবর্ষে নারীদের এই অবস্থান সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে চলে যেতে হবে মুঘল দরবারে।

মুঘল দরবারে উর্দুবেগী নারী যোদ্ধাদের এক অনন্য বাহিনী ছিলো। তাদের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব ছিলো মুঘল সম্রাট এবং তার হেরেমের সদস্যদের রক্ষা করা। আজ প্রাচ্যের এই অজ্ঞাত নারীদের সম্পর্কেই আমরা জানবো। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য এই অবিশ্বাস্য শক্তিধর নারী যোদ্ধাদের রাজনৈতিক অবদানগুলো অলক্ষেই রয়ে গিয়েছে। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষদের কলমে লেখা ইতিহাসের গল্পগুলোতে শুধুমাত্র সম্রাট বা রাজাদের কৃতিত্বই তুলে ধরা হয়েছে সবসময়।

উর্দুবেগী নারী ভারতবর্ষে  নারী  ক্ষমতার উৎস

সম্রাট জাহাঙ্গীর হেরেমের রমণীদের সাথে হোলি উৎসব উদযাপন করছেন

এবার আসা যাক মূল গল্পে। ১৫২৬ সালে ইব্রাহিম লোদীকে বাবর পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবররা ছিলেন যাযাবর জাতি। তারা যেখানেই যেতেন, সঙ্গে যেতো তাদের পরিবারও। তাঁবু খাঁটিয়ে অন্যান্য নারী আত্মীয়-স্বজনদের সাথে রাখা হতো নিজেদের মা, বোন, নাবালক সন্তান ও বয়স্কদের। পরিবারে বসবাসের এই স্থানটিকে হারেম বলে অভিহিত করা হতো। আর সেই হারেমের মানুষদেরকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রাখতেন উর্দুবেগীরা।

শারীরিকভাবে উর্দুবেগীরা ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সবসময় সতর্ক থাকতেন। উর্দুবেগীরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী। উর্দুবেগী নারীদের সেই বাহিনীতে বেশিরভাগ নিয়োগ দেয়া হতো কাশ্মীরি, তুর্কি, হাবশী ও তাতার নারীদেরকে। এসব জায়গার নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথার তেমন বাড়াবাড়ি ছিলো না বলেই যোগ্যতার সাথে তারা এই কাজটি করতে পারতেন।

আকবরের সময় তাঁবুর জায়গায় নির্মিত হলো প্রাসাদ। আর প্রাসাদে তৈরী করা হলো স্থায়ী জেনানা মহল ও হারেম। আগেই বলা হয়েছে, মুঘল যুগে প্রাসাদে মহিলাদের বাসস্থানকে ‘হারেম’ বলা হতো। আবুল ফজল এর নামকরণ করেন ‘শাবিস্তান-ই-ইকবাল’ বা ‘শাবিস্তান-ই-খাস’।

হারেমে সবাই সহজে প্রবেশ করতে পারতো না। তাই হারেম সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য বিবরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে এখানে দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, ব্রিটিশ লেখকদের সৌজন্যে ‘হারেম’ শব্দটিকে অত্যন্ত রসালো অর্থে প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অথচ বংশীয় নারীদের পর্দায় থেকেও স্বাধীনভাবে জীবন-যাপনের ব্যবস্থা সম্বলিত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর হচ্ছে হারেম। নানা ধর্ম, বর্ণ ও পেশার নারীদের এই বাসস্থানকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য নিয়মিত ও সুগঠিত প্রশাসন ব্যবস্থাও ছিলো হারেমে। আর সেই প্রশাসন ব্যবস্থারই একটি অংশ হলো সশস্ত্র নারী প্রহরী উর্দুবেগীরা। শুধুমাত্র সম্রাটের প্রতি উর্দুবেগীদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য ছিলো। সম্রাটের সকল শত্রু তো বটেই; সেই সাথে সম্রাটের উপপত্নী, রাজপুত্র এবং রাজকন্যারাও ভয়ে তাদেরকে সমীহ করে চলতেন। হারেমে সম্রাট অনেক বেশি সময় কাটাতেন বলে বিশ্বস্ত ও যোগ্য প্রহরী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতেন উর্দুবেগীরা।

ভারতবর্ষে নারী ক্ষমতায়নের প্রাচীন নজির এই উর্দুবেগী

হারেমে মহিলারা সম্রাট ব্যতীত সমস্ত পুরুষের সামনে পর্দা করত, প্রতীকী ছবি

পর্দা প্রথাকে প্রাধান্য দেবার জন্য নারী সৈন্যের এই ব্যবহার ছিল অতীব সফল একটি কৌশল। হারেমে আসার উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে তারা আগত মেহমানদেরকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিতেন। হারেমের নারীরা বেড়াতে গেলেও তাদের সফরসঙ্গী হয়ে তাদেরকে সুরক্ষিত রাখতেন এই যোদ্ধারা। প্রাসাদের ভেতর ও বাইরের ষড়যন্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য চব্বিশ ঘন্টাই পালা করে পাহারায় নিয়োজিত থাকতেন তারা।

এই উর্দুবেগী নারীদেরকে বর্ষা, তীর-ধনুক, আগ্নেয়াস্ত্র, তলোয়ার, ছুরি ইত্যাদি সব ধরনের অস্ত্র চালানোর জন্য কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। যুদ্ধ পরিচালনার কৌশলও তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হতো। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সম্রাট এবং তার পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের ওপরই ন্যস্ত ছিলো। তবে কাজের জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট সময় শেষ হলেই নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারতেন তারা।

কিশোরী সারান লাল তার বই ‘দ্য মুঘল হারেম’-এ উল্লেখ করেন, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার বিষয়ক যুদ্ধের সময় উর্দুবেগীদের নিয়ে এতোটাই শঙ্কিত ছিলেন যে, বাবা শাহজাহানের সাথে তার প্রাসাদে দেখা করতে যাওয়াকেও তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি উর্দুবেগীদের শক্তি ও দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তার ভয় ছিলো যে, এই উর্দুবেগী নারী যোদ্ধারা তাকে হত্যা করে ফেলতে পারে।

উর্দুবেগী নারীর ক্ষমতা দিয়ে শাহজাদীর আসত

হারেমে নতুন শাহজাদীর আগমনের উৎসব। ছবি: Wiki Media

কোথায় হারিয়ে গেলেন এই অসম সাহসী নারীরা? পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা বাংলার সিংহাসন দখল করে বসে। তারপর একে একে সমগ্র ভারতবর্ষ দখলের দিকে অগ্রসর হয়। ১৮৫৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৮৫৮ সালে মুঘল বাদশাহও গদিচ্যুত হন। বার্মায় নির্বাসিত জীবনে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গী হয়েছিলেন তার বেগম ও দুই ছেলে সন্তান। তাদের দায়িত্ব নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কতিপয় সাধারণ সৈন্য। শান-শওকতের দিন শেষ হয়ে যায় মুঘলদের। হারেমের মানুষগুলোও হারিয়ে যায় সাধারণ মানুষের ভিড়ে। আর ফুরিয়ে যায় উর্দুবেগীদের প্রয়োজনীয়তা। ইতিহাসবিদরা তাদের গল্প লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনই বোধ করেন নি কোনো দিন। আর তাই এসব দুর্ধর্ষ ও অসম সাহসী নারী যোদ্ধাদের আকর্ষণীয় গল্পগুলো পর্দার আড়ালেই থেকে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য তথ্য, যা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারতো।

ভারতবর্ষে নারী ক্ষমতায়নের প্রাচীন

উর্দুবেগীদের মধ্যে মাত্র একজনেরই নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। প্রতীকী ছবি

আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসবিদদের ভেতর এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে -যা কিছু উন্নত, সব যেনো তাদেরই সৃষ্টি। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও নাকি তাদেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিলো। এমনটাই তো জেনে এসেছি আমরা সবসময়। ঔপনিবেশিক শক্তিকে প্রমাণ করবার উদ্দেশ্য থেকে ইচ্ছা করেই আমাদেরকে তারা অজ্ঞ করে রেখেছে আমাদের শক্তিশালী নারীদের ইতিহাস সম্পর্কে। তাই আজ আমরা এই দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছি। তুলে ধরতেই হবে আমাদের সঠিক বিশুদ্ধ ইতিহাস।

 

রেফারেন্স: